কিছুমিছু
আঙুল নাড়তে নাড়তে গাঙের পানি ভালোই ঘোলা হইছে
মোকাম্মেল হোসেন
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঘুমের মধ্যে মগরম মিয়ার মনে হল, ভূমিকম্প হচ্ছে। জলের গভীরে সৃষ্ট বুঁদবুঁদ যে আকুলতা নিয়ে উপরে উঠে আসে, মগরম মিয়াও সেই আকুলতা নিয়ে নিদ্রার কোল থেকে উত্থিত হলেন। কিছুটা সুস্থির হওয়ার পর মগরম মিয়া খেয়াল করলেন- বিছানা কাঁপছে না; শরীরও কাঁপছে না! ভূমিকম্প হলে বিছানাসহ পুরো শরীর কাঁপার কথা; অথচ কাঁপছে শুধু তার মাথা! ঘটনা কী?
ঘুম থেকে মানব প্রজাতির জেগে ওঠার বিভিন্ন স্তর আছে। ঢুলুঢুলু স্তর অতিক্রমের পর ঘটনা কোনখানে প্যাঁচ খেয়েছে- মগরম মিয়া বুঝতে পারলেন। ভূমিকম্প-ফূমিকম্প কিছু নয়; এটা হচ্ছে, মোবাইল ফোনের কলসেটিং ফাংশনে ‘ভাইব্রেশন মুড’ অ্যাকটিভ রাখার ফলাফল। বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে মগরম মিয়া কল রিসিভ করলেন। ফোনের ওপাশ থেকে পারদের মতো ভারি গলায় একজনের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো-
: আসসালামু আলাইকুম।
লোকটার গলার স্বর সম্পূর্ণ মগরম মিয়ার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। তিনি ভাবলেন, সালামের পর লোকটা তার পরিচয় দিয়ে বক্তব্য পেশ করবে। সেরকম কিছু ঘটল না। লোকটা পুনরায় একই ভঙ্গিতে সালাম দিল। অচেনা এই লোকটা কে? মগরম মিয়ার আম্মা অসুস্থ। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। লোকটা কি হাসপাতালের কেউ? কোনো ডাক্তার অথবা অন্য কেউ? আম্মার সঙ্গে মগরম মিয়ার বড় আপা রয়েছে। মধ্যরাতে আম্মা সর্ম্পকিত কোনো সংবাদ দিতে হলে তারই দেয়ার কথা। নাকি পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, বড় আপা ফোন করার মতো অবস্থায় নেই! গম্ভীর কণ্ঠস্বরের অধিকারী এই লোকটা বড় আপার হয়ে জননী সংক্রান্ত সংবাদ মগরম মিয়ার কাছে সরবরাহ করছে!
মগরম মিয়ার মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও নানারকম প্রশ্ন ভিড় করেছে। এ ভিড় সামলাতে গিয়ে ভদ্রলোকের দ্বিতীয় সালামের জবাবও দেয়া হল না। লোকটার পরিচয় জানা দরকার। কথা বলতে গিয়ে মগরম মিয়া দেখলেন, গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। তিনি কি ভয় পেয়েছেন? নাকি গলায় কফের পাহাড় জমে গেছে- এ পাহাড় ডিঙ্গিয়ে মনের ভাবনা কথায় রূপ দিতে পারছেন না! এসব প্রশ্নের মীমাংসা হওয়ার আগেই মধ্যরাতের কলদাতা এবার মেঘগম্ভীর কণ্ঠে বললেন-
: বেটা! তোমাকে আমি দুইবার সালাম দিলাম। মুসলমানের বাচ্চা হয়েও তুমি আমার সালামের জবাব দাওনি; আফসোস!
বড়ই আশ্চর্যজনক ঘটনা! মগরম মিয়া হিন্দু না মুসলমান, বৌদ্ধ না খ্রিস্টান- তা একজন অপিরিচিত লোকের জানার কথা নয়। এই লোক জানল কীভাবে? সে কি মগরম মিয়ার বড় আপার ইসলামি লেবাস দেখে মগরম মিয়ার মুসমানিত্ব সম্পর্কে ইয়াদ করেছে? আচ্ছা, এই লোক যদি হাসপাতালের কেউ না হয়? মগরম মিয়া শিহরিত হলেন। হঠাৎ তার মনে হল, লোকটার কণ্ঠও যেন কেমন ভৌতিক মনে হচ্ছে! তাহলে? মগরম মিয়ার মনে সন্দেহ ও দ্বিধার ঘূর্ণি তৈরি হল- এটা কি মানবকণ্ঠ, না জিনকণ্ঠ? অপরিচিত কোনো মানবসন্তানের পক্ষে মগরম মিয়ার জাত-পাত-ধর্ম সম্পর্কে ইয়াদ করা সম্ভব নয়। তাহলে মুরুব্বি কি জিনের বাচ্চা? বাচ্চা, না বাদশা? উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, বিশেষ করে গাইবান্ধা জেলায় জিনের বাদশারা রাজত্ব করছেন- এরকম একটা সংবাদ কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়েছেন মগরম মিয়া। জিন মুরুব্বি কি গাইবান্ধা থেকে মগরম মিয়াকে ‘কল’ মেরেছেন, নাকি রাজধানীর কোনো আস্তানা থেকে তার খোঁজ-খবর নিচ্ছেন? জিনের বাদশা এরইমধ্যে রাজধানীর দখল নিয়েছেন এবং মগরম মিয়া তার নেকনজরে পড়েছেন, ভাবতেই তার মনের মধ্যে ভয় ও আনন্দের অবিমিশ্র ধারা তৈরি হল। জিনের বাদশাকে কী বলে সম্বোধন করা উচিত- মগরম মিয়া ভাবছেন, এমন সময় ওপাশ থেকে শোনা গেল-
: বেটা! তোমার সামনে বিপদ। কঠিন বিপদ। এই বিপদ থেকে কীভাবে তোমার মুক্তি ঘটবে, এটা বলার জন্যই আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম। বড়ই দুঃখের বিষয়; আমি তোমার মধ্যে কোনো আদব-লেহাজ-আগ্রহ দেখতে পেলাম না। এর ফল তুমি অচিরেই পাবে; অবশ্যই পাবে। একটার পর একটা বিপদ যখন তোমাকে দিশেহারা করে ফেলবে, তখন তুমি আমাকে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে খুঁজবে। দমে-দমে খুঁজবে; কদমে-কদমে খুঁজবে...
বিপদের কথা শুনে ভয় পায় না, এমন মানুষ খুব কমই আছে। মগরম মিয়া ভয় পেয়ে গেলেন। কয়েকবার হ্যালো-হ্যালো বলে চিৎকার করেও কোনো লাভ হল না। ততক্ষণে ওপাশ থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। চিৎকার শুনে মগরম মিয়ার বউ সুইটি বেগমের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে সুইটি বেগম জানতে চাইল-
: কে ফোন করছিল?
অজানা বিপদের আকার-আয়তন-ভয়াবহতা নিয়ে মগরম মিয়া তটস্থ। সুইটি বেগমের প্রশ্ন তার কাছে ততটা গুরুত্ব পেল না। বিচলিত কণ্ঠে মগরম মিয়ার উদ্দেশে সুইটি বেগম বলল-
: কথা বলতেছ না কেন! হাসপাতাল থেইকা কোনো খারাপ খবর আসছে?
: না।
: আপা কী বললেন?
: আপা ফোন করেন নাই।
: তাইলে কে ফোন করছে?
প্রশ্নটা অতি সরল। মধ্যরাতে স্বামীর হাতে ফোন দেখে স্ত্রীর মনে প্রশ্নের উদয় হওয়া স্বাভাবিক। কাজেই এ প্রশ্নের মধ্যে কোনো বক্রতার লেশমাত্র নেই। তবে মন-মেজাজ স্বাভাবিক অবস্থায় না থাকায় মগরম মিয়ার তা বাঁকা মনে হল। গলা চড়িয়ে মগরম মিয়া বলল-
: এত জেরা করতেছ কেন? তোমারে কে, কখন ফোন করে; আমি কোনো সময় সেইটা জানতে চাই?
: কোনো আজেবাজে পুরুষ আমারে ফোন করে না।
: আমারেও কোনো আজেবাজে মহিলা ফোন করে না।
: তাইলে কে ফোন করছিল- এইটা বলতে তোমার সমস্যা কোথায়?
মগরম মিয়া কী বলবেন- কিছুক্ষণ আগে তাকে যিনি ফোন দিয়েছিলেন, তিনি একজন জিনের বাদশা। এ কথা কি সুইটি বেগমের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে? বিশ্বাস করানোর একটা উপায় অবশ্য আছে। কিছুক্ষণ আগের সেই নম্বরে কল করার পর জিনের বাদশা নিশ্চয়ই কল রিসিভ করবেন। মগরম মিয়া সুইটি বেগমকে বললেন-
: একটু আগে ফোনে যার সঙ্গে কথা হইছে। আমি তারে কল করতেছি। তুমি তার সঙ্গে কথা বইলা দেখ, সে কোন লিঙ্গের অধিকারী। তবে তার আগে তোমার অজু কইরা আসা দরকার।
মগরম মিয়ার কথা শুনে সুইটি বেগম চোখ বড় করে জানতে চাইল-
: অজু করতে হবে কেন?
: আমার ধারণা, একটু আগে আমার নম্বরে যিনি কল করছিলেন- তিনি জিনের বাদশা। জিন জাতির সঙ্গে নাপাক শরীরে কথা বলা ঠিক না।
: তুমি ফোন করো। কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক না- এইটা আমি বুঝব।
ফোনের কললিস্টের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ আগে রিসিভ করা নম্বরে কল করলেন মগরম মিয়া। রিং হচ্ছে। একবার, দুইবার, তিনবার ফোন করলেন মগরম মিয়া। নাহ্! কোনো কাজ হল না।
সুইটি বেগম বিছানা থেকে উঠে বসেছে। খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে অবাক চোখে মগরম মিয়ার কাণ্ডকারখানা দেখছে। মগরম মিয়া উদ্যোগ বিফলে যাওয়ার পর উপহাসের সুরে বিউটি বেগম বলল-
: কী হইল! ফোন ধরে না?
: ইয়াসিনের আম্ম! ঠেস মাইরা কথা বলবা না। ঠেসমারা কথাবার্তা একেবারেই পছন্দ না।
: আশ্চর্য! এইটা ঠেসমারা কথা হইল? একজন তোমারে ফোন করার পর তুমি তার কল রিসিভ করছো। তার সঙ্গে তোমার মিষ্টি-আলাপনও সম্পন্ন হইছে। সেই তারে তুমি এখন কল করতেছ, অথচ সে তোমার কল কেন রিসিভ করতেছে- এইটা জানতে চাওয়া কি অন্যায়?
: ন্যায়-অন্যায়ের মীমাংসা সকালে হবে। দয়া কইরা এখন ঘুমাও।
সুইটি বেগমের মধ্যে ঘুমানোর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। সন্দেহের সুরে সে বলল-
: ইয়াসিনের আব্বা! তুমি দেখতেছি ডুইব্যা-ডুইব্যা পানি খাইতেছ! কতদিন ধইরা নীরবে-নিভৃতে পানিপান চলতেছে, কও তো আমারে।
লে হালুয়া! মগরম মিয়া দেখলেন- পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। মধ্যরাতের অশ্বারোহী বলে একটা কথা আছে। এর সঙ্গে মিল রেখে কিছুক্ষণ আগে রিসিভ করা নম্বরটা ‘মিডনাইট কলার’ নামে সেভ করে একটু পরপর মোবাইল ফোনের সেন্ডবাটন চাপতে লাগলেন মগরম মিয়া। বারকয়েক রিং হওয়ার পর যান্ত্রিক নারীকণ্ঠে ফোন বন্ধ থাকার ঘোষণা ভেসে এল। এখন উপায়?
যিনি কল করেছিলেন, তিনি মহিলা নন- একজন পুরুষ, এটা প্রমাণ করা জরুরি। মরজ্বালা! ফোন বন্ধ থাকলে এটা প্রমাণ হবে কিভাবে? মগরম মিয়া পরদিন অফিসের লাঞ্চ পিরিয়ডে ফোন কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে গেলেন। সেবা প্রদানকারী এক নারীর সামনে কাগজে লেখা নম্বরটা রেখে বললেন-
: ম্যাডাম, এই নম্বরটা কার- কাইন্ডলি জানাইতে পারবেন?
সেবা প্রদানকারী নারী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
: কেন বলুন তো!
: আমার জানা দরকার।
: কেন জানতে চান?
: এইটা বলতে চাইতেছি না। মনে করতে পারেন, এইটা অমার জীবন-মরণ সমস্যা।
: আশ্চর্য তো! এই নম্বর থেকে যদি আপনাকে বিরক্ত করা হয়, তাহলে সেটা রোধ করার ব্যবস্থা আছে। নম্বরটা ব্লক করে দিলেই হবে। আপনি সঠিকভাবে কিছু না বললে তো আমি বুঝতে পারব না।
মগরম মিয়া তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন-
: না-না; বিরক্ত করার কোনো ব্যাপার না। আমি শুধু এই নম্বরের অধিকারীর নাম, বয়স, পেশা, লিঙ্গ- এইসব জানতে চাই।
: স্যরি! কোনো গ্রাহকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা আমাদের বিজনেসের একটা অংশ।
: কিন্তু এই নম্বরটা যিনি ব্যবহার করতেছেন, তারে আমার খুঁইজ্যা বাইর করা দরকার।
: বের করতে হলে আপনি থানায় যান। পুলিশের সাহায্য নেন।
মগরম মিয়ার মাথা এখনও পুরোপুরি খারাপ হয়নি- সেধে পুলিশের কাছে যাবেন। পুলিশের কাছে গেলেই তারা তিলকে তাল বানাবে। বিষয়টার মধ্যে বিভিন্ন রঙ ও গন্ধের সন্ধান করবে। মগরম মিয়াকে চুপ থাকতে দেখে ভদ্রমহিলা বললেন-
: আপনি অবশ্য আরেকটা কাজ করতে পারেন।
: কী কাজ?
: নম্বরধারীর খোঁজ চেয়ে পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিতে পারেন।
বেটির মনে হচ্ছে ভালোই রসবোধ আছে। চান্স পেয়ে মগরম মিয়ার সঙ্গে হালকা রস ঢেলে দিল। মগরম মিয়া মন খারাপ করে ঘুরে দাঁড়াতেই প্রতিবেশী ইকবাল সাহেবের সঙ্গে দেখা হল। ইকবাল সাহেব হাসিমুখে জানতে চাইলেন-
: কেমন আছেন?
: ভালা নারে ভাই।
: কেন? কী হইছে!
সমস্যার কথা ইকবাল সাহেবকে বলার পর তিনি বললেন-
: উল্টাপাল্টা কথা বইলা ভাবীরে চেতাইয়া দিছেন; শুধু শুধু পানি ঘোলা করছেন। এইটা ঠিক হয় নাই।
মগরম মিয়া হাতের আঙুল মুচড়াতে মুচড়াতে বললেন-
: তা অবশ্য ঠিক। আঙুল নাড়তে নাড়তে গাঙের পানি ভালোই ঘোলা হইছে!
: আরে! আজকাইল মোবাইল ফোনে কী না হইতেছে? চাঁদাবাজি, রংবাজি, টপ্পাবাজি, প্রতারণা-বাটপারি- সবই ঘটতেছে। আমার মনে হয়, এইটা হানড্রেড পার্সেন্ট চিটিং কেইস।
কান্নাভেজা গলায় মগরম মিয়া বললেন-
: ভাই, পরিস্থিতি বর্তমানে চ্যালেঞ্জিং পর্যায়ে গিয়া পৌঁছাইছে। মনে হয়, চিটিং-বাটপারির দোহাই দিয়া পার পাওয়া যাবে না। বাস্তবে প্রমাণ করতে হবে- গতকাইল মধ্যরাতে ফোনে একজন পুরুষ মানুষ আমার সঙ্গে কথা বলেছেন।
: তাইলে আর কী করা? চাকরি-বাকরি বাদ দিয়া জিনের বাদশারে খুঁজতে থাকেন। দেখেন, পাওয়া যায় কিনা!.
অফিস শেষে মগরম মিয়া হেঁটে বাসায় ফিরছেন আর একটু পরপরা ফোনবুকে সংরক্ষিত ‘মিডনাইট কলার’-এর নম্বরে ফোন করছেন। একইসঙ্গে চোখকানও খোলা রেখেছেন। রাস্তায় রহস্যময় কোনো ছালাবাবার দেখা পেলেই তার সামনে চিৎ হয়ে পড়ে যাবেন। মগরম মিয়া বুঝতে পারছেন না- এরকম অবস্থাকেই দমে-দমে, কদমে-কদমে খোঁজা বলে কিনা?
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
mokamia@hotmail.com
