Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

Icon

ড. অরূপরতন চৌধুরী

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

এ দেশের মাটি থেকে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনীকে বিতাড়িত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি যে যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ, উদ্দীপনা, অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে এবং হানাদার বাহিনীকে সার্বক্ষণিক রেখেছে ভীতসন্ত্রস্ত তা হল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। আর এ মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক সরকারের দখলকৃত এলাকার ছয়টি বেতার কেন্দ্র থেকে অবিরাম মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ভয়াবহভাবে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জবাব দেয়া হয়েছে একমাত্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষের ওপর নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। খুনিদের হাত থেকে রক্ষার জন্য অসংখ্য মানুষ দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রথম থেকেই উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার।

এ বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলা ও ইংরেজি খবর, সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান ‘অগ্নিশিখা’, ‘চরমপত্র’, ‘বিশেষ কথিকা’, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে বাণী’ বজ্রকণ্ঠ এবং দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান ‘জাগরণী’। তবে তারও আগের ইতিহাস হচ্ছে, চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে সংগঠিত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের দশজন নিবেদিত কর্মীস্থানীয় নেতা, জনগণের সহযোগিতায়।

এ বেতার কেন্দ্রের সার্বক্ষণিক সংগঠক ছিলেন সর্বজনাব বেলাল মোহাম্মদ, সৈয়দ আবদুস শাকের, আবদুল্লাহ আল ফারুক, মোস্তফা আনোয়ার, রাশেদুল হোসেন, আমিনুর রহমান, শারফুজ্জামান ও কাজী হাবিবুদ্দিন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত শামসুল হুদা চৌধুরীর গ্রন্থে এসব তথ্যের উল্লেখ আছে। পরে এ বেতার কেন্দ্রের নাম থেকে বিপ্লবী কথাটি বাদ দেয়া হয়েছিল।

এ বেতার কেন্দ্রের ওপর প্রচণ্ড বাধা এলো কয়েকদিনের দিনের মধ্যে। শত্রুর বোমারুবিমান থেকে ৩০ মার্চ ’৭১ চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে বোমা ফেলা হল। উপায়ান্তর না দেখে সেসব বীর শব্দসৈনিক তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সহায়তায় একটি ক্ষুদ্র এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার বয়ে নিয়ে এলেন মুক্তাঞ্চলে। এ ট্রান্সমিটারের সাহায্যে বিছিন্নভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল আরও কিছুদিন।

অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধের প্রচার জোরদার করার উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে নতুন করে সংগঠনের দায়িত্ব অর্পিত হল আবদুল মান্নানের (এমএনএ) ওপর। পরবর্তীকালে কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ চলত ছোট্ট একটা দ্বিতল বাড়িতে। অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্য স্টুডিও ছিল মাত্র একটি। পরে আরও একটি কক্ষ খালি করে অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে এগুলোতে আধুনিক স্টুডিওর মতো কোনো শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রী।

কিন্তু সৃষ্টি হয়েছিল কালজয়ী কিছু গান যেমন: ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘নোঙর তোল তোল’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’-এ রকম আরও অনেক গান। দ্বিতল বাড়ির নিচতলায় ছিল আমাদের রান্নাঘর, ওখানেই আমরা খেতাম। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গানের রিহার্সেল এবং রেকর্ডিংয়ের কাজ শেষ করে ওই বাড়ির দোতলায় স্টুডিওর পাশের রুমে খোলা মেঝেতেই চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়তাম আমরা।

চরমপত্র (বিশেষ ব্যঙ্গরচনা), অগ্নিশিখা (মুক্তিবাহিনীর জন্য অনুষ্ঠান), জাগরণী (উদ্দীপনামূলক গানের অনুষ্ঠান) এবং ইংরেজি ও বাংলা খবর প্রভৃতি দিয়েই শুরু হয়েছিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। চরমপত্র লিখতেন এবং পড়তেন এম আর আখতার। অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা করেছিলেন আবদুল মান্নান (ভারপ্রাপ্ত এমএনএ)। অগ্নিশিখা মুক্তিবাহিনীর জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, প্রযোজনা এবং নামকরণ করেন টিএইচ শিকদার।

তখন আমি মাত্র ১৮ বছর বয়সের তরুণ, ঢাকা ডেন্টাল কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র। এ বয়সে নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুনে আমি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ি। যোগাযোগ করতে থাকি বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন জনের সঙ্গে। আমি ঢাকা থেকে জুন মাসে ঘর ছেড়ে (আরিচা-দাউদকান্দি প্রভৃতি স্থান তখন পাক আর্মি, রাজাকার ও আলবদরদের এক রণক্ষেত্র) সব বাধা অতিক্রম করে ভারতের আগরতলায় পৌঁছাই।

সেখানে গিয়েই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি এবং চলে যাই কলেজ টিলায়। সেখানে থাকতেন আমাদের নেতাকর্মীরা। তাদের সঙ্গে পূর্বপরিচয় থাকায় আমাকে পাঠিয়ে দেন মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দেয়ার জন্য নিয়মিত গান-বাজনা হতো। সেইসঙ্গে চলমান ছিল মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং। সেখানেই আমার সঙ্গে দেখা হয় মরমি কণ্ঠশিল্পী সরদার আলাউদ্দিনের।

আমি আর আলাউদ্দিন ভাই তখন একসঙ্গেই বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের গান করি। একদিন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতারে চলে যাব। যেই ভাবা সেই কাজ। আগরতলার ধর্মনগর থেকে ট্রেনে আসাম, দার্জিলিং, শিলং হয়ে দু’জনে চলে গেলাম কলকাতা। ইতোমধ্যে সংবাদ পেলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কলকাতায় কাজ শুরু করেছে। অবশেষে যোগদান করলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করার পর একজন কণ্ঠসৈনিক হিসেবে সংগীত পরিবেশনই ছিল আমার মূল কাজ। বহু সঙ্গীত পরিবেশন করেছি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। এর মধ্যে সমবেত ও দ্বৈত সংগীতও পরিবেশন করেছি। এ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত আমার প্রথম গাওয়া দ্বৈত সংগীতের (গানের কথা : জ্বলছে জ্বলছে প্রাণ, আমার দেশ আমার।) রচয়িতা ছিলেন শহীদুল ইসলাম, সুরকার: হরলাল রায়; সহশিল্পী ছিলেন তখনকার ইংরেজি সংবাদ পাঠক (পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর) প্রফেসর ড. নাসরিন আহমেদ।

গানটি প্রচারের দিন আমার নাম প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়। সেই দিন থেকেই বাংলাদেশে থাকা আমার মা, বাবা ও ভাইবোন জানতে পারে আমি বেঁচে আছি। কারণ, যুদ্ধে যাওয়ার কথাটি আমি কাউকে বলিনি, এমনকি আমার মা, বাবা এবং ভাইবোনকেও নয়। তবে যুদ্ধে গিয়ে তাদের জন্য আমার অনেক কষ্ট হতো। সেইসঙ্গে দেশে আমার পরিবারের সবাই ছিলেন অনেক দুশ্চিন্তায় ও উৎকণ্ঠায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। এ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত যুদ্ধসংবাদ, সঙ্গীত ও কবিতা, নাটক, কথিকা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। এ বেতার কেন্দ্রের সরব উপস্থিতি সেই সংকটকালে সবার জন্য ছিল বড় ধরনের অনুপ্রেরণার উৎস। সেই সময়ে এ বেতার কেন্দ্রের গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুধু অনুপ্রাণিত করেনি, সেইসঙ্গে যারা বাংলাদেশে ছিলেন তাদেরও উৎসাহিত করেছে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে। গানগুলো যখন নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় তখন তাদেরও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এ বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠসৈনিক ছিলাম আমি, এ জন্য আমি গর্বিত। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিকরা সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালির মনোবল অক্ষুণ্ন রাখার জন্য দিবারাত কাজ করেছেন। এ বেতার কেন্দ্রের একেকটি শব্দ বেরিয়ে এসেছে একেকটি বুলেট হয়ে। অনেক কণ্ঠশিল্পী, নাট্যকর্মী, সংবাদপাঠক, কলাকুশলী এবং সংগঠক স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন-যাদের অনেকেই আজ নেই, তাদের সবার নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। যারা বেঁচে আছেন তাদের অনেকে আজ বিছানায় শয্যাশায়ী, কেউ বা নিদারুণ অর্থকষ্টে দিনযাপন করছেন। আমাদের এখন প্রয়োজন তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো, তাদের জন্য কিছুটা হলেও সাহায্য করা।

ড. অরূপরতন চৌধুরী : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, অনারারি সিনিয়র কনসালটেন্ট ও অধ্যাপক, ডেন্টাল বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম