Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কিছুমিছু

আদম ব্যবসা অনেক বেশি লাভজনক

Icon

মোকাম্মেল হোসেন

প্রকাশ: ১৯ মে ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আদম ব্যবসা অনেক বেশি লাভজনক

মন ভালো করার চেষ্টা করছে এবাদুল। লাভ হচ্ছে না; মন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। টেলিভিশনের সুইচ-অন করল সে। রিমোট টিপতে টিপতে ওড়াধুড়া টাইপের হিন্দি নাচ-গান হয়, এমন একটা চ্যানেলে এসে থামল। দেখা যাক, ওড়াধুড়ায় মন ভালো হয় কিনা। টেলিভিশনের পর্দায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হাল ছেড়ে দিল এবাদুল। উহুঁ! কাজ হচ্ছে না; নাচ-গান ছাপিয়ে চোখের সামনে কেবল শরীফার বেলমুখ ভেসে উঠছে।

এবাদুলের মনে হল, মনের মধ্যে রাগ পুষে রেখে বাসা থেকে বের হওয়া ঠিক হয়নি। ঘটনার সময়ই শরীফার গালে জোরে একটা থাপ্পড় দেয়া উচিত ছিল। তাহলে সাপের বিষ ঢালার মতো রাগটা সেখানেই পড়ে যেত। ভুল হয়েছে; মস্তবড় ভুল। ভুল সংশোধনের জন্য এখন বাসায় গেলে কেমন হয়? বাসায় গিয়ে কোনো সংলাপ বিনিময় না করে জাস্ট রোবোটিক স্টাইলে শরীফার গালে ঠাস করে একটা চড় দিয়ে চলে আসা যায়। ভাবনাটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেল কিছুক্ষণ। পরে এটাকে বাতিল করে দিল এবাদুল। লাভ নেই; মারপিট করে কারও বেসিক পয়েন্টের উন্নয়ন ঘটানো যায় না। নারীজাতির মূল সমস্যা হচ্ছে, বেসিক পয়েন্টে গলদ। বেসিক পয়েন্টে গলদ না থাকলে শরীফা তাকে এ ধরনের কথা বলতে পারত না।

ঈদের কেনাকাটা করবে কয়েকদিন ধরেই টাকার জন্য ঘ্যানঘ্যান করছিল শরীফা। আজ সকালেও একই সুরে বেহালা বাজাচ্ছিল সে। এক-দুই টাকা না; অনেক টাকা। পকেট কামানের নলের মতো ফাঁকা না থাকলে প্রথমদিন চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দিত এবাদুল। ঘ্যানর-ঘ্যান সুরে বেহালা বাজানোর প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু না থাকলে দেবে কোত্থকে? টাকা-পয়সা গাছের পাতা নয়- গাছে উঠলাম, খানিকক্ষণ বাদে পাতাভরা বস্তা নিয়ে গাছ থেকে নেমে এলাম। অনেকক্ষণ ধরে এ জিনিসটাই শরীফাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল এবাদুল। শরীফা বোঝাবুঝির ধারেকাছেও গেল না। ঘাড় বাঁকিয়ে ফোঁসফোঁস করতে করতে স্বামীর উদ্দেশে বলল-

: টাকা থাকবে না কেন?

এ প্রশ্নের উত্তর একেক মানুষের ক্ষেত্রে একেক রকম হবে। এবাদুলের উত্তর হচ্ছে- কিছুদিন যাবত তার ব্যবসা বসে পড়েছে। বসে পড়েছে না বলে বলা উচিত, শুয়ে পড়েছে। অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতালের ব্যবসা নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ এলাকায় কোমরে গামছা বেঁধে অভিযান শুরু করেছে। এবাদুলের ক্লিনিকে যে ক’জন রোগী ছিল- সবাইকে রাতারাতি বিদায় করে সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ক্লিনিকে কোনো রোগী পাওয়া যাবে না। রোগী না এলে এবাদুলকে এমনি এমনি কেউ টাকা দেবে? অত্যন্ত সহজ ভাষায় এ বিষয়টিই উপস্থাপন করেছে এবাদুল। শরীফার চেহারা দেখে মনে হয়েছিল, বিষয়টা সে উপলব্ধি করতে পেরেছে। কিসের মধ্যে কী- পান্তার মধ্যে ঘি! শরীফা বেমক্কা বলে বসল-

: মাছের ব্যবসা ছাইড়া এই কুকামের মধ্যে তোমারে যাইতে বলছে কে?

একেই বলে, সাতখণ্ড রামায়ণ পইড়া সীতা কার আব্বা? আরে বেক্কল! মাছের ব্যবসা আর ক্লিনিকের ব্যবসা কি এক হল? এ কথা সত্য, ৩০ টাকার মাছ ৯০ টাকায় বেচাবিক্রির কারবারে নগদ টাকা-পয়সার আমদানি ছিল প্রচুর। ক্লিনিকের ব্যবসায়েও এরকম ছক্কা মারার সুযোগ আছে। এজন্য ধৈর্যশীল হতে হবে। উতলা হলে চলবে না। ব্যবসাটা একবার জমে উঠুক, তারপর এবাদুল দেখিয়ে দেবে কোনটা ভালো- মাছের ব্যবসা, না ক্লিনিকের ব্যবসা? তবে লাভের চেয়েও বড় হচ্ছে মান-মর্যাদার বিষয়। মাছবাজারে জলচৌকির ওপর বসে মাছ বিক্রি করা আর এসি রুমে ক্লিনিকের এমডি সেজে স্যুট-টাই, চশমা লাগিয়ে ঠ্যাং নাচানো কি এক জিনিস হল? আরে বেকুব- মানুষ আগে তোমারে বলত মাছওয়ালার বউ। এখন বলবে এমডি ভাবি। এ সম্মান লাখ টাকা দিয়ে কিনতে পারবা তুমি? এসব বিষয় মাথায় না ঢুকিয়ে এবাদুলকে আগের জীবনে ফিরে যেতে বলার অর্থ একটাই- শরীফার বেসিক পয়েন্টে গলদ আছে। গলদ না থাকলে এমন চিন্তা কেউ করতে পারে? শরীফার কথা শুনে এবাদুলের মেজাজ এতটাই খারাপ হয়েছিল, সে দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে গাল ফুলিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছিল। এখানেই বোকামি হয়েছে। ‘ধর মুরগি-কর জবাইয়ে’র মতো রাগটাকে অ্যাট দ্য মোমেন্ট ঝেড়ে ফেলা উচিত ছিল। তাহলে এখন মাথার মধ্যে যন্ত্রণার কিড়মিড়ানি সহ্য করতে হতো না। নাস্তা করা দরকার। এবাদুল পাশের হোটেলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াতেই বুয়া এসে সামনে দাঁড়াল। বলল-

: পাওনা পরিশোধ কইরা আমারে রিলিজ কইরা দেন।

আরে! সবাই কি উন্মাদ হয়ে গেল নাকি! শুধু টাকা-টাকা করছে কেন? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরুর পর সুরক্ষা জাল কিনতে পার্শ্ববর্তী থানায় গিয়েছিল এবাদুল। থানার লোকজন তার কাছে যে পরিমাণ টাকা দাবি করল- শুনে এবাদুলের মাথার মগজ পাতলা হওয়ার জোগাড়। এত টাকা-পয়সা তার কাছে নেই। থাকলে ডাক্তার পোষার ব্যবসা না করে হুণ্ডির ব্যবসা শুরু করত। কপাল কুঁচকে বুয়ার কাছে এবাদুল জানতে চাইল-

: কী হইছে! হঠাৎ রিলিজ হইতে চাও কেন?

: আতঙ্ক লইয়া কাজকাম করতে ভালা লাগে না।

: আতঙ্ক পাইলা কই? সাইনবোর্ড নামাইয়া ফেলার পর এইটা আর অবৈধ কোনো ক্লিনিক নাই; বাসাবাড়ি হইয়া গেছে।

: বাসা হোক আর বাগান হোক, আমি এইখানে চাকরি করমু না। আমারে বিদায় করেন।

: বিদায় হইয়া কই যাবা?

: নিয়ত করছি, বিদেশ যামু।

: বিদেশে যাবা? বিদেশে যাইয়া তুমি কী করবা?

: যাই করি; তাতে আপনের কোনো সমস্যা?

: না, আমার কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু বিদেশ যাইতে তো অনেক টাকা লাগে। অত টাকা তুমি পাবা কই?

: টাকা কই পামু, এইটা আপনে জাইন্যা কী করবেন? প্রয়োজন হইলে কিডনি বিক্রি করমু।

: কিডনি বিক্রি কইরা হইলেও বিদেশে যাওনই লাগব?

: হ। অল্প দামের চাকরি অনেক করছি; আর করবার চাই না।

: বেশি দামের চাকরি করার আশায় নৌকায় চইড়া ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওনকালে ৫৭ জন ডুইব্যা মরছে।

: আমি নৌকায় চইড়া বিদেশ যামু না; টেকা বেশি লাগলেও উড়াজাহাজে চইড়া যামু।

বুয়ার কথা শুনে এবাদুল গলা ছেড়ে হাসল কিছুক্ষণ। তারপর বলল-

: বেশ! উড়োজাহাজে চইড়াই যাইও। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার পর অনেক মা-বোন বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হইয়া দেশে ফিইরা আসতে বাধ্য হইতেছে। কেউ কেউ মারাও যাইতেছে। কী দরকার, এই বয়সে রিস্কের মধ্যে যাওয়ার?

এবাদুলের কথা শুনে বুয়া চোখমুখ অন্ধকার করে বলল-

: আপনের কী মনে করেন, আমার বয়স বেশি হইয়া গেছে?

এবাদুল দেখল, ঘটনা খারাপ। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল-

: না, না; তোমার বয়স ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নাই।

হোটেলে খেতে বসে বুয়ার বিষয়টা নিয়ে নড়াচড়া করতে করতে এবাদুলের মনে মনে নতুন একটা আইডিয়া ঝিলিক মারল। আক্কাস নামে একজন ক্লিনিকের ব্যবসায়ে দালাল হিসেবে কাজ করত। আক্কাসকে ফোন করে এবাদুল বলল-

: আক্কা, একটা কাজ কইরা দিতে পারবা?

: কী কাজ, বস?

: নতুন একটা সাইনবোর্ড তৈরি কইরা দিতে পারবা?

: কিসের সাইনবোর্ড?

: আদম ব্যবসার।

: আদম ব্যবসা শুরু করবেন?

: হুঁ। চিন্তা কইরা দেখলাম, আদম ব্যবসা অনেক লাভজনক। বাঙালির কানে বিদেশে যাওয়ার মন্ত্র একবার দিতে পারলেই কারবার ফিট। তারা ডাইনে-বাইয়ে না তাকাইয়া পয়সাকড়ি ভাঁজ কইরা হাতে তুইলা দিয়া যাবে। দুই নম্বরি কারবার যখন করবই, তখন ভালোমতোই করা উচিত।

: জি বস! আমি আপনের লগে সম্পূর্ণ একমত।

: তাইলে সময় নষ্ট না কইরা সাইনবোর্ডের অর্ডার দিয়া দেও।

: আইচ্ছা।

নাস্তা খেয়ে ফিরে আসার পর এবাদুল দেখল, বুয়া ফোনে কথা বলছে। কথা শেষ হওয়ার পর এবাদুল জানতে চাইল-

: বিউটি বানু! এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলতেছিলা?

: এক আদম বেপারির লগে।

: কী বলল সে?

: এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা-পয়সা জোগাড় করতে বলছে।

: ওই ব্যাটার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো প্রয়োজন নাই।

: ক্যান?

এবাদুল ঠোঁটের কোণায় সূক্ষ্ম হাসির জন্ম দিয়ে বলল-

: আইজ থেইকা আমি আদম বেপারি আর তুমি হইলা আমার প্রথম কাস্টমার...

মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

mokamia@hotmail.com

 

কিছুমিছু রামায়ণ আদম ব্যবসা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম