বাপকা বেটা, সিপাইকা ঘোড়া কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া
ডা. জাহেদ উর রহমান
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
হাজী সেলিমের কথা আমরা জানতাম আগেই। এখন দেখা যাচ্ছে তার ছেলেও ‘বাপকা বেটা’। দু’জনেরই থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ছে। বিড়াল দেখে আমরা কেউ সম্ভবত তেমন একটা অবাক হইনি; আমি তো হইনি একেবারেই। এদের থলেতে বিড়াল আছে জানতাম, জানতাম সেটা দেখতে কেমন- আকার, রং কী।
এ প্রবণতা বাংলাদেশে এখন একেবারেই সাধারণ। সরকারি দলের সঙ্গে জড়িত কেউ কোনো অঘটন ঘটিয়ে সামাল দিতে না পেরে (অতি প্রভাবশালীর সঙ্গে সংঘাত কিংবা ভাইরাল হয়ে পড়া ঘটনায় জড়িত থাকার কারণে) পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তাদের থলের বিড়াল নিয়মিতভাবে বেরিয়ে আসতে দেখি আমরা।
বাবা আর শ্বশুর সংসদ সদস্য, শাশুড়ি উপজেলা চেয়ারপারসন, নিজে ওয়ার্ড কমিশনার হলেও ইরফান সেলিমের ওপর যেসব আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে সেগুলোকে দেশের আইনের শাসনের অস্তিত্ব থাকার প্রমাণ হিসেবে দেখা যায় কি?
সামাজিক মাধ্যমে মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখলে এটি খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, তারা জানেন শুধু সশস্ত্র বাহিনীর একজন সদস্য আক্রান্ত হওয়ার কারণেই আইন তার নিজস্ব (কিংবা তার চেয়েও অনেক বেশি) গতিতে চলতে শুরু করেছে। ভীষণ দামি-বিরাট গাড়িতে স্ক্যাচ ফেলে দেয়ার কারণে প্রতিদিন কত মোটরবাইক, সিএনজি অটোরিকশা কিংবা রিকশাচালক বেদম মার খায় গাড়িওলাদের কাছে, জানে সবাই।
আমার লেখার বিষয় ঘটনার এদিকটা নয়, আরেকটা দিক। শুরুতে যেমন বলছিলাম কোনো ঘটনায় কেউ যদি ফেঁসে যায়, তাহলে সরকারি নানা সংস্থা লেগে যায় তার পেছনে। তখন আমরা তার থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়তে দেখি। বেরিয়েছে এবারও। ‘দুই বিদেশি কুকুর ও ১০ দেহরক্ষী নিয়ে এলাকায় চক্কর দিতেন ইরফান!’ ‘এমপির স্টিকার লাগানো গাড়ির কোনো কাগজপত্র নেই!’
‘হাজী সেলিমের ছেলের নিয়ন্ত্রণে চলত চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস’, ‘হাজী সেলিমের ছেলের টর্চার সেলের সন্ধান’- ইরফান সেলিম গ্রেফতার হওয়ার পর এরকম নানা শিরোনামে ভরে গেছে আমাদের সুপরিচিত জাতীয় পত্রিকাগুলো।
একটি গুরুত্বপূর্ণ নিউজ পোর্টাল রিপোর্ট করেছে ‘সাম্রাজ্য চালাতে’ হাজী সেলিমের বাসায় কন্ট্রোল রুম শিরোনামে। এর কিছু অংশ এরকম- ‘পুরান ঢাকা এলাকা ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করতে হাজী সেলিমের বাসায় গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিসহ অত্যাধুনিক কন্ট্রোল রুম। কন্ট্রোল রুমে রয়েছে আধুনিক ভিপিএস (ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার), ৩৮টি ওয়াকিটকি, ড্রোনসহ বিভিন্ন ডিভাইস।
রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (ভিভিআইপি) নিরাপত্তায় নিয়োজিত এলিট বাহিনীর কাছে যেসব সরঞ্জাম থাকে, সেরকম সরঞ্জাম পাওয়া গেছে এখানে’। সেই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে- ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানান, এ ছাড়া ওই বাসায় একটি ড্রোন, রাউটার, একটি ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার বা ভিপিএস পাওয়া গেছে।
এ ভিপিএস দিয়ে মূলত তার পুরো নেটওয়ার্কে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করত, যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ট্র্যাক করতে না পারে। সাধারণত ভিপিএস ব্যবহারের অনুমোদন পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা। বিটিআরসি এ অনুমোদন দেয়। তবে হাজী সেলিম কোনো অনুমোদন নেননি’।
ইরফান সেলিমের বাবা হাজী সেলিমও নানা কারণে সমালোচিত একজন মানুষ। বহু সমালোচনার সঙ্গে মানুষের জমি দখল করে ফেলার ক্ষেত্রে তার ভীষণ ‘সুনাম’ আছে। তার এ দিকটি নিয়ে অনেক রিপোর্টে সয়লাব বয়ে আছে জাতীয় পত্রিকাগুলো। ১৯৯৬ সালের পর লালবাগ ও চকবাজার এলাকার মধ্যে যেখানেই খালি জমি পেয়েছেন, সেখানেই হাত পড়েছে হাজী সেলিমের। শুধু খালি জমিই নয়, দখল করেছেন বহু স্থাপনাও।
তিনি দখল করেছেন ঐতিহাসিক জাহাজবাড়ি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে অগ্রণী ব্যাংকের জমি, ঢাকা সরকারি বধির হাইস্কুলের এক একর জমি। চকবাজার এলাকার নলগোলা সরদার হার্ডওয়্যার মার্কেট, বশির মার্কেট, ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট, মনসুর খান প্লাজা এবং হারিকেন মার্কেটও দখল করে নিয়েছেন হাজী সেলিম।
পুরান ঢাকার জামিল স্টোরের ৫ কাঠা জমি, মদিনা আশিক টাওয়ার ও জাপান ইলেক্ট্রনিক্সের জায়গা দখল করেছেন হাজী সেলিম। চকবাজারের ছোটকাটারায় হাজী সেলিমের চাঁন সরদার কোল্ডস্টোরেজ স্থাপিত হয়েছে কয়েকজন মানুষের জমি দখল করে। এমনকি গ্রিন রোডে অবস্থিত মদিনা গ্রুপের কর্পোরেট অফিস তৈরি হয়েছে সরকারি জমি দখল করে।
তার আসনের আওতাধীন প্রতিটি ওয়ার্ডেই তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বাহিনী- এমন অভিযোগ রয়েছে। সোয়ারিঘাট-চকবাজার এলাকার প্রতিটি মার্কেট থেকে মাসোহারা আদায়ে রয়েছে হাজী সেলিমের পৃথক একটি গ্রুপ। তার এলাকায় ট্রাকে ও লরিতে পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রেও দৈনিক ভিত্তিতে টাকা গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের।
হাজী সেলিম সম্পর্কে এসব অভিযোগ নতুন নয়। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে তিনি বিএনপি করতেন এবং ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন। তখন থেকেই তার সম্পর্কে এলাকার মানুষ জানে। ১৯৯৬-এর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে স্ট্রোক করে চলৎশক্তি এবং বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি; কিন্তু একাদশ সংসদ নির্বাচনে এ মানুষটিকে আবার মনোনয়ন দেয়া হয়।
এ দেশের ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য হওয়ার মধ্যে এতই ‘মধু’ আছে যে, শয্যাশায়ী মানুষটি মনোনয়ন পেয়ে শারীরিকভাবে অনেকটা চনমনে হয়ে ওঠেন। তবে এখনও তিনি খুব সামান্যই কথা বলতে পারেন এবং খুব অস্পষ্ট উচ্চারণে। মজার ব্যাপার, সংসদ সদস্য হচ্ছেন প্রায় বাকশক্তি রুদ্ধ একজন মানুষ; অথচ সংসদ হচ্ছে কথা বলার জায়গা। আমাদের কাছে যা-ই মনে হোক না কেন, এমন একজন মানুষকে মনোনয়ন দিয়েছিল ক্ষমতাসীন দল।
‘মাফিয়া’ শব্দটি আমরা আকছার ব্যবহার করি। মোটামুটি জানিও মাফিয়া কারা, কী করে তারা। মাফিয়া বলতে আমরা এখন যা বুঝি সেটি শুরু হয়েছিল মধ্যযুগ থেকেই। তবে এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়ে ওঠে ইতালির সিসিলির মাফিয়ারা, সেখানে তাদের নাম ছিল ‘কোসানস্ট্রা’। পরবর্তী সময়ে এদের এক্সটেনশন হয় আমেরিকাতেও। এরপর বিভিন্ন দেশে উল্লেখযোগ্য মাফিয়াচক্র তৈরি হয়।
যেমন- আমেরিকায়, রাশিয়ায়, জাপানে। ১৯৬০ এবং ’৭০-এর দশকে জাপানি মাফিয়া ‘ইয়াকুজা’ তো পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মাফিয়া সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। একটি মাফিয়াচক্রে বেশকিছু পরিবারের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এক একটি এলাকায় এক একটি পরিবারের প্রভাব থাকে। সেই এলাকায় তার সর্বময় কর্তৃত্ব থাকে, থাকে ‘সার্বভৌমত্ব’।
সেই সার্বভৌমত্বে আর কেউ হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায় না। হস্তক্ষেপ করার মতো পরিস্থিতি হলে খুনোখুনির মতো ঘটনা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। পরিবারটির ক্ষমতার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে তার প্রভাবাধীন এলাকা কতটা বড় হবে। এলাকার সর্বময় কর্তৃত্ব হাতে নিয়ে তারা সেই এলাকার সর্বময় কর্তা হয়ে যায়।
নিয়মিত মানুষের কাছ থেকে জোরপূর্বক মাসোহারা নিয়ে অন্য সন্ত্রাসীদের হাত থেকে তাদের এক ধরনের নিরাপত্তা বিধান করে, সবরকম অবৈধ এবং বেআইনি লেনদেনের মধ্যে সমন্বয় করে, অপরাধীদের মধ্যে সমস্যা হলে সেটির মধ্যস্থতা করে। এছাড়াও তারা জুয়া খেলা, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, অতি উচ্চ সুদে ঋণ দেয়া, পতিতাবৃত্তি এসবের মাধ্যমেও বিপুল অর্থ উপার্জন করে।
এবার হাজী সেলিম আর তার পুত্রের সব কর্মকাণ্ড মাফিয়ার সঙ্গে একটু মিলিয়ে দেখলেই যে কেউ খুব সহজে বুঝে যাবেন? তার সংসদীয় এলাকায় হাজী সেলিম স্রেফ একটি মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেছেন। সত্যি বলতে তিনি যা করছেন, সেটাকে মাফিয়াতন্ত্র বললেও কম বলা হয়, কারণ নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের এ মাফিয়াতন্ত্র আন্তর্জাতিক মাফিয়াতন্ত্রের চেয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আলাদা।
হাজী সেলিম দশকের পর দশক ধরে যা যা করেছেন সেটি সরকারগুলো কি জানত না? এমনকি তার ছেলে তাদের প্রভাবাধীন এলাকা সার্ভেইল্যান্সের মধ্যে রাখার জন্য যা যা করেছে এগুলোর কোনোটাই গোপনভাবে করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ এ রাষ্ট্রের প্রশাসন সবকিছু জানত; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বছরের পর বছর এসব চালিয়ে যেতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি।
এখন অতি স্পর্শকাতর জায়গায় ঝামেলা তৈরি হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘জেগেছে’। জেগেছে দুদকও- তারাও নাকি হাজী সেলিম এবং তার ছেলের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করছে। অবশ্য এমন লোকদের বিষয়ে তদন্ত করার কথা বলে দুদক লোক হাসানোর বেশি কিছু করতে পারেনি অতীতেও।
মাফিয়ারা তাদের বেশকিছু কর্মীসহ একটা আলাদা বাহিনী তৈরি করে ফেলে। কাজকর্মের সুবিধার জন্য রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কিছু মানুষকে ঘুষ দিয়ে তাদের কব্জায় রাখে। প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করে; কিন্তু আলোচিত মাফিয়াগুলো কখনও সরাসরি রাষ্ট্রীয় উৎসাহ কিংবা প্রশ্রয় পায়নি। বরং আমরা ইতিহাস ঘাঁটলে দেখব, রাষ্ট্রীয় বাহিনী সমন্বিতভাবে মাঝে মাঝেই মাফিয়াদের ওপরে নানারকম অভিযান পরিচালনা করেছে, যাতে উভয়পক্ষে হতাহত হওয়ার বহু ঘটনা ঘটেছে। ইতালির শাসক বেনিতো মুসোলিনির মাফিয়াবিরোধী পদক্ষেপ মাফিয়া ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, হাজী সেলিম কি একা? যারা এ রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্রমরূপান্তর নিয়ে কিছুটা হলেও খোঁজখবর রাখি, তারা জানি এ রকম হাজী সেলিমের সংখ্যা এ দেশে অনেক। ক্ষমতা বা প্রভাবাধীন এলাকার বিবেচনায় কেউ হয়তো তার চেয়ে ছোট, আবার কেউবা বড়। সাম্প্রতিক ঘটনা না ঘটলে হাজী সেলিমের এত কিছু আবার নতুন করে আলোচনায় আসত না। ঠিক সেই কারণেই অন্য মাফিয়াদের আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এমন মানুষ এখন সংখ্যা ও ক্ষমতায় অনেক বেশি হলেও এটির অস্তিত্ব ছিল অতীতের সব সরকারের সময়েই।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট
