করোনা টিকার প্রায়োরিটি কিসের ভিত্তিতে?
ডা. জাহেদ উর রহমান
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের ভ্যাকসিন পাওয়ার পথ কি উন্মুক্ত হলো? ৪ জানুয়ারি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সিইও আদার পুনেওয়ালার বক্তব্যে যে সংশয় তৈরি হয়েছিল, ৫ জানুয়ারিতে পুনেওয়ালাসহ নানাজনের পালটা বক্তব্য কি সেই সংশয় দূর করতে পেরেছে পুরোপুরি? নানা যৌক্তিক কারণে আমি অন্তত এসব প্রশ্নের জবাবে নির্দ্বিধায় হ্যাঁসূচক জবাব দিতে পারছি না। কেন পারছি না, সেই আলোচনা এ কলামের বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত-না বলে সেদিকে যাচ্ছি না। এ কলামের আলোচনার স্বার্থে আমি ধরে নিলাম বাংলাদেশ খুব দ্রুতই সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পেতে যাচ্ছে।
করোনায় দুটি উদ্দেশ্যে টিকা দেওয়া যেতে পারে। একটা হচ্ছে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা, যাতে এ রোগটি আমাদের দেশে আর কাউকে আক্রান্ত করতে না পারে। এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে জনগোষ্ঠীর অন্তত ৭০ শতাংশকে যত দ্রুত সম্ভব টিকা দিয়ে দেওয়া। আরেকটি উদ্দেশ্য হতে পারে, এমন মানুষকে টিকা দেওয়া যারা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছে এবং করোনা হলে যাদের মৃত্যুহার বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। সেই ক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনা সংক্রমণ থাকবে এবং কম ঝুঁকির মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃদু বা মাঝারি উপসর্গ দেখা দিয়ে সেরে উঠবে। আর ঝুঁকিপূর্ণ মানুষ করোনায় আক্রান্ত না হলে করোনায় মৃত্যুহার অনেক কমে থাকবে।
১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে ২ ডোজ করে টিকা দেওয়ার জন্য যে সংখ্যক টিকা লাগবে সেটা ভীষণ বড়, যার পাশে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়া তিন কোটি ডোজ টিকাকে একেবারেই তুচ্ছ বলে মনে হয়। তার ওপর এ টিকা আসবে প্রতিমাসে ৫০ লাখ করে, ৬ মাস ধরে। সুতরাং বাংলাদেশ হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করার জন্য ভ্যাকসিন অন্তত আগামী ছয় মাসে দেওয়ার কোনো চেষ্টা করতে পারছে না। কথাটা একটু জোর দিয়ে এ জন্য বললাম, অন্যান্য সোর্স থেকে ভ্যাকসিন আনার মতো পূর্বপ্রস্তুতি সরকারের ছিল না, তাই সেটা সামনেও পাওয়া খুব কঠিন। পৃথিবীর সব দেশ এখন বিভিন্ন ভ্যাকসিন উৎপাদক-এর পেছনে দৌড়াচ্ছে। যারা আগে থেকে দৌড়াচ্ছিল তারাই সেসব ক্ষেত্রে সফল হবে।
বাংলাদেশ সব ডিম রেখেছিল এক ঝুড়িতে। যদিও এ সংকটের সময় বহু বিশেষজ্ঞ, এমনকি সরকারের কোভিড-১৯ টেকনিক্যাল কমিটির সদস্যরা বলেছেন তারা সরকারকে আগেই সতর্ক করেছিলেন এ ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে। ফলে তারা যেন আরও বিকল্প উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করার পদক্ষেপ নেন। কিন্তু সেটা না নেওয়ার মাশুল বহু মানুষ দেবে মৃত্যুবরণ করে, নিদেনপক্ষে রোগাক্রান্ত হয়ে।
মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল এমন মানুষকে টিকা দেওয়া, যারা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছে এবং করোনা হলে যাদের মৃত্যুহার বেশি। এমনকি যেসব দেশ খুব দ্রুত হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের লক্ষ্যে টিকা দেওয়া শুরু করেছে, তেমন দেশও এ পথই অবলম্বন করেছে। করোনার আঘাতের সবচেয়ে জর্জরিত দেশগুলোর একটা হচ্ছে ব্রিটেন। ব্রিটেন করোনার টিকা দেওয়া শুরু করেছে বেশ কিছুদিন হলো এবং খুব দ্রুত টিকা দিয়ে ব্রিটেন হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে চায়। জেনে নেওয়া যাক ব্রিটেনের টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রায়োরিটি কী।
সবার প্রথম টিকা পাবে বৃদ্ধাশ্রমে বাস করা মানুষজন এবং তাদের যারা সেবা দিচ্ছেন তারা। তারপর পাবেন ৮০ বছরের বেশি যে কোনো মানুষ এবং যারা ফ্রন্টলাইন হেলথ কেয়ার সার্ভিস দিচ্ছেন (ডাক্তার, নার্স, হেলথ টেকনিশিয়ান)। এরপর পাবেন ক্রমান্বয়ে যাদের বয়স ৭৫-এর বেশি এবং ৭০-এর বেশি তারা। তারপরের প্রাধিকার হচ্ছে ১৬ বছরের বেশি যে কোনো মানুষ যারা ভয়ংকর কোনো অসুস্থতায় আক্রান্ত (যেমন: ক্যানসার, ফুসফুসের মারাত্মক কোনো রোগ, অঙ্গ প্রতিস্থাপন)। এরপর ৬৫ বছরের বেশি মানুষ এবং ১৬ থেকে ৬৫ বছর বয়সের যে কোনো মানুষ, যাদের কোনো কঠিন রোগ আছে। এরপর ক্রমান্বয়ে ৬০, ৫৫ ও ৫০ বছরের বেশি বয়সের মানুষ।
এবার দেখে নেওয়া যাক টিকা দেওয়ার প্রায়োরিটির ক্ষেত্রে আমরা কী পরিকল্পনা করেছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন ভ্যাকসিনের প্রায়োরিটি তালিকাটি প্রস্তুত হয়েছে এবং সেটা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। সেই রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত কিছু তথ্য দেখে নেওয়া যাক:
প্রথম পর্যায়ের প্রথম ধাপে যে তিন শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আসবেন তারা হচ্ছেন সব ধরনের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা এবং সমাজকর্মী যারা কোভিড মোকাবিলায় সরাসরি জড়িত। এদের মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক, নার্স এবং মিডওয়াইফারি পেশায় নিয়োজিত কর্মী, মেডিকেল ও প্যাথলজিল্যাব কর্মীরা, পেশাদার স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা, সাইকোথেরাপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা, মেডিসিন পারসনেল, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স চালক মিলে তিন লাখ ৩২ হাজার।
সব সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, যারা স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন ধাপে কাজ করে কিন্তু সরাসরি কোভিড-১৯ মোকাবিলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, যেমন: স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যবস্থাপনা কর্মী, ক্ল্যারিক, বাণিজ্য কর্মী, লন্ড্রি কর্মী, অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য গাড়ির চালক এমন এক লাখ ২০ হাজার জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এ ছাড়া ২ লাখ ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা, ৫ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, যেমন: পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, আনসার, ভিডিপি সদস্য, তিন লাখ ৬০ হাজার অন্যান্য বাহিনী, যেমন: সেনাবাহিনী, নেভি, বিমানবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ড ও প্রেসিডেন্ট গার্ডের সদস্য, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ৫০ হাজার কর্মকর্তা, ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মী ৫০ হাজার জনকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হবে। এ ধাপে আরও যারা ভ্যাকসিন পাবেন তারা হচ্ছেন : জনপ্রতিনিধি, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা কর্মী, ধর্মীয় নেতা, দাফন ও সৎকারে নিয়োজিত কর্মী, ওয়াসা, ডেসা, তিতাস ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, প্রবাসী শ্রমিক, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মী, ব্যাংক কর্মী, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম রয়েছে এমন রোগী, রোহিঙ্গা এবং বাফার, জরুরি ও মহামারি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মী।
তালিকাটি পড়ার পর সবার কাছে এটা নিশ্চয়ই খুব স্পষ্ট হয়ে যায়, সরকার সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞান-এর আশপাশ দিয়ে হাঁটছে না, ন্যূনতম সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না। সরকারের টিকার মূল লক্ষ্য গণহারে সরকারের বিভিন্ন ধরনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের লোকজনকে টিকা দেওয়া। যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাদের বঞ্চিত করে সরকার তার নিজের লোকদের সন্তুষ্ট রাখাকেই মূল লক্ষ্য করেছে।
টিকা দেওয়ার এ কর্মযজ্ঞে আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। টিকার জন্য দেওয়া পরিকল্পনাটিতে বলা হয়েছে, টিকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি ও জনবল নিয়োগের মতো কাজ করতে ৮ সপ্তাহ বা দুমাসের মতো সময় লাগবে। এমন কোনো কাজ এখনো শুরু হয়নি। সরকারি ভাষ্যমতে জানুয়ারির শেষে টিকা বাংলাদেশ পৌঁছার কথা। তাহলে হাতে আছে আর মাত্র দুই সপ্তাহের কিছু বেশি। তাহলে লোকবল নিয়োগ কখন হচ্ছে? কেন আরও বহু আগে থেকেই এ ব্যাপারে কাজ শুরু করা হয়নি?
করোনার শুরু থেকে পরীক্ষা, পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া, কোয়ারেন্টিন-এর ব্যবস্থা করা, হাসপাতালের ব্যবস্থা, অক্সিজেনের ব্যবস্থা, আইসিইউর ব্যবস্থা, মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলানো, মাস্ক ব্যবহার করানো-সব ক্ষেত্রেই সরকার সাফল্য দেখাতে পারেনি। টিকার ক্ষেত্রেও একেবারেই অনুমিতভাবে একই রকম পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। আলোচনার খাতিরে ধরে নিই বাংলাদেশ ভ্যাকসিনের প্রায়োরিটির ক্ষেত্রে একটা সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করেছে। প্রশ্ন হলো সেই ক্ষেত্রেও কি সেটা বাস্তবায়িত হতো? আমরা একটু স্মরণ করি, করোনার শুরুর দিকে যখন ডাক্তাররা পিপিই না পেয়ে পলিথিন দিয়ে তাদের সুরক্ষার চেষ্টা করছেন, তখন সরকারি কর্মকর্তা পিপিই পরে অফিসে বসে পোস্ট দিচ্ছেন। আমরা আরেকটু স্মরণ করি, যখন করোনা টেস্টের জন্য টেস্ট সেন্টারগুলোর বাইরে মানুষের দীর্ঘ লাইন, তখন পত্রিকায় খবর এসেছে বেশ কিছু প্রভাবশালী বারবার করোনার টেস্ট করাচ্ছেন। আমাদের অভিজ্ঞতা আমাদের খুব স্পষ্টভাবে বলে দেয়, একটা সঠিক পরিকল্পনা হলেও সঠিক মানুষের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই ভ্যাকসিন পৌঁছত না। এই রাষ্ট্র প্রভাবশালীদের জন্য, প্রভাবহীনদের জন্য নয়।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাকটিভিস্ট
