পিরোজপুরের ঘটনা ও ‘গিলগামেশ প্রবলেম’
ডা. জাহেদ উর রহমান
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজ থেকে ৪ হাজার বছর আগে লিখিত মেসোপটেমিয়ার ‘এপিক অব গিলগামেশ’ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। ধর্মীয় টেক্সট হিসেবেও এটি দ্বিতীয় প্রাচীনতম, এরচেয়ে প্রাচীন টেক্সট হচ্ছে পিরামিড টেক্সট। গিলগামেশ ছিলেন উরুক (এটা বর্তমানে ইরাকের অংশ)-এর রাজা।
তিনি ছিলেন ‘ডেমিগড’ অর্থাৎ দেবতা আর মানুষের সংকর। ভয়ংকর শারীরিক শক্তির অধিকারী রাজা গিলগামেশ প্রজাবৎসল রাজা তো ছিলই না বরং ছিল অত্যাচারী, স্বেচ্ছাচারী এমনকি ‘সিরিয়াল ধর্ষক’। স্বাভাবিকভাবেই অতীষ্ঠ হয়ে ওঠে রাজ্যের প্রজারা, গডের কাছে প্রার্থনা করে।
সেই প্রার্থনা শোনেন গড এবং সৃষ্টির দেবী আরুরু সৃষ্টি করেন ‘এনকিদু’কে। তাকে গিলগামেশের সমপর্যায়ের শক্তি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়।
দেবতারা ভাবেন এনকিদু গিলগামেশের সঙ্গে সংঘাতে নামবে এবং সমশক্তির দুই সত্তা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে পরস্পরের শক্তি ক্ষয়ের কারণ হবে। এভাবে গিলগামেশ এনকিদুকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে, সংঘাতে জড়াবে, শক্তি ক্ষয় করবে এবং এতে প্রজারা ভালো থাকবে। এই ছিল দেবতাদের পরিকল্পনা।
এনকিদুর সৃষ্টি কীভাবে হল, কীভাবে সে পৃথিবীতে এলো, তারপর শুরুতে কী হল সেটা নিয়ে দীর্ঘ বয়ান আছে ‘এপিক অব গিলগামেশ’-এ। সেটা খুব আকর্ষণীয় হলেও এখানে প্রাসঙ্গিক না, তাই আমরা সরাসরি চলে যাচ্ছি গিলগামেশ আর এনকিদুর দেখা হওয়ার সময়টায়।
তাদের দেখা হওয়ার পর দু’জন চরম সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, প্রচণ্ড মারামারি হয় দু’জনের মধ্যে। যুদ্ধে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় না এবং স্বাভাবিকভাবেই দুই মহাশক্তিধর প্রতিপক্ষ তাদের মধ্যে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করে দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে দু’জন হয়ে ওঠে দারুণ বাস্তববাদী- তারা বুঝতে পারে নিজেদের মধ্যে এভাবে যুদ্ধ করে তারা শুধু একজন অপরজনের ক্ষতিই করতে পারবে। তারচেয়ে যদি দু’জনে বন্ধু হয়ে যায় তাহলে সেটা দু’জনেরই স্বার্থরক্ষা করবে। এরপর গিলগামেশ আর এনকিদু বন্ধু হয়ে যায়।
যে পরিকল্পনা নিয়ে দেবতারা এনকিদুকে সৃষ্টি করেছিলেন, সেটা মাঠে মারা যায়। এই গল্পে আমরা ফিরে আসব আবার, তবে তার আগে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া খুব আলোচিত একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু কথা বলে নেয়া যাক।
কিছুদিন আগে দুদকের মামলায় পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তার স্ত্রীকে জামিন না দেয়া নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছিল, সেটা নিয়ে দেশে প্রচণ্ড তোলপাড় হয়েছিল।
জামিন না দেয়ার ‘অপরাধে’ রীতিমতো জেলা ও দায়রা জজকে স্ট্যান্ড রিলিজ করিয়ে অধস্তন বিচারককে সেই দায়িত্ব দিয়ে জামিন দেয়ানো হয়েছিল উক্ত অভিযুক্তদের। আইনমন্ত্রীর ব্যাখ্যা অনুসারে সবকিছু তিনি করেছিলেন ‘উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য’।
মূলধারার মিডিয়া এবং সামাজিক মিডিয়ায় অনেকেই স্তম্ভিত হলেও, ঘটনাটায় আমি অবাক হইনি বিন্দুমাত্র।
কোনো বিষয় আইনে বা সংবিধানে লেখা থাকলেই সেটা সরকার কার্যকর করবে বা মেনে চলবেই সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সরকারকে যদি সাংবিধানিকভাবেই কোনো অন্যায় ক্ষমতা দেয়া থাকে তাহলে সরকারকে সেই অন্যায় থেকে দূরে রাখার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।
বিচার বিভাগ, বিশেষ করে নিু আদালতের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা সরকারকে সাংবিধানিকভাবেই দেয়া আছে। সংবিধানের ১১৫ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ দেখে নেয়া যাক। ১১৫. বিচার বিভাগীয় পদে বা বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধিসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন।
১১৬. বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিমকোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে। অথচ এই দুটি ধারা সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানের মূলনীতি অংশে ২২ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে লেখা আছে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’
সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে সরকারের সংঘাত হয়েছিল মূলত এই অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরিবিধি এবং শৃঙ্খলা নির্ধারণ নিয়ে। জনাব সিনহা চেয়েছিলেন আলোচিত মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী নিু আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের হাতে থাকবে।
তখন আইনমন্ত্রীকে আমরা বলতে শুনেছি, সুপ্রিমকোর্ট রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে। মজার ব্যাপার হলো, সংবিধানে রাষ্ট্রপতি শব্দটা লেখা থাকলেও আদতে এটা সরকারের ক্ষমতা। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সম্পর্কে বর্ণিত অনুচ্ছেদটি পড়ে নিই-
৪৮(৩) এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্টপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন:
তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শদান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে বিচারপতিগণ খুব স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, সংবিধানের ১১৫ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ ১৯৭২-এর মূল সংবিধানের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে না গেলে বিচার বিভাগ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হবে না।
সেই সংবিধানে ওই অনুচ্ছেদগুলো ২২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল না। ১৯৭২ এর সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটি দেখে নেয়া যাক- ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিমকোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকিবে।’
যখন বিগত সরকার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের চাকরি থেকে অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিতে চেয়েছিল, তখন বারবার ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দোহাই দেয়া হয়েছিল। মজার ব্যাপার, সংবিধানের ১১৫ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা সরকার কোনোভাবেই বলে না।
আজ থেকে ঠিক ৮০০ বছর আগে সামন্ততান্ত্রিক ইংল্যান্ডে রাজার হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকার বিরুদ্ধে ব্যারনদের প্রতিবাদ হয়েছিল, সেই প্রতিবাদের ফলস্বরূপ রাজাকেও আইনের অধীন আসতে হয়েছিল, আইন মানতে হয়েছিল।
এর পথ ধরে প্রায় আড়াইশ’ বছর আগে ফরাসি বিপ্লবে রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল; ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার। এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’।
একটা রাষ্ট্রের তিনটা অঙ্গ- নির্বাহী, আইন এবং বিচার বিভাগ একটি অপরটির থেকে আলাদা থাকবে। গণতন্ত্র শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা কি না, সেটা নিয়ে তর্ক সরিয়ে রেখে বলছি, দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’ নিশ্চিত করা গেলেই একটি রিপাবলিকের নাগরিকদের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষিত হয়।
বিখ্যাত বই ‘হোয়াই ন্যাশনস ফেইল’-এর লেখকদ্বয় ড্যারন এসেমাগলু এবং ইয়ান রবিনসন তাদের সাম্প্রতিকতম বই ‘দ্য ন্যারো করিডোর: স্টেটস, সোসাইটিজ অ্যান্ড দ্য ফেইট অব লিবার্টি’ গ্রন্থে এক নতুন প্রবণতা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে দেখা যাচ্ছে, অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে সেপারেশন অব পাওয়ার নিশ্চিত করার পরও সেখানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ অনেক ক্ষেত্রেই তাদের পারস্পরিক বৈপরীত্যকে কমিয়ে এনে একে অপরকে ছাড় দিতে শুরু করে।
এটাকেই তারা নাম দিয়েছেন ‘গিলগামেশ প্রবলেম’। ‘এপিক অব গিলগামেশ’-এ গিলগামেশ এবং এনকিদু যেমন পরস্পরের মধ্যে সংঘাত করে বুঝতে পারে এতে তাদের পরস্পরের কোনো লাভ হবে না বরং ক্ষতি হবে, তেমনি রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ বুঝতে শুরু করে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত যত কম হয় ততই তাদের লাভ হবে।
গিলগামেশ আর এনকিদু পরস্পরের বন্ধু হওয়ার ফলে তাদের নিজেদের লাভ হলেও শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছিল উরুক রাজ্যের জনগণের। ঠিক একইভাবে এখন রাষ্ট্রের অঙ্গগুলো তাদের পারস্পরিক স্বার্থে যদি পরস্পরকে ছাড় দিতে থাকে ক্ষতি হয় জনগণের।
এই ক্ষতি কীভাবে সামাল দিতে হবে, কীভাবে সমাজ দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্রকে এই পথ থেকে দূরে রেখে নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষা করবে, সেই লক্ষ্যে কীভাবে নাগরিকরা সামাজিক শক্তির উন্নয়ন ঘটাবেন উক্ত বইয়ে সেই আলোচনাগুলো করা হয়েছে। পৃথিবীর গণতন্ত্রের হালের আলোচনা এগুলোই।
রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগ আর আইন বিভাগকে তার কব্জায় নিয়ে গেলে কী হয়, কেন সেপারেশন অব পাওয়ার থাকা উচিত- এসব আলোচনা বহু শতাব্দী আগে শেষ হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা দেখছি উল্টোপথের যাত্রা।
সেপারেশন অব পাওয়ারের ক্ষেত্রে যতটুকু অগ্রগতি আমাদের হয়েছিল, সেটুকুও এখন আর নেই। তাই আমাদের এই প্রাগৈতিহাসিক আলোচনা করতে হচ্ছে বিচার বিভাগ নিয়ে। এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে এর চাইতে কষ্টকর আর কিছু হতে পারে না।
কোনো সন্দেহ নেই সংবিধানে কিংবা আইনে কোনোকিছু খুব স্পষ্টভাবে লেখা থাকা মানে নির্বাহী বিভাগ সেটা মেনে চলবে, সেটা হয় না সব সময়। কিন্তু একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে সাংবিধানিক এবং আইনি সংস্কারও খুব জরুরি।
সাংবিধানিকভাবে নিু আদালতের ওপর সরকারের প্রায় নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব দিয়ে রেখে আমরা এই রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আশা কোনোভাবেই করতে পারি না।
পিরোজপুরের ঘটনা সরকার খুব ক্রুডলি হ্যান্ডেল করেছে বলে আমাদের অনেকের চোখে পড়েছে, শোরগোল করেছে সবাই। গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে বিচার বিভাগের উপরে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ আমাদের চারপাশেই আছে।
নাগরিকদের উচিত সাংবিধানিকভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা। এমনকি সেটা নিশ্চিত করা হলেও তাদের উচিত হবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ক্রমাগত সামাজিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে চাপে রেখে ‘গিলগামেশ প্রবলেম’-এর সম্ভাবনা রুদ্ধ করা।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট
