ভাষা আন্দোলনের আরেক অধ্যায়
এ কে এম শামসুদ্দিন
প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমরা গর্ব করে বলতেই পারি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতির মধ্যে আমরাই একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সালাম, রফিক, বরকত বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেদিনের সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। পৃথিবীর আর কোনো জাতি তাদের মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য এভাবে অকাতরে প্রাণদান করেছে বলে আমাদের জানা নেই। ২১ ফেব্রুয়ারি তাই স্বীকৃতি লাভ করে ভাষা দিবস বা শহীদ দিবস হিসেবে। পরবর্তী সময়ে নজিরবিহীন সেই ঘটনার এ দিবসটিকে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বুকে তরুণ তাজা প্রাণের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের কথা জানা থাকলেও ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসামের বরাক উপত্যকায় তৎকালীন অবিভক্ত কাছাড় জেলার শিলচরে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য যে ১১ তরুণ বাঙালি আত্মাহুতি দিয়েছিল সে ঘটনার কথা আমাদের অনেকের হয়তো জানা নেই। বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সেই লড়াইয়ে পুরুষের পাশাপাশি একজন নারীও সেদিন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তার নাম কমলা ভট্টাচার্য। ১৬ বছর বয়সী এ তরুণীই হল সমগ্র বাঙালি নারী সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী পৃথিবীর সর্বপ্রথম শহীদ নারী ভাষাসৈনিক। সেদিনের সেই সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, সর্বোপরি ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে অর্জিত হয়েছিল বরাক উপত্যকার তিনটি জেলায় সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি।
বরাক উপত্যকা আসামের বরাক নদীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। ভারত বিভক্তির আগে বৃহত্তর কাছাড় জেলা নিয়ে বরাক উপত্যকা গঠিত। বর্তমানে কাছাড় জেলাকে বিভক্ত করে তিনটি প্রশাসনিক জেলায় রূপান্তর করা হয়েছে। এগুলো হল কাছাড়, করিমগঞ্জ এবং হাইলা কান্দি জেলা, যা বাংলাদেশের সিলেট জেলাসংলগ্ন আসামের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত। তৎকালে বরাক উপত্যকায় প্রায় চল্লিশ লক্ষাধিক নাগরিকের বসবাস ছিল, যার মধ্যে আশি শতাংশই ছিল বাঙালি। এছাড়া আসামের অন্যান্য অঞ্চলেও বাঙালিদের ব্যাপক বসবাস ছিল। উল্লেখ্য, আসামে অন্য সব জাতিগোষ্ঠী, বিশেষ করে অসমিয়াদের তুলনায় ঐতিহাসিকভাবে শিক্ষা, ভাষা, সংস্কৃতি কিংবা আর্থসামাজিক বিচারে বাঙালিরা ছিল অগ্রসরমান। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের নীলনকশার অংশ হিসেবে বাংলা ভাষাভাষী জনগণের ওপর ‘অসমিয়া জাতীয়তাবাদী’ ধ্যান-ধারণাকে চাপিয়ে দেয়ার বীজ রোপণ করে এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকেই বাঙালিদের বিরুদ্ধে অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগরিকদের উসকে দেয়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরও সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অসমিয়া নাগরিকদের ভেতর এমন মানসিক দুর্ভাবনা ও আশঙ্কা ভর করে যে, অগ্রসরমান বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতি হয়তো একদিন অসমিয়া যুবকদের শুধু কর্মসংস্থান দখলই নয়, পাশাপাশি তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবে। এ ধরনের মানসিক ভীতি থেকে আসামের রাজনৈতিক শাসকরা ১৯৪৭ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বাঙালি ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। এসময় তারা অসমিয়াদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিভিন্ন সময়ে একাধিক ভাষা-নীতিমালা প্রণয়ন করে। এরই ধারাবাহিকতায় অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে Assam (official) Language Act (ALA-1960) নামে একটি অ্যাক্ট আসাম প্রাদেশিক পরিষদে পাস করিয়ে নেয়।
বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে, যখন ‘আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি’ ঘোষণা করে যে, অসমিয়া ভাষা হবে আসাম প্রদেশের একমাত্র সরকারি ভাষা। এ ঘোষণায় বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ভেতর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। তারা তীব্রভাবে এর প্রতিবাদ করে। অসন্তোষ দেখা দেয় চারদিকে। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো এ অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে বাঙালি অধ্যুষিত কাছাড়, করিমগঞ্জ এবং হাইলা কান্দি জেলায়। বাঙালিরা সংগঠিত হতে থাকে সম্মিলিত আন্দোলনের জন্য। জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে এ উত্তেজনা-পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে যখন, অসমিয়া জনগোষ্ঠী আসামের উত্তরে অবস্থিত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কামরূপ জেলায় ‘বাঙাল খেদাও’-এর নামে বাঙালিদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা চালানো হয়। এ আক্রমণের শিকার হয়ে আনুমানিক পঞ্চাশ হাজার বাঙালি পশ্চিমবঙ্গে এবং নব্বই হাজার বাঙালি বরাক উপত্যকা ও আসামের উত্তরপূর্ব রিজিয়নে আশ্রয় গ্রহণ করে।
এ ঘটনার পর বিচারপতি গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে একটি একক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। ওই কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, অসমিয়ারা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কামরূপ জেলায় বাঙালি অধ্যুষিত প্রায় পঁচিশটি গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে আনুমানিক ৪ হাজার ৭৭ ঘরবাড়িতে লুটপাট ও ধ্বংস করে। এছাড়াও ৯ জন বাঙালিকে হত্যা এবং সহস্রাধিক বাঙালিকে মারাত্মকভাবে আহত করে।
অতঃপর ১০ অক্টোবর ১৯৬০ সালে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা আসাম প্রাদেশিক পরিষদে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র দাফতরিক ভাষা হিসেবে আইন পাস করার জন্য একটি বিল উত্থাপন করেন। বিলটি উত্থাপিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে আসামের করিমগঞ্জ (উত্তর) থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের অন্যতম সদস্য রণেন্দ্র মোহন দাস তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, ‘দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগণের ভাষাকে উপেক্ষা করে এক-তৃতীয়াংশ জনগণের অসমিয়া ভাষাকে এ অঞ্চলের দাফতরিক ভাষা হিসেবে আইন পাস করা চলবে না’। এরপরও ২৪ অক্টোবর ১৯৬০ সালে প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক আনীত বিলটি পাস হয়ে যায়।
১৯৬১ সালের প্রথম ভাগে বাংলা ভাষা আন্দোলন আবারও দানা বাঁধতে শুরু করে। এসময় আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বাংলা ভাষা রক্ষা সমিতি সংগঠিত হয়। এদের মধ্যে ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি’, ‘ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’ অন্যতম। এসব সংগঠন আসাম প্রাদেশিক পরিষদ কর্তৃক গৃহীত Assam (official) Language Act (ALA-1960) বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এমনকি জেলা কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক সংগঠিত ভাষা আন্দোলন সমিতিও এ প্রতিবাদে শামিল হয়। এছাড়াও সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা, সুধীসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল ভাষা আন্দোলনে যোগ দেয়। প্রথমদিকে এ আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে সভা, মিছিল, সত্যাগ্রহ, পদযাত্রা, হরতাল এবং অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। চলমান আন্দোলনকে বেগবান এবং সাধারণ মানুষের ভেতর বাংলা ভাষার দাবিকে আরও জোরালো করার লক্ষ্যে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ২৪ এপ্রিল ১৯৬১ সালে সমগ্র বরাক উপত্যকায় ‘পক্ষকালব্যাপী পদযাত্রা’র কর্মসূচি শুরু করে। এ পদযাত্রায় ব্যাপক মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচর থেকে শুরু করে উপত্যকার বিভিন্ন শহর ও শহরতলি এবং গ্রাম অঞ্চল ঘুরে আনুমানিক ২০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ২ মে আবার শিলচরে এসে শেষ হয়।
পদযাত্রার এ কর্মসূচিতে সব বরাক উপত্যকায় ব্যাপক গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়। পদযাত্রা শেষে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন, ১৩ মে’র মধ্যে যদি বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা না হয়, তাহলে ১৯ মে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করা হবে। একইসঙ্গে তিনি অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকেও যথাযথ স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জোর দাবি জানান। আসাম প্রাদেশিক সরকার তাদের এ ঘোষণায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে ১৮ মে গণসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি রথীন্দ্রনাথ সেনসহ ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নলিনীকান্ত দাস ও বিধুভূষণ চৌধুরীর মতো বিশিষ্ট নেতা ও প্রথিতযশা সম্পাদককে গ্রেফতার করে।
এদিকে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ১৯ মে হরতাল শুরু হলে উত্তেজিত জনতা খুব ভোর থেকেই কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলা কান্দি জেলায় সরকারি অফিস, আদালত ও রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান গ্রহণ করে। অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে এ গণজোয়ার দেখে প্রাদেশিক সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলা শহরগুলোতে আধাসামরিক বাহিনী ও পুলিশের টহল নামায়। সকাল থেকে হরতালের কর্মসূচি কোনো ধরনের অঘটন ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছিল; কিন্তু দুপুরের পর থেকে আসাম রাইফেলস ও পুলিশ অবস্থান ধর্মঘট পালনকারীদের গ্রেফতার শুরু করলে চারদিকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিস্থিতি ক্রমেই জঙ্গিরূপ ধারণ করতে থাকে। বেলা আনুমানিক ২টা ৩০ মিনিটের সময় পুলিশের একটি দল ট্রাকে করে ৯ ধর্মঘট পালনকারী বাঙালিকে কাঠিগড়া থেকে গ্রেফতার করে শিলচরের তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানকারী উত্তেজিত বাঙালিরা ট্রাকটিকে থামিয়ে দিয়ে ঘেরাও করে ফেলে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পুলিশের সদস্যরা দ্রুত ট্রাক ছেড়ে চলে যায়। পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে গেলে উত্তেজিত জনতা ট্রাকটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ রকম পরিস্থিতিতে তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে প্রহরারত আধাসামরিক বাহিনীর একদল সদস্য জনতার ওপর চড়াও হয় এবং বেদম লাঠিচার্জ শুরু করে। এতে উত্তেজনা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। অতঃপর কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে রাইফেলের গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এতে কমলা ভট্টাচার্যসহ ১২ বাঙালি তরুণ একের পর এক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ ১২ জনের মধ্যে ৯ জন ঘটনার দিন এবং পরবর্তী সময়ে আরও দু’জন তরুণ তাজা প্রাণ মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঘটনার দিন যে ৯ জন শহীদ হন তারা হলেন :
কানাই লাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। ঘটনার দু’দিন পর অর্থাৎ ২১ মে যে দু’জন শহীদ হন তারা হলেন : বীরেন্দ্র সূত্রধর এবং সত্যেন্দ্র দেব।
উল্লেখিত ১১ শাহাদতবরণকারীদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন একমাত্র নারী ভাষাসৈনিক। তিনি ১৯৪৫ সালে জন্মুগ্রহণ করেন। পিতা রামরামান ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবীর ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে পঞ্চম সন্তান কমলা। কমলা ভট্টাচার্যদের আদি নিবাস বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫০ সালে কমলা ও তার পারিবারের অন্যান্য সদস্য বাংলাদেশ ছেড়ে আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে চলে যায় এবং শিলচর পাবলিক স্কুল রোডে বসবাস শুরু করেন। কমলা শিলচরের চোতিলাল সেন ইন্সটিটিউটের ছাত্রী ছিলেন। ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ১৮ মে ১৯৬১ সালে তার মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়। চলমান ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে কমলা বরাবরই সচেতন ছিলেন। এ কারণে তিনি মেট্রিক পরীক্ষার পর আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন বলে মনস্থির করেন। ১৯ মে হরতাল শুরু হলে শিলচরের তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান ধর্মঘটে অংশগ্রহণের জন্য সেদিন সকালে যখন তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তার বড় বোন প্রতিভা সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে তাকে ধর্মঘটে যেতে নিষেধ করেন। এরপরও এ মহীয়সী সাহসী নারী তার বড় বোনের নিষেধ উপেক্ষা করে আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য বেরিয়ে পড়েন। কমলার মা সুপ্রবাসিনী দেবী কমলার এ সংগ্রামী চেতনায় খুশি হন এবং ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি পুলিশের টিয়ার গ্যাস থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য এক টুকরো কাপড় কমলাকে ধরিয়ে দেন। কমলার সঙ্গে কমলার ছোট বোন মঙ্গলাও বেরিয়ে পড়ে ধর্মঘটে অংশগ্রহণের জন্য। অবস্থান ধর্মঘটকালে আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা যখন লাঠিচার্জ শুরু করে, তখন মঙ্গলা সেই লাঠির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যান এবং সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকেন। ততক্ষণে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে কমলা তার বোনের সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে গেলে একটি বুলেট তার চক্ষু ভেদ করে মাথায় আঘাত করে এবং মুহূর্তে কমলা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এভাবেই বাঙালির প্রথম নারী ভাষাসৈনিক মাতৃভাষা বাংলার জন্য আত্মাহুতি দেন। ভাষার জন্য কমলা ভট্টাচার্যের সেদিনের সেই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ সমগ্র বাঙালি নারী সমাজকে করেছে মহিমান্বিত।
১৯৬১ সালের ১৯ মে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারা ভারতব্যাপী অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলনের দাবির পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। এ রকম পরিস্থিতিতে দিল্লির কেন্দ্রীয় কংগ্রেস লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে চলমান সংকট উত্তরণে উপায় উদ্ভাবনের জন্য দায়িত্ব প্রদান করে। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী নিম্নলিখিতভাবে Assam (official) Language Act (ALA-1960) সংশোধনের প্রস্তাব করেন : ১. যার যার অঞ্চলে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে সরকারি ভাষা পুনর্নির্ধারণের ক্ষমতা আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত করা। ২. বৃহত্তর কাছাড় জেলা, পার্বত্য অঞ্চল ও প্রাদেশিক রাজধানীর সঙ্গে সরকারি পত্রালাপ বা যোগাযোগের মাধ্যম হবে ইংরেজি। ৩. প্রাদেশিক পর্যায়ে সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়া ভাষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষা চালু থাকবে এবং ৪. ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রচলিত ভাষা রক্ষার্থে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলা ভাষা আন্দোলনের নেতারা লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর এ প্রস্তাবে প্রাথমিক পর্যায়ে বিরোধিতা করলেও পরবর্তী সময়ে কিছুটা নমনীয় ও সতর্ক সাড়া দেন। অবশেষে আসাম প্রাদেশিক সরকার লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর প্রস্তাবের সূত্র ধরে ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে Assam (official) Language Act (ALA-1960) সংশোধন করে বাংলাকে কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলা কান্দি জেলায় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের ঘটনা পর্যালোচনা করলে ১৯৫২ সালের বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, আন্দোলনের কৌশল এবং আন্দোলন-উত্তর বাংলা ভাষার স্বীকৃতি অনেকটা একই ধারায় পরিচালিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এটা বলা যায়, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, আন্দোলনের রণকৌশল, এমনকি ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ঘটনা পথপ্রদর্শক হিসেবে নিঃসন্দেহে আসামের আন্দোলকারীদের জুগিয়েছে সাহস এবং সেখানকার বাঙালিরা ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং তারই পথ ধরে বাংলা ভাষাকে করেছে প্রতিষ্ঠা।
এ কথা গর্ব করেই বলা যায়, বাঙালি হল এমন এক জাতি, যারা মাতৃভাষা রক্ষার্থে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অথচ বরাক উপত্যকার সেই ভাষা আন্দোলনের কথা কতটুকু আমরা জানি? আমাদের এখানে ১৯৬১-এর সেই ভাষা আন্দোলনের ওপর খুব কমই আলোচনা হয়েছে।
এমন একটি মহান ঘটনা স্মরণ করা এবং ভাষাসৈনিকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। আমাদের এখানে শুধু ২১ ফেব্রুয়ারির দিনটিকে ঘিরে বাংলা ভাষার চর্চা বা আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। সারা বছর এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ বা ভাষাভিত্তিক কর্মকাণ্ড খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না। এ রকম কর্মকাণ্ড সারা বছর চলতে বাধা কোথায়? ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ‘শহীদ দিবসে’ও আমরা তাদের সেই মহান আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করতে পারি। বাঙালি হিসেবে সেটাই হবে তাদের পবিত্র আত্মার প্রতি আমাদের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করা।
এ কে এম শামসুদ্দিন : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত)
