আন্তর্জাতিক নারী দিবস
নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন
ড. আফরোজা পারভীন
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অধিক জনসংখ্যার বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের একটি দ্রুত উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। বিশ্বের অষ্টম অধিক জনসংখ্যার এই দেশে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসনের হার দ্রুত বাড়ছে।
একইভাবে শিল্পায়নের জন্য নগরায়নও দ্রুত বেড়ে চলেছে। মানুষের চাহিদার পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানও বেড়েছে। প্রয়োজনের তাগিদে নারীরা ঘর থেকে বের হয়েছে। বিভিন্ন কলকারখানা, অফিস-আদালতে নারীর একটি বিশাল অংশ নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে নিয়েছে।
যেখানে ২০১০ সালে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৬২ লাখ, সেখানে ২০১৭ সালে এর সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১ কোটি ৮৬ লাখে। বাংলাদেশের সব নারীই কাজ করে খায়, কারণ তারা ভোর থেকে মধ্যরাত নাগাদ কোনো না কোনো কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন।
তবে যারা অর্থের বিনিময়ে কর্ম সম্পাদন করেন, কেবল তাদের আমরা কর্মজীবী নারী বলি। নারীর যে বিশাল অংশ দিনরাত ঘরে পরিশ্রম করে, সন্তান লালন-পালন করে তাদের কাজকে অর্থনৈতিকভাবে আমরা মূল্যায়ন করি না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নারীদের সঙ্গে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা অসম্মানজনক আচরণও করে থাকে।
দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী, নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ১৪৪টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম। অর্থাৎ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় নারীর ক্ষমতায়নের দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে। এক্ষেত্রে ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১০৮, ১০৯, ১১১, ১২৪ ও ১৪৩তম। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে এই সূচকের উন্নয়ন আশার সঞ্চার করে। নারীর ক্ষমতায়ন একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতায়নের বিষয়টি সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং সুশাসনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ক্ষমতায়ন মানুষের পছন্দ ও সুযোগ বাড়ায়, ক্ষমতা মানুষের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন। ক্ষমতায়ন হলে দারিদ্র্য হ্রাসে সুফল পাওয়া যায়। যদিও এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক এগিয়ে তথাপি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের জোগান দিতে কেবল ১১.৩ শতাংশ নারী স্বীকৃতি পেয়ে থাকে। স্বীকৃতি পেলেও কেবল ৩.৬ শতাংশ নারী ওই উৎপাদন বিষয়ে স্বাধীনভাবে মতামত দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। আইনে বলা আছে, সম্পত্তির মালিকানায় নারীর অধিকার পুরুষের অর্ধেক। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কেবল ৪.৬ শতাংশ নারীর সম্পদে মালিকানা রয়েছে। এই ৪.৬ শতাংশের মধ্যে মাত্র ৭.৫ শতাংশ নারী সম্পদের ক্রয়-বিক্রয় বা সম্পদ হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অর্থাৎ পরিবারের পুরুষ সদস্য রাজি না হলে নারীরা সম্পদের ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তর করার ক্ষমতা রাখে না।
সংসারের প্রাপ্তি এবং জমার ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে কেবল ৯.৫ শতাংশ নারী। শতকরা ৯০.৫ ভাগ অর্থ পরিবারের পুরুষ সদস্যদের পছন্দমতো খরচ বা জমা করা হয়। ১ কোটি ৮৬ লাখ নারী সরাসরি অর্থ আয়ের সঙ্গে জড়িত থাকলেও মাত্র ১৫.৮ শতাংশ নারী তার নিজস্ব আয়কৃত অর্থ ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। ইচ্ছা হলেই যে একজন নারী পছন্দের কিছু কেনাকাটা করবে এটা খুব কমসংখ্যক নারীর ভাগ্যে জোটে। সিংহভাগ নারীর কেবল গৃহ ও সন্তানের স্কুলের মধ্যে চলাচল সীমাবদ্ধ থাকে। কেবল ১৬.৭ শতাংশ নারী বাইরে বেরিয়ে সর্বসাধারণের সঙ্গে কথা বলা ও মেলামেশা করতে পারে। জনগণের সামনে কথা বলার সুযোগ বা অধিকার খুব কম নারীরই আছে। অতিরিক্ত কর্মভারে ন্যুব্জ থাকেন ৪.৮ শতাংশ নারী, যে কারণে জীবনটা তাদের কাছে অসহনীয় মনে হয়। ভোর থেকে মধ্যরাত নাগাদ কাজের মাঝে অবসরের সুযোগ পান না ৭.৯ শতাংশ নারী। অথচ গৃহকর্মে নারীদের তেমন কোনো স্বীকৃতি নেই বললেই চলে।
বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটে থাকে। ভৌগোলিক অবস্থান, বয়স, অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা, মিডিয়া এক্সপোজার ইত্যাদির ওপর নারীর ক্ষমতায়ন নির্ভর করে। এগুলোর ওপর নির্ভর করে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ, আত্মপ্রত্যয় ও গতিশীলতা। ক্ষমতায়নের সঙ্গে নারীর সুযোগ-সুবিধা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন ক্ষমতাবান নারী নিজের জন্য সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে নিতে পারেন। অন্যভাবে বলা যায়, যে নারী নিজের জন্য অধিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারছেন তাকে আমরা ক্ষমতাবান নারী বলতে পারি। এই সুযোগ-সুবিধাগুলো আবার হতে পারে বস্তুগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানবিক, তথ্যগত, মনস্তাত্ত্বিক ইত্যাদি, যা মানুষ তাদের লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োগ করে থাকে। সমাজের আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে তার সক্ষমতা প্রয়োগে হয় সহজতর করে নয়তো বাধা সৃষ্টি করে থাকে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ভ্রূণ থেকেই ছেলে-সন্তানের পাশাপাশি মেয়ে-সন্তানদের ক্ষেত্রে সমান যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। সন্তান গর্ভধারণের পর পুত্র-কন্যা নির্বিশেষে ভ্রূণের যত্ন নিতে মায়ের জন্য বিশেষ সুষম খাদ্যের জোগান দেয়া, মায়ের মন ভালো রাখার জন্য চেষ্টা করা, ভারি কাজ না করানো, বিশ্রামের ব্যবস্থা করা, দক্ষ দাই বা ডাক্তারের কাছে সন্তান প্রসব করানো, পুত্র-কন্যা নির্বিশেষে সুষম খাদ্য, শিক্ষা, ভালো আচরণ ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবার থেকেই নারীকে সম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে, যাতে সে আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে মা-বাবা বিশেষ নজর দিলে অবশ্যই একজন নারী সমতার ভিত্তিতে ক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাবেন। নারীর উন্নয়ন ঘটলেই একটি জাতির উন্নয়ন ঘটা সম্ভব। সব পর্যায়ের নারীর ক্ষমতায়নে সরকার, দেশীয় তথা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভূমিকা রাখবে, এটাই আমার প্রত্যাশা।
ড. আফরোজা পারভীন : নির্বাহী পরিচালক, নারী উন্নয়ন শক্তি
