ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা
ওয়ালিউর রহমান
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শতাব্দীর মহানায়ক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেনেভায় প্রথম পদার্পণ ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে। তিনি লন্ডন থেকে অস্ত্রোপচারের পর সেখানে আসেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। এর আগে অবশ্য অস্ত্রোপচারের পর কনভেলেসেন্স-এর জন্য অনেক দেশ থেকেই বঙ্গবন্ধুর কাছে দাওয়াত এসেছিল। অনেক কারণে ওইসব দেশে না গিয়ে বঙ্গবন্ধু নিউট্রাল সুইজারল্যান্ডেই আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। অনেক চিন্তা করে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদি বলা হয়, আমরা শুধু আনন্দিত হয়েছিলাম তাহলে এটুকু অল্প বলা হবে। আমরা সর্বশক্তিমানের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম- আমরা সবাই একটু সুযোগ পাব, এ বরেণ্যকে আমাদের মাঝে পাব অল্প কিছু সময়ের জন্য।
বেগম মুজিব ছাড়াও সেসময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ কামাল ও শেখ জামাল। শেখ রাসেলও ছিল। আজকের জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল তার ছেলে- ছোট্ট শিশু জয়। আরও ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ হানিফ, প্রফেসর নূরুল ইসলাম, প্রয়াত আবুল হাশেম, প্রয়াত জনাব বাদশাহ এবং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। নূরুল ইসলাম অনু, প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী এবং রাফিয়া আখতার ডলী এমপিও ছিলেন সঙ্গে। ১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে অটোওয়াতে কমনওয়েলথ প্রধানদের মিটিংয়ে যোগদানের পর বঙ্গবন্ধু আবার জেনেভায় এলেন। মোট চার দিন ছিলেন। এবার তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে প্রথম মিটিং করলেন জেনেভাতে। সেটা আপাতত থাক।
এখন আমরা ফিরে যাই ’৭২-এর আগস্ট মাসে। সুইস পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি আমাকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় রাজনৈতিক এসাইলাম দিয়ে আমার কাজের অনেক সুবিধা করে দিয়েছিলেন। তার বিশেষ ব্যক্তি এবং পরবর্তীকালে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত ভিকটর উমব্রীয়ট আমাকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অনেক সাহায্য করেছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন জনাব টিবর ভন সসান। বঙ্গবন্ধুর আসা ও থাকার ব্যাপারে জনাব গ্রাবার সাহেবের সঙ্গে এ দু’জন আমাকে অনেক সাহায্য করলেন। স্বাধীনতার সময় বঙ্গবন্ধুর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে সুইজারল্যান্ডের মিডিয়াগুলো খুব ভালো অবদান রেখেছিল। কাজেই গ্রাবারের কাছে অনুরোধ করতেই তারা রাজি হলেন যে, যতদিন আমাদের মহান নেতার সুস্থ হতে সময় লাগবে, ততদিন আমরা তাদের আতিথেয়তা ভোগ করতে পারব। তাই হল হোটেল লা রিজার্ভ লেক জেনেভায় যা লেক লেমনের পাশেই। এ সুন্দর সুগঠিত হোটেলে বঙ্গবন্ধুর থাকার ব্যবস্থা হল। লেকের বরাবর যে সুইটটি ছিল সেখানেই বঙ্গবন্ধু থাকলেন। তিনি রুমে গিয়েই দরজার সামনে টেরাসে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং সামনে দেখতে পেলেন লেক লেমন। আরও দূরে ওপরের দিকে চাওয়া পাহাড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চোখ সচ্ছল হয়ে উঠল। তিনি আমার দিকে তাকালেন- বললেন, ‘আমাদের দেশেও কোনো বেশি সম্পদ নেই এদের দেশেও নেই; কিন্তু এরা আজ পৃথিবীর মাঝে কত ধনী দেশ। আমরাও তো এরকম হতে পারি। আচ্ছা এ দেশের সংবিধান আমাকে দিসতো। আচ্ছা আমাদের চট্টগ্রামকে আমরা জেনেভার মতো করতে পারি না! ওখানেও তো পাহাড় আছে, লেক আছে। সমুদ্রও তো আছে।’ উনি এর ভেতরেই তার সুইটে গিয়ে একটু ক্লান্তবোধ করলেন এবং বিশ্রাম করবেন বলে আমাদের জানালেন। আমি বেরিয়ে এসে আমার হোটেলের অফিস রুমে ঢুকলাম। ওখানে গিয়ে আমি আমার সেক্রেটারিকে বাইরে কোনো কাজে পাঠালাম। আমি তখন চিন্তা করছি এক মহামানবের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হল। দেখলাম তার চোখে কী মায়া, দেশের জন্য কী চিন্তা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মানুষের জন্য কী দরদ। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তার ভাবনা। এ সময় থেকে বঙ্গবন্ধু আমাকে যে উদ্দীপনা দিলেন- দেশের জন্য এবং দেশবাসীর জন্য তা হয়ে রইল আমার সারা জীবনের পাথেয়, যা সঙ্গে করে সারাজীবন কাজ করেছি এবং করব।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার পর আমি যখন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক হিসেবে কাজ করি, তখন স্বাধীনতাবিরোধীরা আমাকে ওএসডি বানিয়ে দিল। আমি কোর্টে গেলাম এবং আইনি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে চাকরি ফিরে পেলাম। তবে জীবনের তিন বছর আট মাস হারালাম। জননেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, আপনি এক্সটেনশন নিন। বললাম, না, আমি নেব না। তিনি জানতে চাইলেন আমি কেন এ সুযোগ নেব না। আমার সহজ উত্তর- আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি স্বাধীনতাবিরোধীদের বৈষ্যমের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে এটি থেকে যাক, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম এটি উপলব্ধি করতে পারে। পরে আবারও এ একই চক্রান্তকারীরা ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমাকে চাকরি থেকে অন্যায়ভাবে চক্রান্ত করে একটি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবসর দিয়েছিল। নিয়তির কী পরিহাস।
বঙ্গবন্ধুকে রুমে রেখে আমার অফিস রুমে বসে ভাবছি জাতির পিতাকে কীভাবে একটু আয়েশ দেব, একটু আরাম দেব। কিন্তু সে সুযোগ বেশি হল না। এ মহামানবকে দেখার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষের ঢল পড়ে গেল। তারা দেখতে চায় মহান নেতাকে, চোখের এক ঝলক শুধু। শত শত সুইস আসতে থাকল। তারা দেখতে চাইল বাংলাদেশের নেতাকে- যিনি কিছুদিন আগেই পাকিস্তান জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তিনি মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছেন- জেলের সামনে খোঁড়া হয়েছিল তার কবর। এর মধ্যে এলেন প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান, ইউএনএইচসিআরের তদানীন্তন প্রধান। তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী ও সদালাপী। তিনি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করার পর বললেন, আপনি শতাব্দীর মহামানব। আপনি আপনার চেষ্টা ও তিতিক্ষার মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশকেই সৃষ্টি করেননি- আপনি পৃথিবীকে একটি মহৎ মানবতার নিদর্শন দিয়েছেন আপনার ত্যাগের মাধ্যমে।
এর আগেই সুইস রাষ্ট্রপ্রধান একটি ফুলের তোড়া পাঠালেন হোটেলে। তার পরপরই ফুল এলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষ থেকে। তৎকালীন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিনও শুভেচ্ছা বার্তা পাঠালেন। এরপর স্বয়ং জুলফিকার আলী ভুট্টোও ফুল পাঠালেন। এটাই শেষ নয়। হঠাৎ ভুট্টো সাহেবের ফোন এলো। ফোনে ছিলেন তদানীন্তন আইএসআইয়ের প্রধান গুল হাসান। বঙ্গবন্ধু বললেন, তুই কথা বল, জিজ্ঞেস কর, এবং দেখ সে কী বলতে চায়। আমি গুল হাসানকে জানানোর পর তিনি বললেন ভুট্টো সাহেব শুধু আপনার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। এরপর বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, তুই তাকে একটু ফোনে ধরে রাখ। আমি ভুট্টো সাহেবকে প্রায় পাঁচ মিনিট ফোনে দাঁড় করিয়ে রাখলাম। এরপর বঙ্গবন্ধু ফোন ধরলেন এবং তাকে বললেন, তুমি রাজনীতি শেখনি। তোমাকে আমার কাছ থেকে রাজনীতি শিখতে হবে। আমি তোমাকে যা বলেছি সেটিই শেষ কথা। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং এটাই হবে আমাদের আগামীর সম্পর্ক।
এদিকে সকাল-সন্ধ্যা-দুপুরেও চলছে মানুষের ভিড়। নিয়ন্ত্রণ করতে স্বাগতিক দেশের সিকিউরিটি সার্ভিসের সাহায্য নিতে হল। এর মধ্যে এলেন জনাব আবদুল মতিন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ওপর পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। জনাব ইকবাল আতহারও এলেন। একটি সুটকেসে কিছু আসবাবপত্র নিয়ে এলেন, এটি তিনি বৈরুত থেকে এনেছেন। ডিসেম্বর ৫, ১৯৬৩ সালে মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের আকস্মিক মৃত্যুর পর হোটেলে তার কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ছিল।
এ স্বল্প সময়ে আমি অতি কাছ থেকে দেখলাম বঙ্গবন্ধু ও তার একান্ত আপনজনদের। আমি, আমার স্ত্রী শাহরুখ সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলাম তাদের অমায়িকতা, ভদ্রতা ও শালীনতা দেখে। জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই সময়েই তার বিশেষ ব্যক্তিত্বের নিদর্শন দেখিয়েছিলেন। তার উৎকর্ষ, মর্যাদাপূর্ণ চালচলন, সংবেদনশীলতা ও মানবতা সবাইকে মুগ্ধ করে। তার মনে কি কোনো আতঙ্ক ছিল? তিনি প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর কামরায় গিয়ে তাকে একঝলক দেখে আসতেন। বলতেন- ‘আব্বাকে একবার দেখে আসি।’
ওয়ালিউর রহমান : সাবেক কূটনীতিক, গবেষক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান; বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন
