কিছুমিছু
লাঠি বাবার দরবারে ছেঁচা খাইলে রোগ সারে
মোকাম্মেল হোসেন
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শাড়ি পরেছে আকাশ। ধূসর রঙের মেঘশাড়ি গায়ে জড়িয়ে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়জনের অপেক্ষায় ব্যাকুল কোনো রমণী দূর-দিগন্তে দৃষ্টি মেলে স্থির চোখে যেভাবে তাকিয়ে থাকে, আকাশের অবস্থাও তদ্রুপ। এরকম আকাশ দেখে মন উদাস হয়।
উদাস মন তখন কী পাওয়ার আশায় আকুল হয়, তা সে নিজেই জানে না। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে মনের এ আকুলতা কার কাছে প্রকাশ করব, বুঝতে পারছি না। সামনে পাহাড়-সমুদ্র-বনভূমি নেই, নেই ফুল-পাখি-প্রজাপতি; আছে কেবল ক্রংক্রিটের জঞ্জাল। আছে শব্দ-সন্ত্রাস। এসময় শব্দ-সন্ত্রাসীর খাতায় পকেটের মোবাইল ফোন নাম এন্ট্রি করে কুরত-কুরত সুরে ডেকে উঠল। কল রিসিভ করে হ্যালো বললাম। ওপাশ থেকে উৎকণ্ঠা মেশানো গলায় লবণ বেগম জিজ্ঞেস করল-
: খবর কী তোমার!
: ভালো খবর।
: ডাক্তার কী বলছে?
: ডাক্তারসাব আমারে কবরের বাসিন্দা বানাইয়া দিছে!
: মানে?
: কবরে যেইরকম বালিশ ছাড়া শুইয়া থাকার সিস্টেম, আমিও সেই সিস্টেমের মধ্যে পইড়া গেছি।
: বুঝলাম না; পরিষ্কার কইরা কও।
: ডাক্তারসাব আমারে মাথায় বালিশ দিয়া শুইতে নিষেধ দিছে।
: ওষুধপত্র কিছু দেয় নাই?
: উহু। কয়েক প্রকার ব্যায়াম আর গলায় কুকুরের বেল্ট বাঁধতে বলছে।
: তাসিনের আব্বা! এইটারে কুকুরের বেল্ট কয় না; জিনিসটা হইল সার্ভিক্যাল কলার।
: জানতাম না।
: ঠিক আছে; তাড়াতাড়ি আসো।
প্লাস্টিকের একটা চিকন নল হাতে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। নল দেখে লবণ বেগম জানতে চাইল-
: এইটার কী কাজ?
: পানি পান করার কাজে ব্যবহার করব।
: মানে?
: নল ফিট করা ফারসি হুঁক্কা দেখছো?
: দেখছি।
: ফারসি হুঁক্কার মাধ্যমে নায়েব-জমিদাররা যে স্টাইলে ধূমপান করত, সেই একই স্টাইলে পানির গ্লাস থেইকা পানি পান করবো।
: হাত কী দোশ করছে?
: ডাক্তার হাত দিয়া ওজনদার কোনো বস্তু তুলতে বিধিনিষেধ আরোপ করছে।
: পানির গ্লাস আর কয় ছটাক ওজন?
: সাবধান হইলে দোষ কী?
: পানির গ্লাসে নল ফিট কইরা না হয় পার পাইলা, কিন্তু টয়লেটে কী করবা? বদনা হাতে নেওন লাগব না?
: পিচকারির ভেতরে পানি দেওয়ার পর সেই পানি পাম্প কইরা পাছার ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা অতি সহজ। বাঁশের চোঙ্গা দিয়া একটা পিচকারি বানানোর কথা ভাবতেছি।
: উত্তম ভাবনা। তবে তুমি আরেকটা কাজ করতে পারো।
: কী কাজ?
: শরীরে স্যালাইন পুশ কইরা শুইয়া থাকো। খানা-খাইদ্য গ্রহণ না করলে টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হ্রাস পাবে।
: তাসিনের আম্মা, অনেক অনেক ধন্যবাদ। তুমি আমারে একটা মৌলিক পরামর্শ দিছো!
ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে যেতেই লবণ বেগম হৈ-হৈ করে উঠল। বলল-
: আবার কই যাও?
: স্যালাইন লইয়া আসি।
: তুমি কি সত্যি সত্যি শরীরে স্যালাইন লাগাবা নাকি?
: তুমিই তো লাগাইতে বললা!
: আরে আল্লাহ! এত বোকা মানুষ হয়! তোমার সমস্যা ঘাড়ে; হাত লইয়া নাচানাচি করতেছো কীজন্য?
লবণ বেগমের কথার উত্তর না দিয়ে দরজার বাইরে পা রাখলাম। ওষুধের দোকানে যাওয়ার পথে হারেজ মুন্সির সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখে তিনি বললেন-
: গলায় পেট্টি ক্যান?
: ঘাড়ে সমস্যা।
: স্পন্ডোলাইসিস?
: বুঝতেছি না।
: কোনো সমস্যা নাই। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হইয়া যাবে। আপনে একদিন আমার সঙ্গে নান্দাইল চলেন।
: নান্দাইল যাইয়া কী করবো?
: নান্দাইল উপজেলার মশুলি ইউনিয়নের কিসমত রসুলপুর গ্রামে এক পীরসাহেব আছেন, তার চিকিৎসা গ্রহণ করলে আপনার ঘাড়মাড় সব টাইট হইয়া যাবে।
: তাই নাকি?
: হ।
: হুজুর কি এমবিবিএস?
: আরে না!
: তাইলে উনি আমার চিকিৎসা করবেন কী প্রকারে?
: এইটাই তো রহস্য। আল্লাহপাক কারে কখন কোন ক্ষমতার অধিকারী করেন, কারও পক্ষে সেইটা বলা সম্ভব না। : হুজুর কি ন্যাংটাকাল থেইকাই পীর, নাকি বুইড়াকালে পীর হইছেন?
: আগে সরকারি অফিসে চাকরি করতেন। অবসর গ্রহণের পর পীর হইয়া মানুষের খেদমতে নিয়োজিত হইছেন।
সরকারি অফিসের কিছু লোক সারা জীবন ঘুষ-দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকে অবসর গ্রহণের পর জোব্বাধারী হয়ে যান। তারা দান-খয়রাত, সমাজকল্যাণ ইত্যাদির পাশাপাশি তাবলিগের চিল্লায় চিল্লায় ঘুরে বেড়ান; তবে কেউ পীর হয়েছেন- এমন তথ্য আমার অজানা। পীরসাহেবকে দেখার জন্য কৌতূহলী হলাম।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকালবেলা নান্দাইলের রসুলপুর গ্রামে গিয়ে দেখি লোক সমাগম প্রচুর; যাকে বলে লোকে লোকারণ্য। মানুষজন নানা সমস্যা নিয়ে হুজুরের দরবারে এসেছে। কারও প্যারালাইসিস। কারও ক্যান্সার। কারও কিডনি অকেজো হয়ে গেছে। অসংখ্য অসুস্থ লোকজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মানব প্রজাতির বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষার তীব্রতা পরিমাপ করার চেষ্টা করছি। ঘরে খাবার নেই, পকেটে টাকা নেই, শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা- এরকম কোনো মানুষের মৃত্যু আসন্ন হওয়ার পর যদি প্রশ্ন করা হয়, সে কী চায়? আমার ধারণা, সে আয়ু চাইবে। বেঁচে থাকার আকুতি জানাবে।
একটু সামনে যেতেই পানিভর্তি বড় বড় ডেকচি দেখতে পেলাম। পীরসাহেবের ফুঁ দেয়া পানি বোতলজাত করে রোগীদের কাছে বিতরণ করা হচ্ছে। পানি ফ্রি, তবে বোতলের জন্য পয়সা গুনতে হয়। আজকাল বাজারে এক ধরনের এয়ার কন্ডিশনার পাওয়া যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, চালু করার সঙ্গে সঙ্গে মশারা ঘর ছেড়ে পালাবে। তার মানে ঠাণ্ডা খাওয়ার পাশপাশি মশা মারার ওষুধ ফ্রি। দেশের অনেক কোম্পানি আজকাল বোতলজাত পানি বিক্রি করছে। তারা পীরসাহেবের ‘ফুঁ’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বলতে পারে- পানির সঙ্গে যাবতীয় জটিল ও কঠিন রোগের ওষুধ ফ্রি। এরকম হলে লোকজনকে কষ্ট করে আর নান্দাইল আসতে হবে না। যে কোনো দোকান থেকে পানির বোতল কিনে তৃষ্ণা নিবারণের পাশাপাশি রোগ নিরাময়ের সুফল পাবে। মুন্সিকে বললাম-
: পানিপড়া খুবই কমন একটা পদ্ধতি। মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন থেকে শুরু কইরা পীর-ফকির, সাধুবাবা সবাই এই বিদ্যা প্রয়োগ করে।
প্রবল উৎসাহের সঙ্গে মুন্সি বলে উঠল-
: হুজুরের আরও একটা পদ্ধতি আছে।
: সেইটা কী?
: পিটুনি পদ্ধতি, যারে বলে ছেঁচা দেওয়া।
: সত্যি সত্যি লোকজনরে ধইরা পিটায় নাকি?
: হ।
: পিটাপিটি করা তো পুলিশের কাজ।
: উনার এক চাচা পুলিশের দারোগা ছিলেন।
: তাইলে ঠিক আছে। পীরসাব পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রাখতে সক্ষম হইছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজনের মধ্যে পানির বোতলের জন্য কাড়াকাড়ি শুরু হল। আমাদের মন্ত্রী-সচিবরা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ঘোষণা প্রচার করছেন। কথাটা মনে পড়তেই খুব হাসি পেল। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিপ্লব সম্পন্ন হওয়া একটি দেশে মানুষ পীরের ফুঁ দেয়া পানির বোতলের জন্য ছোটাছুটি করছে, ভাবা যায়! সামনে দিয়ে এক মা তার ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলাম-
: আপনার ছেলের কী অসুখ হইছে?
: কিডনি সমস্যা।
: পানিপড়ায় এই রোগ ভালো হবে?
: প্রথমবার তো এই বিশ্বাস লইয়াই আইছিলাম বাজান। পরে বিপদে পইড়া গেছি।
: বিপদ কিসের?
: হুজুরের কাছে একবার আওনের পর অন্য কোথাও চিকিৎসা করা নিষেধ। গেলে ক্ষতি হয়। এমন কী মৃত্যুও হইতে পারে।
: কে বলছে এই কথা?
: লোকজন বলাবলি করে।
বোতল বিতরণ সেক্টর পার হয়ে ছেঁচা সেক্টরে গেলাম। দেখলাম, পীরসাহেব রোগীকে ভর্ৎসনার পাশাপাশি লাঠি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রহার করছেন।
আমাকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে ফিসফিসিয়ে মুন্সি বললেন-
: যান।
আমি মাথা নাড়লাম। অবাক হয়ে মুন্সি বললেন-
: কেন!
: মাইরপিটের মধ্যে আমি নাই।
বাসে চড়ে ময়মনসিংহে ফিরছি। বাসের এক যাত্রীর সঙ্গে মুন্সিকে কুশল বিনিময় করতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম-
: আপনের পরিচিত নাকি?
: আমাদের পীরসাহেবের ছেলে।
: লাঠি বাবার ছেলে কী করে?
উত্তরে মুন্সি জানাল-
: মমিনশিং শহরের একটা বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়তেছে।
লাঠি বাবার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা কেউ অন্য কোথাও চিকিৎসা করাতে গেলে বিপদ হবে- এ কথা তার লোকজন কৌশলে প্রচার করছে; অথচ লাঠি বাবা তার নিজের ছেলেকে প্রচুর টাকা-পয়সা ব্যয় করে ঠিকই ডাক্তারি পড়াচ্ছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে তার কি উচিত নয়, বাবার কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করা? সে তাহলে প্রতিবাদী হচ্ছে না কেন? পৃথিবী সত্যিই আজব জায়গা; আমার মাথা কাজ করছে না। মনে হচ্ছে, মাথার নাটবল্টু সব খুলে পড়ে যাবে।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
mokamia@hotmail.com
