ওষুধ যখন মৃত্যুর কারণ
মুনীরউদ্দিন আহমদ
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সূত্রমতে, শুধু ১৯৭৮ সালে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৫ লাখ রোগী সুস্থ হওয়ার জন্য ওষুধ খেয়ে মৃত্যুবরণ করে। এতে আরও দেখা যায়, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩০ শতাংশ রোগী ওষুধ খেয়ে আরও বেশি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ওষুধের কারণে ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এসব মৃত্যুর কারণ প্রেসক্রিপশন ড্রাগ বলে জানা যায়। উল্লিখিত মৃত্যুর সংখ্যা বাদ দিয়েও বলা যায়, ওষুধের কারণে এমন লাখ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা মৃত্যুবরণ করছে- যার কোনো হিসাব রাখা হয় না। ১৯৬১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত নিরাপদ হিসেবে আখ্যায়িত করে সারা বিশ্বে ২ লাখ ৫ হাজারের বেশি ওষুধ বাজারজাত করা হয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার নতুন ওষুধ বাজারে ছাড়া হয় এবং ১২ হাজার আবার বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯৩ সালে চিকিৎসা ব্যয় বাবদ ৯১২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়। চিকিৎসাসেবার ধরন, মান ও টাকার অঙ্ক হিসাব করলে যে কারও ধারণা হতে পারে যে, আমেরিকানরা বিশ্বের সবচেয়ে সুস্থ জাতি। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। মহিলাদের আয়ুষ্কালের দিক থেকে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান ১৬ এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৭। শিশুমৃত্যুর দিক থেকে এ দেশটির অবস্থান আরও নিচে, স্থান ২১।
ওষুধের কারণে কেন মানুষ এত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বা মৃত্যুবরণ করছে তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা প্রচণ্ড ভাবনাচিন্তায় পড়ে গেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ওষুধের কারণে মৃত্যু বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পেছনে কাজ করছে চিকিৎসক ও রোগী কর্তৃক ভুল ওষুধ প্রয়োগ বা গ্রহণ। প্রশ্ন হল, এসব ক্ষতিকর ওষুধ কীভাবে বাজারে চলে আসে বা বাজারে আসার অনুমতি লাভ করে। আমাদের মনে রাখা দরকার, বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভুয়া ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, ভুয়া বিজ্ঞাপন, অনিরাপদ উৎপাদন পদ্ধতি, কালোবাজারি এবং ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে নিরাপত্তাজনিত আইন-কানুনকে অবজ্ঞা অবহেলা করে ওষুধ উৎপাদন বা বাজারজাত করার সুযোগ করে নেয়। সবচেয়ে ভয়ংকর হল- ওষুধের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অত্যাবশ্যকীয় ও বাধ্যতামূলক, তা তারা ঢিলেঢালাভাবে করে বা দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে তারা এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। ওষুধ কোম্পানিগুলো অতি সহজে দুর্নীতিবাজ গবেষকদের আর্থিক সহয়তা প্রদানের মাধ্যমে ওষুধের কাঙ্ক্ষিত গুণাবলি উল্লেখ করে গবেষণা প্রবন্ধ লিখতে উদ্বুব্ধ করে। ওষুধের ওপর এ ধরনের গবেষণার মাধ্যমে কোনো কোনো গবেষক প্রতিবছর মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উপার্জন করেন। গবেষকরা ভালো করেই জানেন, তারা যদি ওষুধ কোম্পানির কথামতো কাজ না করেন, তবে ভবিষ্যতে তাদের অর্থ উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এই ধরনের গবেষণার কাজে অত্যন্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয় বলে বাইরের কেউ এসব অনৈতিক ও ভুয়া বা অপর্যাপ্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কথা জানতে পারে না। এ ছাড়া আরও সমস্যা আছে। গবেষকরা প্রায়ই এসব ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এত কম সংখ্যক রোগী নিয়ে গবেষণা করে থাকেন যে, পরীক্ষায় নকল ওষুধ সেবনকারীদের শরীরে কার্যকারিতার দিক থেকে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। অসমাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সময় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো প্রকাশ পায় না। অনেক সময় প্রকাশ পেলেও তা গোপন করা হয়। ওষুধ বাজারজাত হওয়ার পর রোগী তা গ্রহণ করলেই শুধু ওষুধের খারাপ প্রভাবগুলো প্রকাশ পায়।
ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে মানবদেহের পরিবর্তে জীবজন্তু ব্যবহার করা হয়। জীবজন্তুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও বিভিন্ন সিস্টেমের সঙ্গে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও কার্যাবলি, অধিকাংশ মেটাবলিক ক্রিয়া-কর্মের সাদৃশ্য রয়েছে বলে প্রাথমিক পর্বের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো জীবজন্তুর ওপরই চালানো হয়। মনে রাখা দরকার, এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সুস্থ স্বাভাবিক জীবজন্তু ব্যবহার করা হয় না। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবজন্তুকে কৃত্রিম উপায়ে অসুস্থ করে তোলা হয় ওষুধ প্রয়োগের আগে। সমস্যা হল- কৃত্রিম উপায়ে জীবদেহে রোগ তৈরি করে তাতে ওষুধ পরীক্ষা করা হলে তা মানবদেহে প্রাকৃতিক, লাইফস্টাইল বা খাদ্যাভ্যাসের কারণে সৃষ্ট রোগে ব্যবহৃত ওষুধের সমতুল্য কার্যকরী নাও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই মানবদেহে সৃষ্ট রোগ জীবদেহে তৈরি বা নকল করা একেবারেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেমন, অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কথাই ধরা যাক। একে বাংলায় বলা হয় গিঁটে বাত। এটি একটি ক্ষয়িষ্ণু রোগ যা জয়েন্ট বা গিঁটে হাড়ের ক্ষয় বা বিকৃতির কারণে স্থানচ্যুত হয় বলে নড়াচড়ার সময় প্রচণ্ড ব্যথা হয়। গবেষণার সময় এ রোগটি অবিকল নকল বা সৃষ্টি করে ওষুধের পরীক্ষা চালানো সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। অস্টিওআর্থ্রাইটিস মানবদেহে প্রাকৃতিক নিয়মেই উৎপন্ন হয়। ওষুধের পরীক্ষা চালানোর জন্য অবিকল এরকম একটি রোগ সৃষ্টি করতে জীবদেহে নানারকম অসঙ্গতিপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করতে হয়। হাতুড়ি দিয়ে গিঁটে পিটিয়ে, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে যন্ত্রণাদায়ক রাসায়নিক পদার্থ গিঁটে ঢুকিয়ে, আলোকরশ্মি প্রয়োগ করে, হাড়ের স্থানচ্যুত করে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের মতো অবিকল অবস্থা তৈরির প্রয়াস চালানো হয়। কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা অস্থিভঙ্গ, রক্তক্ষরণ, রক্তজমাট, আহতাবস্থা বা প্রদাহ কোনোমতেই মানবদেহের অস্টিওআর্থ্রাইটিসের সমতুল্য নয়। তাই কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা জীবদেহের এ রোগে প্রদত্ত ওষুধের কার্যকারিতা কোনো রকমই মানবদেহে সৃষ্ট স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাকৃতিকভাবে তৈরি রোগের জন্য প্রদত্ত ওষুধের কার্যকারিতার প্রতিনিধিত্ব করে না।
আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। বহু ক্ষেত্রেই বিভিন্ন মানব প্রজাতির মধ্যে কোনো পারস্পরিক সম্পর্ক থাকে না। তাই ওষুধের কার্যকারিতা ও ফলাফলেও পরিলক্ষিত হয় অনেক রকম গরমিল। যেমন- আর্সেনিক মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে; কিন্তু বানর, শূকরের ছানা, গিনিপিগের ক্ষেত্রে তা কোনো ক্ষতির কারণ নয়। ডিজিটালিস মানুষের উচ্চ রক্তচাপ কমায়; কিন্তু কুকুরের ক্ষেত্রে এই ওষুধ রক্তচাপ মারাত্মক বৃদ্ধি করে। পেনিসিলিন গিনিপিগের মৃত্যু ঘটায়, অথচ মানুষ পেনিসিলিন গ্রহণ করে রোগমুক্ত হয়। ক্লোরামফেনিকল মানুষের শরীরে রক্তকণিকা উৎপাদন প্রতিহত করে; কিন্তু অন্য কোনো জীবে এর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব নেই। ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত কুকুর, বিড়াল, ইঁদুরজাতীয় জীবজন্তুকে খাদ্যের মাধ্যমে ভিটামিন সি গ্রহণের দরকার হয় না। এরা নিজেরাই শরীরে ভিটামিন সি উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু গিনিপিগ বা মানুষ খাদ্যের মাধ্যমে পর্যাপ্ত ভিটামিন সি উৎপাদন না করলে স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনো বস্তুই বিষ নয়। তবে জীবদেহ ভেদে কোনো বস্তু বিষ হতে পারে। এতক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিতে ওষুধের প্রতিক্রিয়ার তারতম্য নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার দেখা যাক একই প্রজাতির মধ্যে ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় কেমন তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। অল্প বয়স্ক মানুষের চেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে ওষুধের কার্যকারিতা কম এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি। যেমন- ট্রাংকুলাইজার বেশি বয়স্ক মানুষের চেয়ে কম বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে বেশি কাজ করে। লিথাল ডোজ ৫০ শতাংশ (ওষুধ বা রাসায়নিক পদার্থের যে মাত্রায় পরীক্ষায় ব্যবহৃত হলে অর্ধেক প্রাণী মারা যাবে) পরীক্ষায় দেখা গেছে, সকাল বেলায় পরিচালিত পরীক্ষায় সব ইঁদুর বেঁচে থাকে, কোনো প্রাণী মৃত্যুবরণ করে না। অথচ সন্ধ্যায় পরিচালিত পরীক্ষায় সব ইঁদুরই মারা যায়। একই পরীক্ষা শীতকালে করলে ইঁদুরের মৃত্যুহার গ্রীষ্মকালে করা পরীক্ষার ইঁদুরের মৃত্যুহারের চেয়ে অনেক কম। ইঁদুরের খাঁচায় পরীক্ষাকালীন স্বাভাবিকের চেয়ে অতিমাত্রায় বেশি ইঁদুর রাখা হলে মৃত্যুহার বেড়ে যায়। খাঁচায় স্বাভাবিক সংখ্যক ইঁদুর রাখা হলে এ প্রবণতা দেখা যায় না।
এসব সামান্য পরিবেশগত তারতম্যের কারণে যদি পরীক্ষার ফলাফলে এত বিশাল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, তবে নিশ্চিতভাবে আমরা বলতে পারি, জীবজন্তুতে পরিচালিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে ওষুধের কার্যাবলি, গুণাবলি ও পার্শ্বপতিক্রিয়া নির্ধারণপূর্বক তা মানবদেহে প্রয়োগ যথাযথ, বিজ্ঞানসম্মত ও বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। জীবজন্তুর ওপর শুধু ওষুধের কার্যাবলিই পরীক্ষা করা হয় না, ওষুধের বিষাক্ততার পরীক্ষাও করা হয়। কোনো ওষুধ জীবজন্তুর ক্ষেত্রে নিরাপদ প্রমাণিত না হলে সে ওষুধ দিয়ে মানবদেহে পরীক্ষা চালানো বিপজ্জনক। কিন্তু জীবজন্তুর ওপর পরিচালিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা যদি এমন অনিশ্চিত হয়, তবে তা কী করে মানবদেহে প্রয়োগ করা সম্ভব, বিষয়টিতে প্রশ্ন থেকে যায়। তারপরও জীবজন্তুর ওপর পরিচালিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে বহু ক্ষেত্রে অনেক ওষুধ মানবদেহে প্রয়োগ করা হয়। যেমন শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে অনেক ওষুধ প্রয়োগ করা হয় যা মানবদেহে প্রয়োগ করে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো সম্ভব হয় না। শিশুদের শরীরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠে না এবং তাদের শরীরে বিভিন্ন সিস্টেম ও মেটাবলিক প্রক্রিয়া পরিপূর্ণতা লাভ করে না বলে তাদের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো বিপজ্জনক। গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। পরীক্ষার নমুনা ওষুধটি যথেষ্ট নিরাপদ না হলে তা গর্ভবতী মহিলাদের প্রয়োগ করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালালে মা ও গর্ভজাত সন্তানের প্রভূত ক্ষতি করতে পারে। তাই শিশু, মহিলা বা বয়স্কদের বেলায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বেও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা প্রায়ই প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এরা নিজেদের দেশের মানুষকে বাদ দিয়ে সরলতা, অজ্ঞতা ও দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে কিছু আর্থিক সুবিধা দিয়ে অনুন্নত ও গরিব দেশের অসহায় দরিদ্র মানুষ নির্বাচন করে নতুন ওষুধের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। জীবজন্তুর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে শুরু করে মানবদেহে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যন্ত অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ধাপ রয়েছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রচুর সময় ও অর্থের প্রয়োজন। এ কারণে প্রতিটি ধাপে রয়েছে দুর্নীতি-অনিয়মের সুযোগ। অসাধু গবেষক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের যোগসাজশে ওষুধ কোম্পানিগুলো সময় ও অর্থ বাঁচানোর জন্য অপর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ওষুধ বাজারজাত করে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলোর ভাড়া করা গবেষকরা মানবদেহে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন না করেই শুধু জীবজন্তুর ওপর কিছু পরীক্ষা চালিয়ে ওষুধ বাজারজাত করে থাকে। ফলে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা থাকে অপরিসীম। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ২০০৪ সালে বিশ্বের খ্যাতনামা ওষুধ কোম্পানি মার্ক তাদের ভায়োক্স (জেনেরিক:রফেকক্সিব) ওষুধটি হাজার হাজার হৃদরোগ ও স্ট্রোকজনিত মৃত্যুর কারণে বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। আরও একটি ওষুধ থ্যালিডোমাইডের কথা সর্বজনবিদিত। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এ ওষুধটি গর্ভবতী মহিলাদের প্রদানের কারণে বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার শিশু অঙ্গ বিকৃতি বা অঙ্গহীন অবস্থায়
জন্মগ্রহণ করার পর ওষুধটি বাজার থেকে তুলে নেয় ওষুধটির আবিষ্কারক কোম্পানি গ্র“নেনথাল। এসব করুণ পরিণতির জন্য জীবজন্তু ও মানুষের ওপর ওষুধগুলোর অপর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষকদের বিভ্রান্তিকর তথ্য ও দুর্নীতিকে দায়ী করা হয়।
ওষুধ উদ্ভাবনে জীবজন্তুর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ এসব জীবজন্তুর ওপর পরীক্ষার ফলাফল মানুষের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, দুর্ভাগ্যক্রমে জীবজন্তু বা মানবদেহে ওষুধের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত তথ্যাবলি বা ডাটা গোপন রাখা হয় বলে জনগণ এ ব্যাপারে কিছুই জানতে পারে না। অতি অল্পসংখ্যক জীবজন্তু ও মানুষের ওপর কোনো ওষুধের পরীক্ষা চালানো হয় বলে অনেক সময় এসব ওষুধের কার্যকারিতা বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায় না। বাজারজাত হওয়ার পর লাখো-কোটি মানুষ এসব ভুল ওষুধ গ্রহণ করে বলে প্রকৃত কার্যকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। মার্ক কোম্পানির ভায়োক্সের ট্রায়ালে তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে বলে কোম্পানি কোনো সময় স্বীকার করেনি। অথচ ২০০০ সালে বাজারজাত হওয়ার পর থেকে পরবর্তী চার বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার মানুষ এই ওষুধ গ্রহণ করে হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মৃত্যুবরণ করে। মার্ক কোম্পানি চার বছর ধরে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত ওষুধটি তুলে নিতে বাধ্য হয়। মার্ক যদি ওষুধটি নিয়ে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাত, তবে বিশ্বে এ বিপর্যয় নেমে আসত না। মার্ক কোম্পানির ভায়োক্সের কারণে বিশ্বজুড়ে সৃষ্ট বিপর্যয় কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাজারে প্রচলিত বহু ওষুধের কোনো না কোনো সমস্যা রয়েছে- যা কোম্পানিগুলো জেনেশুনে গোপন করে যায়। সুস্থতা অর্জনের জন্য ওষুধ গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে দু’লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করলে বুঝতে হবে ওষুধ কোম্পানিগুলোর ওষুধ উদ্ভাবন ও ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গলদ বা দুর্নীতি রয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে ওষুধ কোম্পানিগুলো এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড বা দুর্নীতির আশ্রয় নেয় কেন। উত্তর অতি সোজা। ওষুধের কার্যকারিতা, ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিষক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়ার ওপর প্রকৃত গবেষণা চালালে খুব সীমিত সংখ্যক ওষুধ বাজারে আসার ছাড়পত্র পাবে। জীবজন্তু ও মানবদেহে বছরের পর বছর ধরে কোনো ওষুধের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে গেলে লাখ-লাখ টাকা বিনিয়োগ হবে অথচ পর্যাপ্ত ওষুধ উদ্ভাবন ও বাজারজাত না হলে অঢেল মুনাফা আসবে কীভাবে।
একটু খোলা মন নিয়ে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করলে বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, অকিঞ্চিৎকর ও অভিপ্রায়মূলক ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ওষুধ কোম্পানিগুলোর আকাশচুম্বী মুনাফার জন্য অবশ্যম্ভাবী ও অত্যাবশ্যক। এ ধরনের বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তি পাওয়া যাবে ই-লিলির ১৯৯৩ সালের প্রোজাক ওষুধবিষয়ক পুস্তিকার ভাষা পড়লে। এতে বলা হয়- ‘এমন কোনো প্রেসক্রিপশন ড্রাগ নেই যা শতভাগ নিরাপদ। অনেক রোগী অনেক সময় কোনো ওষুধের কোনো নির্দিষ্ট মাত্রায় ভিন্নভাবে সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে। এমনও হতে পারে কোনো ওষুধ বহু বছর ধরে ব্যাপকভাবে প্রেসক্রাইব ও ব্যবহার করলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হতে পারে।’ যদি তাই হয়- অর্থাৎ কোনো বিশেষ ওষুধ কোনো বিশেষ রোগীর ক্ষেত্রে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালে তা আলাদা জীবজন্তুর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর যৌক্তিকতা থাকে কি? এ প্রসঙ্গে এক অভিজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, জীবজন্তুর ওপর চালানো পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কোনো ওষুধ মানবদেহে প্রয়োগ করলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।
পৃথিবীর বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো চায় না যে, আমরা ওষুধ সম্পর্কে সত্য কথাগুলো জেনে ফেলি। তারা এও চায় না, ওষুধের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে আমরা কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করি বা ঔৎসুক্য প্রকাশ করি। যদিও এসব ওষুধের ওপর আমাদের জীবন-মরণ নির্ভর করে। তবে আমাদের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ যে নেই, তা কিন্তু নয়। ওষুধ কোম্পানিগুলো মনে করে ও স্বীকার করে, যখনই আমরা কোনো ওষুধ গ্রহণ করি বা খাদ্য ও পরিবেশ থেকে উদ্ভূত কোনো রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসি, তখন আমরা হয়ে যাই তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সত্যিকার গিনিপিগ।
মুনীরউদ্দিন আহমদ : অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
drmuniruddin@gmail.com
