স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের মালয়েশিয়া
মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ০৪ মে ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রায় সব মানুষই দেশে-বিদেশে বেড়াতে পছন্দ করে; কিন্তু এ অধম তা নয়। তাই বন্ধুরা প্রায়ই আমাকে বেরসিক ‘সম্বোধন’ করতে ভালোবাসে। বড় ভাইয়ের মেয়ে ঈশিতা মালয়েশিয়ার মালায়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে গেছে। তার আক্ষেপ মালয়েশিয়ায় সে কীভাবে থাকে, কোথায় থাকে ইত্যাদি আমি নিজ চোখে দেখতে যাইনি। তাই অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম সপরিবারে যাব এবং অবশ্যই সাত দিনের বেশি থাকব না। এ স্বল্প সময়কে পুঁজি করেই ঈশিতা ও তার স্বামী রাজিব গাড়ি চালিয়ে আমাকে যতটা সম্ভব ঘুরে দেখিয়েছে।
শব্দ ও বায়ুদূষণহীন একটি ছিমছাম শহর কুয়ালালামপুর। মানুষের চলাফেরা, কাজকর্ম সবকিছুতেই একটা স্বস্তির ছাপ। কেউ কাউকে মাড়িয়ে চলছে না, বরং মানিয়ে চলছে। প্রকৃতি প্রতিদিনই প্রায় এক-আধঘণ্টা বৃষ্টি দেয়; কিন্তু কোথাও একফোঁটা জল জমার কোনো সুযোগ সেদেশের সরকার রাখেনি। ত্রিশ-চল্লিশতলা আবাসিক দালান; কিন্তু হাওয়া চলাচলের কোনো অন্তরায় সৃষ্টি হয়নি। রাস্তাঘাট অনেকটাই প্রশস্ত। ছয় লেনের রাস্তার পরও দু’পাশে আরও দুই দুই চার লেন করার মতো জায়গা আছে।
আমরা রাস্তা প্রশস্ত করি চাপে পড়ার পর, সেখানে বিশ বছর পর কতটা রাস্তা প্রয়োজন হবে তা মাপজোক করা আছে। মালয়েশিয়ার অন্যতম পুরনো শহর মালাকা। ইউনেস্কোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে’ স্থান পাওয়া ৫০০ বছরের এ পুরনো শহরটি দেখে বিস্মিত হয়েছি। সাধারণত ‘হেরিটেজ’ হিসেবে বিবেচিত স্থানগুলোতে আধুনিক পরিকল্পনার উপস্থিতি দেখা যায় না; কিন্তু মালাকার আবাসিক হোটেলগুলো খেলনার মতো করে সাজানো। প্রতিটি রাস্তায় ৫-৬টি গাড়ি অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। সবকিছুতেই একটি পরিচ্ছন্ন পরিকল্পনার ছাপ।
আমাদের সরকারের উচ্চ মহলের অনেকেই বলে ফেলেন যে, আগামী ৫ বছরে বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া বানিয়ে ফেলবেন। আমার বিশ্বাস, যেহেতু কথা বলার ওপর কোনো ট্যাক্স নেই তাই বলা, বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭.৭ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ৪.৫। স্বল্প আয়ের দেশের তুলনায় উন্নত দেশের প্রবৃদ্ধির হার কমই হয়। ব্রিটেনের প্রবৃদ্ধি ১.৩ শতাংশ আর জাপানের জিডিপির প্রবৃদ্ধি আমাদের আট ভাগের একভাগ। তার মানে এই নয় যে, আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা জাপানের চেয়ে আটগুণ বেশি ভালো।
আমাদের মাথাপিছু আয় ১৭২০ মার্কিন ডলার আর মালয়েশিয়ার তা প্রায় ১২০০০ ডলার। প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের একটি প্রয়োজনীয় সূচক; কিন্তু একমাত্র সূচক ভাবা ঠিক নয়। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ডা. মহাথির মোহাম্মদ ১৯৯১ সালে ‘ভিশন ২০২০’র পরিকল্পনা নেন। সে বিষয়ে তিনি লিখছেন, ‘এ ভিশন পূরণ হলে ৩০ বছরের মধ্যে আমাদের দেশ উন্নত দেশের পর্যায়ে উন্নীত হবে। ওই সময়ে ১৯টি দেশ সম্পূর্ণ উন্নত দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। ওই দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্য, কানাডা, হল্যান্ড, সুইডেন ও জাপান ছিল।
আমরা কি তাদের পথ ধরে উন্নত দেশে উন্নীত হতে পারব না? তারা প্রত্যেকেই শক্তিশালী ছিল; কিন্তু তাদেরও দুর্বলতা ছিল। উন্নত দেশগুলোর অনেক কিছুই আমাদের পছন্দের নয়। এ ক্ষেত্রে তাদের চরম বস্তুবাদ এবং নৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলা যেতে পারে। আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও নৈতিকতার ভিত্তিতে আমরা মালয়েশিয়াকে উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই। আমাদের দেশকে সম্পূর্ণভাবে যত্নশীল ও পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার কথা আমরা বিশ্বাস করি’ (‘এ ডক্টর ইন দ্য হাউস’; পৃষ্ঠা : ১৫৭)।
তার মানে হল- তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন উন্নত দেশে পৌঁছানোর আর আমরা স্বপ্ন দেখছি মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার। মাহাথির মোহাম্মদ তার ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়েই ‘ভিশন ২০২০’র পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। আর আমরা পরিকল্পনা মুখে আনার সঙ্গে সঙ্গেই পহেলা বৈশাখকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছি। সুতরাং কথাবার্তা মুখের মাপে হলেই ভালো হয়।
ঈশিতা নিয়ে গেল তার বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব মালয়-এ। প্রথমে চারদিক ঘুরিয়ে দেখাল। পাহাড়কে পাহাড় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনাগুলো সাজানো-গোছানো। প্রতিটি আবাসিক হলের সঙ্গে পরিচ্ছন্ন ক্যান্টিন। শিক্ষার্থীরা খাচ্ছে, পড়ছে। অর্থনীতি বিভাগের অমায়িক অধ্যাপক ড. মেহেদীসহ কয়েকজনার সঙ্গে আলাপ হল। আমার মনে হয়েছে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই সংসারকে ধর্মজ্ঞান করি; কিন্তু তারা দেখলাম বিভাগকে ধর্মজ্ঞান করেন। ২৪ ঘণ্টা লাইব্রেরি খোলা।
কোনো কারণে যদি কোনো শিক্ষার্থীর ঘুম না আসে, বিনা বাধায় লাইব্রেরিতে গিয়ে কাজ করতে পারে। সবকিছু মুগ্ধ নয়নে দেখে গাড়ি করে ফেরার পথে আমাদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি আমার বিশেষ বন্ধু প্রফেসর ড. হারুন উর রশীদ আসকারীর কথা মনে হল। আসকারী একজন সততা-কল্পনাবিলাস মিশ্রিত মানুষ, অন্তত আমার ধারণা তা-ই। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করবেন।
আমি তার প্রত্যাশার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, সবকিছু বাদ দিলেও শুধু লজিস্টিক সাপোর্টের জন্য তাকে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করতে হবে। ২২ বছরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ৭০ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়ে আছে। কেবল ২০১২ সালে ইউজিসির অনুমোদন ব্যতিরেকে ১২৩ জন নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন দিতেই ২৬ কোটি টাকা দেনা হয়ে গেছে। এমন একটি দায়গ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর পক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করার ভাবনা কল্পনাবিলাস নয় কি?
বিখ্যাত সংগীত শিল্পী প্রয়াত ভূপেন হাজারিকার সুবিখ্যাত একটি গান, ‘আমি দেখেছি অনেক গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি, তার ছায়াতে দেখেছি অনেক গৃহহীন নর-নারী’। হাজারিকা তো ছায়ায় দেখেছেন আর আমি খোদ অট্টালিকার তলায় দেখলাম। মালয়েশিয়ার গর্ব ‘টুইন টাওয়ারের’ নিচের শপিংমলে ঘোরাঘুরি করছি। হঠাৎ ৮-৯ বছরের একটি মেয়ে হাত পেতে কিছু চাইল। আমার জামাই রাজিব তাকে ক’টা রিংগিত দিল। ওই একজনই আমার চোখে পড়েছে।
কিন্তু অবাক হলাম এত সমৃদ্ধ মালয়েশিয়া এই নিষ্পাপ শিশুটির কোনো আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারল না! নাকি খাদ ছাড়া গয়না হয় না!! কয়েকটা বড় বড় স্কয়ারেও দেখেছি দু-চারজন ভিক্ষা করছে। আমার ভালো লাগেনি। সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছি হানিফা নামক একটি শপিংমলে গিয়ে। আমার মেয়ে অর্পিতা রহমান তার বন্ধুদের জন্য চকোলেট কিনবে বলে সেখানে যেতে হয়। বেরিয়ে আসতেই দেখি হিজাব পরা এক ভদ্রমহিলা দু’হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্ল্যাকার্ডে লেখা- ‘আমি একজন অসহায় প্যালেস্টাইনি, আপনার সাহায্য চাই।’
ইসরাইলি সৈন্যদের কামান-ট্যাঙ্কের বিপরীতে কেবল পাথর ছুড়ে মোকাবেলা করার দৃশ্য টিভিতে দেখেছি। এতে প্যালেস্টাইনিদের শক্তির কমতি আমার চোখে পড়েছে; কিন্তু সাহস ও মর্যাদার কোনো কমতি তো চোখে পড়েনি! তবে কি ইয়াসির আরাফাতের সেই সাহসী-উজ্জ্বল চোখ আজ মলিন হতে চলেছে!
মালয়েশিয়ায় বৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ১০ লাখ। অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা ৭ লাখ অনুমান করা হয়। এই অবৈধ শ্রমিকদের দুর্দশার শেষ নেই। শুনলাম যখন মালয়েশিয়ান পুলিশ ‘রেইড’ দেয়, তখন তাদের অনেকে পাম-বাগানে দু’-তিন দিন পর্যন্ত লুকিয়ে থাকে। এই পাম-বাগানেই নাকি বিশ্বের বড় পাঁচটি অজগরের একটি বাস করে। কী ভয়ংকর ব্যাপার! বৈধ শ্রমিকদের গড় আয় মাসে ৩৬ হাজার বাংলাদেশি টাকা। অবৈধরা সেখানে ২০ হাজার টাকার বেশি পায় না। তারপর আবার বৈধ হওয়ার জন্য দালালদের হাতে টাকা দিতে হয়, ফল কিছু পাওয়া যায় না। এ দুর্দশার অবসান কবে হবে তা ‘খোদা মালুম’।
মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে বছরে রেমিটেন্স আসে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। মোট ১২০০০ মিলিয়ন ডলারের যে রেমিটেন্স তা থেকে যদি মধ্যপ্রাচ্য বাদ দিই তাহলে আমেরিকার পরেই মালয়েশিয়ার স্থান। আমাদের শ্রমিকদের সম্পর্কে তাদের ধারণাও ভালো। মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় রিক্রুটিং এজেন্সির একজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানলাম আমাদের দেশের শ্রমিকরা খুব একটা ছুটি নেয় না। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার শ্রমিকরা ৬ মাস যেতে না যেতেই দেশে যেতে চায়।
সেদিক থেকে আমাদের শ্রমিকদের কদর আছে। থাকলে কী হবে, সেখানে এখন আইনগতভাবে আমাদের শ্রমিক নেয়া বন্ধ এবং এ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার দু-চারজন প্রভাবশালী। একজন শ্রমিকের পারমিট পেতে মালয়েশিয়ার সরকারকে দিতে হয় প্রায় ৫৬ হাজার টাকা। প্লেন ভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে ৮০ হাজার টাকা পড়ে। কোনো রিক্রুটিং এজেন্ট যদি জনপ্রতি ২০ হাজার টাকাও লাভ করে, তাহলে একজন শ্রমিকের মালয়েশিয়ায় যেতে ১ লাখ টাকার বেশি লাগার কথা নয়।
কিন্তু এজেন্সি থেকে এজেন্সি ঘুরে, হাত থেকে হাত ঘুরে মালয়েশিয়ায় যেতে প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা লেগে যায়। সুতরাং সর্বস্ব বন্ধক রেখে আমাদের শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় যেতে হয়। এই দেনার দায় আছে বলেই তো দেশে ছুটি কাটানোর কথা ভাবতেই পারে না তারা। এ চারগুণ বেশি টাকা আদায় করার কারণে মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন।
মাত্র দু’-চারজন মানুষকে হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার সুযোগ দিতে গিয়ে লাখ লাখ শ্রমিককে তাদের ন্যায্য কাজ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। শুনেছি এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে কথাবার্তা চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছরের শেষদিকে আবারও মালয়েশিয়ায় লোক যেতে পারবে। আশা করি, সরকার বিবষয়টিকে ‘অতীব গুরুত্বপূর্ণ’র তালিকায় রাখবে।
সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
