কিছুমিছু
তোমার কথা আছে গো মনে এই ফাগুনে...
মোকাম্মেল হোসেন
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এ ধরনের নাম আগে কখনও শুনিনি। জিনিসটা খাওয়ার, না খেলনাজাতীয়- বুঝতে পারছি না। পরিষ্কার হওয়ার জন্য ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা জাহিন মিয়ার কাছে জানতে চাইলাম-
: আব্বু! জিনিসটা কী?
বাপের অজ্ঞতায় জাহিন মিয়া খুবই মজা পেল। হাসতে হাসতে বলল-
: আরে! এইটা তো চকলেট।
: চকলেট!
: হুঁ; তুমি জান না!
: না।
: এইটা চকলেট।
দোকানে গিয়ে দেখলাম- জাহিন মিয়ার অর্ডার করা চকোলেটটা বিদেশি। বিদেশি এ বস্তুটির পরিবেশনা অতি চমৎকার। ডিম আকৃতির সুদৃশ্য প্লাস্টিকের ছোট্ট একটা কৌটার ভেতর টিকটিকির ডিমের মতো কুড়িখানেক কথিত চকোলেট শোভা পাচ্ছে। চকোলেটের সঙ্গে ফাউ হিসেবে একটা খেলনা রয়েছে। বোঝা যায়- কোম্পানি আণ্ডার মধ্যে আণ্ডা ভরার শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা করেছে। কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখার পর দাম জিজ্ঞেস করতে যাব, পকেটের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ওপাশ থেকে জাহিন মিয়া বলল-
: আব্বু, অরেঞ্জ কালার আনবা না।
: কেন!
: অরেঞ্জ হচ্ছে মেয়েদের কালার। আমার জন্য নীল রঙেরটা আনবা। নীল- বুঝছো?
: বুঝতে পারছি।
: তাড়াতাড়ি আসবা।
: আইচ্ছা।
ডিমের রঙ নিয়ে এতক্ষণ মাথা ঘামাইনি। জাহিনের কথায় পরিষ্কার হল, এক্ষেত্রেও গূঢ় মনস্তত্ত্বের ব্যাপার আছে। জিনিসটার দাম জিজ্ঞেস করার পর দোকানদার রুপির মূল্যমান টাকায় রূপান্তরিত করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে যা শোনাল, আঁতকে উঠলাম। এরকম ছোট্ট ডিমাকৃতির একটা বাক্স আর তার ভেতরে সাগুদানার মতো কয়েকটা চকোলেটের এত দাম! আমার লাগবে মোট চার কৌটা। একটা কৌটা নিয়ে বাসায় হাজির হলে বাকি দুই ছেলে এবং তাদের মা গাল ফোলাবে। গোল নিয়ে গণ্ডগোল লাগানো ঠিক হবে না। চারটা বিদেশি চকোলেটের দাম হিসাব করার পর হোঁচট খেলাম। এই ছাতারমাথার জিনিসের পেছনে এত টাকা ব্যয় না করে বরং এ টাকায় বই কেনা যেতে পারে। তবে এজন্য জাহিনের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। পোলাপান মানুষ; পছন্দের জিনিস না পেলে মন খারাপ করতে পারে। ফোন করলাম। ফোন ধরল লবণ বেগম। সে জানতে চাইল-
: কী জন্য ফোন করছ?
আকাশে-বাতাসে, গাছে আর পাখিদের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে বসন্ত বন্দনা। এরকম একটা পরিবেশে সামান্য রোমান্টিক হওয়া নিশ্চয়ই দোষের কিছু নয়। বললাম-
: কোকিলের ডাক শুইনা মনটা বড় ব্যাকুল হইছে; সেই জন্য তোমারে ফোন দিলাম।
লবণ বেগম আমার কথা বিশ্বাস করল না। বলল-
: মিছা কথা।
: কোকিলের ডাক কি মিথ্যা?
: কোকিলের ডাক মিথ্যা না; তোমার কথা মিথ্যা।
: কেমনে মিথ্যা হইল!
: কোকিল কি এইবারই প্রথম ডাকতেছে? প্রতিবছর বসন্তকালে কোকিলের ডাক শোনা যায়। কিন্তু সেই ডাক শুইনা তোমার মন ব্যাকুল হইছে- বিগত ১৮ বছরে এমন ঘটনা ঘটে নাই! আসল কথা কও- কী জন্য ফোন করছো, সেইটা বলো।
: তোমার আশেপাশে জাহিন আছে?
: আছে।
: দেও তো একটু।
যেখানে দাঁড়িয়ে আছি- সেখান থেকে সামান্য দূরে কয়েকটা ফলের দোকান। দোকানগুলোয় আপেল-আঙ্গুর-কমলা-নাশপাতির পাশাপাশি বাউকুল, আপেলকুল ইত্যাদি শোভা পাচ্ছে। জাহিন মিয়া হ্যালো বলার পর বললাম-
: আব্বু, চকলেট না আইন্যা তোমার জন্য বরই আনি?
: না।
: তাইলে আপেল?
: আপলে আনতে চাইলে ভাইয়াদের জন্য আনতে পারো। তবে আমার জন্য চকলেট আনবা; ঠিক আছে?
: আব্বু! এই চকলেটটা আমি আনতে চাই না।
: কেন!
: দেখতে ফিটফাট হইলেও আমার কেন জানি মনে হইতেছে, জিনিসটা তেমন ভালো না; আমি বরং তোমার জন্য অন্য একটা জিনিস আনি?
: কী জিনিস?
: সেইটা এই মুহূর্তে বলতে চাইতেছি না। শুধু এইটুক বলতে পারি- যা আনার নিয়ত করছি; আশা করি, তোমার পছন্দ হবে।
: যদি পছন্দ না হয়?
: বাপের ওপর ভরসা রাখ ব্যাটা।
শাহবাগের ফুটপাত ধরে সামনে অগ্রসর হচ্ছি- হঠাৎ একটা শিমূল ফুল টুপ করে মাথার একপাশ স্পর্শ করে পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ল। ফুলটা হাতে নিয়ে যত্ন করে পকেটে রাখলাম। বই কেনার জন্য যে মার্কেটে যাব বলে ঠিক করেছি, সেই মার্কেটের নিরাপত্তা রক্ষাকল্পে এর প্রবেশপথে একটা ‘নিরাপত্তা দরজা’ স্থাপন করেছেন কর্তৃপক্ষ। নিরাপত্তা দরজার সামনে দাঁড়াতেই সেখানে দায়িত্ব পালনরত একজন জিজ্ঞেস করলেন-
: আপনের পকেটে কী জিনিস?
লোকটার কথা শুনে নিরাপত্তা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম। জিনিসটা পকেট থেকে বের করার পর মিষ্টি হেসে বললাম-
: পুষ্প।
ঘুরে ঘুরে বেশকিছু বই কিনে ফেললাম। বাসায় ফেরার পর প্রথম জাহিন মিয়ার জন্য কিনে আনা বইগুলো তার হাতে তুলে দিলাম। এরপর অন্য দু’ছেলের হাতে। রঙ, ছবি ও বর্ণের বিস্ময়কর ভুবনে পা রেখে তিনজনই আনন্দে আত্মহারা। দেখলাম, চকোলেট প্রসঙ্গে জাহিন মিয়া কোনো প্রশ্ন করল না। বুঝতে পারলাম- নতুন বইয়ের ঘ্রাণ ওর মন থেকে চকলেট-ফকলেটের চাহিদা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ছেলেদের আনন্দ দেখতে দেখতে লবণ বেগম বলল-
: শুধু বাচ্চাদের জন্যই আনছো? আমার জন্য কিছু আন নাই!
: আনি নাই মানে? অবশ্যই আনছি।
: কই?
পকেট থেকে শিমূল ফুল বের করলাম। রঙতুলিতে আঁকা বিভিন্ন ছবিতে মোগল রাজা-বাদশারা যে ভঙ্গিতে প্রেয়সীকে প্রেম নিবেদন করছেন, তা নকল করে লবণ বেগমের উদ্দেশ্যে পুষ্প-উপহার নিবেদন করলাম। লবণ বেগম হেসে বলল-
: বইয়ের বদলে ফুল?
: হ, ফুল। বসন্ত উপহার।
: টুকাইয়া আনছো?
: ধুরউ; কী কও এইসব! বৃক্ষ নিজে উপযাচক হইয়া তোমার জন্য এ উপহার আমার হাতে তুইলা দিছে।
: মানে!
: এ এক লম্বা কাহিনী। বাচ্চাদের জন্য বই কেনার উদ্দেশ্যে ফুটপাত ধইরা মার্কেটে যাইতেছি; হঠাৎ কানের কাছে কে যেন ফিসফিস কইরা বইলা উঠল-
: লবণ বেগমের জন্য বসন্ত উপহার আছে; নিতে ভুল কইরো না।
কে কথা বলল, কে কথা বলল- দেখার জন্য ডাইনে-বাঁয়ে, উপরে-নিচে তালাশ করতেছি; এমন সময় টুপ কইরা মাথার উপর এই শিমূল ফুলটা গড়াইয়া পড়ল। বুঝতে পারলাম- একটু আগে শিমূলবৃক্ষই ফিসফিস কইরা আমার কানে কানে কথা বলতেছিল এবং এই ফুলটা যে তার পক্ষ থেইকা তোমাকে দেওয়া উপহার; এইটা বুঝতে আর বাকি রইল না।
পুষ্প-বৃত্তান্ত শুনে লবণ বেগম কুলকুল করে হাসল কিছুক্ষণ। হাসি থামার পর বলল-
: সবকিছু লইয়া গল্প না বানাইলে তোমার চলে না!
: বিলিভ মি; এইটা গল্প না। ঘটনাটা বাস্তবিকই ঘটছে।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর লবণ বেগমের জন্য কিনে আনা তার প্রিয় কবিতার বইটা ওর মাথার কাছে রেখে দিলাম। সকালবেলা ঘুম ভাঙার প্রিয় কবির লেখা কবিতার বই পেয়ে লবণ বেগম নিশ্চয়ই অভিভূত হবে। লবণ বেগমের অভিভূত হওয়ার দৃশ্যটি কল্পনা করতেই আমার দু’চোখ ভিজে গেল। প্রিয়জনের অভিভূত হওয়ার দৃশ্যের চেয়ে মধুর কোনো দৃশ্য এ জগতে আছে কি?
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
mokamia@hotmail.com
