সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি কী এবং কার জন্য
ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী হলো এমন একটি নিরাপদ বেড়াজাল, যার মাধ্যমে সমাজের অসহায় ও পিছিয়ে পড়া মানুষকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। এটি কোনো দেশের সার্বিক সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা বা কর্মসূচির একটি অংশ মাত্র। দেশে দেশে নিজ জনগণের প্রয়োজন অনুসারে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়ে থাকে।
সামাজিক নিরাপত্তা হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা, যা বিভিন্ন কর্মসূচি এবং আইনগত উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজের মানুষের মধ্যে পরস্পর সহাবস্থান এবং সম্পৃক্তির একটি সুষম পরিবেশ তৈরি করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুর্যোগের ফলে মানুষের মধ্যে সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা মোকাবিলা, বিভিন্ন আইনি সহায়তা এবং অসুস্থতা, বেকারত্ব, শিল্পদুর্ঘটনা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সহায়তা করা।
সামাজিক নিরাপত্তা আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের সামাজিক নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও এর প্রেক্ষাপট অতি পুরোনো। সামাজিক নিরাপত্তা আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অপরিহার্য কার্যক্রম হলেও প্রাচীন আমলে-এর প্রচলন ছিল। বর্তমানের মতো এ কর্মসূচি সুসংগঠিত না হলেও দানশীলতা, মানবতাবোধ ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে এ কর্মসূচি গ্রহণের উদ্যোগ দেখা যায়। প্রাচীন মিসর, গ্রিস, রোম, চীন, ভারতে এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। বিশ্ব মানবতার মহান মুক্তিদূত হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৬২২ সালে স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে যে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, খোলাফায়ে রাশেদীনের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা তার সুপথ প্রদর্শিত হয়ে দীর্ঘদিন মানবকল্যাণে ভূমিকা রেখে চলেছে। জননিরাপত্তার অধীন রাজস্ব আয়ের উদ্বৃত্ত অর্থ পুনর্বণ্টনের ব্যবস্থায় আদমশুমারি করে অসহায় মানুষ ছাড়াও কর্মচারী, মুজাহিদ এমনকি সদ্যোজাত সন্তানও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে স্থান পেত। শিল্পবিপ্লবের পর সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় এর বেষ্টনীও বেড়ে গেছে। ইংল্যান্ডে দরিদ্র জনগণের সহায়তার জন্য ১৫৩১ ও ১৬০১ সালে দরিদ্র আইন তৈরি হয়েছে। জার্মানির চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্ক ১৮৮৩ সালে সামাজিক নিরাপত্তা ভাবেন এবং ১৯১৭ সালে বলশেভিক তথা রুশ বিপ্লবের পর সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন ভাবনা দেখা যায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ১৯৩৫ সালে সামাজিক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেন। এ ছাড়া ১৯৪২ সালে যুক্তরাজ্যে লর্ড উইলিয়াম বিভারেজ কর্তৃক প্রণীত রিপোর্টের ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তা আইন ও কর্মসূচি তৈরি হয়। তার বর্ণনায় সামাজিক নিরাপত্তা হচ্ছে: ‘A job when you can earn and an income when you cannot.’ বর্তমান বিশ্বে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বিভিন্ন বিমা ও সাহায্যভাতার প্রচলন দেখা যায়। অসুস্থতা, বেকারত্ব, দুর্ঘটনা, অক্ষমতা ইত্যাদির জন্য সামাজিক বিমা এবং মাতৃত্ব, সিনিয়র সিটিজেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির জন্য আপৎকালীন সামাজিক সাহায্য দেওয়া হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের সংবিধানে সামাজিক নিরাপত্তা মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ সংবিধানে (পঞ্চদশ সংশোধন ২০১১ অনুচ্ছেদ ১৫(ঘ) মৌলিক প্রয়োজন ব্যবস্থা) সামাজিক নিরাপত্তার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে: ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।’
মৌল-মানবিক চাহিদা যাদের অপূরিত থাকে, যারা বিপর্যয় রোধ করতে পারে না অর্থাৎ দরিদ্র, বেকার, অসুস্থ, প্রতিবন্ধী, বিধবা, এতিম, পঙ্গু সৈনিক, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, নির্ভরশীল বয়স্ক, পরিত্যক্ত মহিলা ও শিশুরা এ নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় পড়বে। এদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী (categorically) ভাগ করে যারা কর্মক্ষম তাদের সাধ্যানুযায়ী কাজ দেওয়া এবং যারা কাজ করতে জানে না তাদের বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া ও যারা কাজ করতে অক্ষম তাদের আর্থিক অথবা বিভিন্ন বস্তুগত সাহায্য প্রদান করা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়, স্বল্প সময়ের জন্য এ কর্মসূচি চালু থাকতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি দেশে যেখানে দুই কোটি মানুষ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, সেখানে তাদের সমস্যার জন্য স্থায়ী সমাধান চিন্তা না করলে এ সাহায্যপ্রার্থীদের হাতের সংখ্যা দিন দিন আরও বৃদ্ধি পেতে থাকবে আর আমরা বর্তমান শতাব্দীভর দরিদ্রই থেকে যাব বইকি।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির দুটো মূল দিক থাকা উচিত
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির দুটো মূল দিকের মধ্যে একটি হলো সামাজিক বিমা ও অন্যটি সামাজিক সাহায্য ব্যবস্থা। বাংলাদেশে অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য দ্বিতীয়টি চালু থাকলেও প্রথমটি শুধু অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীরা পেয়ে থাকেন। কোনো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও বর্তমানে এর প্রচলন দেখা যায়। তাতে অতিদরিদ্র, অসহায় মানুষের জন্য কোনো সুখবর নেই। সামাজিক বিমার অধীন নাগরিক অধিকার, যেমন: বেকারভাতা, বার্ধক্যভাতা, দুর্ঘটনাভাতা, চিকিৎসাভাতা, বাসস্থানভাতা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় রয়েছেন মোট দাবিদারের মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ। ওএমএস, ভিজিডি ইত্যাদির মাধ্যমে যেটা প্রচলিত রয়েছে তা বিচ্ছিন্ন ও সাময়িক। এগুলো সামাজিক নিরাপত্তার সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না। এ ছাড়া বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির মধ্যে বাস্তবায়িত নির্মাণকাজগুলোয় মেয়াদ বিমার (warranty insurance) প্রচলন রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি সাইক্লোন শেল্টার বা কালভার্ট কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তৈরি করল, তা যদি ২০ বছর বা নির্দিষ্ট মেয়াদ না পেরোতেই ধসে যায়, তাহলে সেটার পুনর্নির্মাণ বা ক্ষতিপূরণ সেই প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হবে। দেশে এখন অনেক নতুন আইন প্রণীত হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির সুষ্ঠু জবাবদিহিতা নিশ্চিত তথা দেশের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা জরুরি।
এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারিভাবে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিতে আরও একটি বিষয় আসে। তা হলো সমাজসেবা। সমাজসেবার উদ্দেশ্য হলো প্রাথমিক ও প্রত্যক্ষভাবে মানবসম্পদ সংরক্ষণ এবং অনাচার ও অযাচিত অবস্থা প্রতিরোধ করে সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো। সমাজের বিত্তশালী, দানশীল, হিতাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি অথবা সরকারিভাবে এতৎসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠিত সমাজসেবা ইউনিট এসব কাজ করতে পারে।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি প্রকৃত গরিবের নিরাপদ বাজেট বরাদ্দ হওয়া উচিত
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যরোধে সামাজিক নিরাপত্তা খাত অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে। এখানে এ খাতগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অতীত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ‘চলতি বাজেটের (২০১১-১২) অন্তত সাতটি প্রকল্পে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি এবং ৪৩টি কর্মসূচিতে চলতি বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ কমানো হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পগুলোয় ১৬ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা মোট বাজেটের ৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
এ দেশে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতে যোগ্য সুবিধাভোগীর সংখ্যা দুই কোটি। এর ৭৫ শতাংশ মানুষ এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বলাই বাহুল্য, টাউট, বাটপাড় তো আছেই। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন কর্মসূচির অতিমিশ্রণ (overlapping) সারা পৃথিবীতে দাতাগোষ্ঠী ও গবেষকদের কাছে একটি মুখরোচক ব্যাপার।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী: যে দেশে বেড়ায় ধান খায়
এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো মাঝপথে এসে থেমে যায়। বরাদ্দকৃত বাজেট সময়মতো ছাড় পায় না, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাজেটে ঘাটতি পড়ে যায়। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা কৃত্রিম বাধার সম্মুখীন হয়। এসব বাধার পাহাড় ডিঙাতে নিরাপত্তাবেষ্টনীর বেড়া, খুঁটিগুলো দুর্নীতির জাল পাতে। এমনকি সামান্য বয়স্কভাতা পেতে ৮০ বছরের বৃদ্ধাকে ইউপি সদস্যের কাছে ঘুসের জন্য নাজেহাল হওয়ার কথা শোনা গেছে। একজন সৎ ইউপি চেয়ারম্যানের বয়স কম; কিন্তু তার উচ্চরক্তচাপ। এর কারণ জানতে চাইলে তার উত্তর হলো, অফিসের বড় স্যার যেদিন তার কাছে কমিশন চেয়েছেন সেদিন থেকে তার এ সমস্যা শুরু হয়েছে। কারণ, তিনি তাকে দেবতার মতো শ্রদ্ধা করতেন, এখন ঘৃণায় তার অফিসে পা মাড়ান না। এসব নানামুখী কৃত্রিম বাধার কারণে বরাদ্দকৃত অর্থের সামান্যই যোগ্য সুবিধাভোগীর হাতে পৌঁছায়।
ওএমএস দিয়ে দারিদ্র্য নিরসন ধারণা বাতুলতা মাত্র
২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমানোর পাশাপাশি উপকারভোগীর সংখ্যাও কমানো হয়েছে। দেশে ফি বছর বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা, নদীভাঙন, নিপীড়ন, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক হানাহানি, প্রতিহিংসা ইত্যাদির কারণেও বহু মানুষ দৈহিক, সামাজিক অথবা মানসিকভাবে পঙ্গুত্ববরণ করে অসহায় ও ভিক্ষুকে পরিণত হয়। আগেই বলেছি, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির দুটো মূল দিক থাকা উচিত। একটা সামাজিক বিমা ও অন্যটি সামাজিক সাহায্যব্যবস্থা। বাংলাদেশে প্রতিটি বাজেটেই সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বড় অঙ্কের বরাদ্দ থাকে। নিরাপত্তাবেষ্টনীর নামে সামাজিক সাহায্য দেওয়া হয়। সামাজিক বিমা বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ায় দরিদ্র মানুষগুলো সামাজিক সাহায্য নিয়ে সবটুকু খেয়ে ফেলে। তাই সামাজিক সাহায্য থেকে নির্দিষ্ট অংশ সামাজিক বিমার আওতায় এনে একটি পরিপূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কথা আগামী বাজেটে চিন্তায় আনতে হবে। এ জন্য পেশাদারি সমাজকর্ম বিষয়ের জ্ঞান প্রয়োগ প্রয়োজন। কারণ, আমরা চল্লিশ বছর ধরে এ বিষয়টিতে অপেশাদার পরিকল্পকদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আরও দরিদ্র হচ্ছি। এতে সুবিধাভোগীরা স্বাবলম্বী হওয়ার পরিবর্তে সুবিধাপ্রদানকারীরা অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির যথার্থ জবাবদিহিতা নেই
দেখা যায়, নদীভাঙন বা বন্যা শুরু হলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তখন তড়িঘড়ি করে দিনে-রাতে বালির বস্তা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। মন্ত্রী থেকে কর্মচারী সবার ঘুম হারাম হয়ে যায়। কিন্তু যে কাজটি শুষ্ক মৌসুমে সময় নিয়ে যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যেত, অদৃশ্য কারণে তখন সেটা করা হয় না। সরকারি জরুরি নির্মাণ কাজে অবহেলা করে ব্যয় বাড়ানোর প্রবণতা এখন মামুলি ব্যাপার। এ ধরনের অবহেলিত বাস্তবতা চলতে থাকলে বাংলাদেশের দরিদ্রাবস্থা যুগ যুগ ধরে বিশ্ববাসী খোলা জায়গায় দেখতেই থাকবে, জাদুঘরে রাখা হবে না।
প্রতিবছর নদীতীরবর্তী মানুষজন এক কূলে ভাঙনের শিকার হয়ে অন্য কূলে জেগে ওঠা চরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু এটা চরম সত্য, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে ফিলিপিনস, বালি, পাতোয়া, ওকিনাওয়া প্রভৃতি দ্বীপে সমুদ্রপাড় বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা ও নিজ প্রচেষ্টার সমন্বয়ে বাঁধা হয়েছিল। এখনো সেসব বাঁধ সুউচ্চ সামুদ্রিক ঝড় প্রতিরোধ করছে। আমরাও বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে বহু অর্থ খরচ করে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রপাড়ে এবং সমুদ্র উপকূলে মাটির বাঁধ নির্মাণ করেছিলাম। সেগুলো শুধুই ভেঙে যায়, বন্যা-ঝড় প্রতিরোধ করে না। গলদটা কোথায়? আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বৈঠকে আমাদের কটূক্তি শুনতে হয়: তারা একবার বাঁধ বেঁধেছে, ভাঙেনি; বাংলাদেশ ফি বছর বাঁধে, টেকে না! তখন মনে হয় আমরা অদক্ষ অথবা খারাপ মানুষ। এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ দিয়ে ভেবে দেখা উচিত।
নদীতীরবর্তী মানুষ, চরাঞ্চলের জনগোষ্ঠী এবং এদের ভাগ্যোন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির অধীন ২০১৯-২০ বাজেটে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তার যথার্থ ব্যবহার হয়ে অসহায় মানুষগুলো ভালোভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা খুঁজে পাক-এটা সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখাতে হবে। এ মানুষগুলো যেন আমাদের কাছে বারবার হাত না পাতে আর আমরাও যেন বিদেশি প্রভুদের কাছে বারবার ধরনা না দিই।
যেসব মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা নেই, তাদের সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। এদের সংখ্যা অনেক। তাই মানবিক করণে হলেও এ খাতে বরাদ্দ কমানো যাবে না; বরং বাড়াতে হবে। দারিদ্র্যবিমোচন কৌশলপত্রে (পিআরএসপি) ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনাসহ জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য সমর্থনমূলক কৌশল হিসাবে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী পিআরএসপি এর অনেকাংশ জুড়ে ছিল। নিরাপত্তাবেষ্টনীতে নগদ অর্থপ্রদান, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বকর্মসংস্থানে ক্ষুদ্রঋণ, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তাদের ভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি, ইত্যাদির উল্লেখ ছিল। পিআরএসপি বাস্তবায়ন হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এমডিজি, এসডিজির কাজ চললেও এখনো শহরমুখী নদীভাঙা ও গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের ঢল কমেনি। এ জন্য সামনে আর সামান্য সময় বাকি। এ জন্য জরুরি বিষয় হলো, বরাদ্দকৃত অর্থ যেন এ ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী সঠিকভাবে পায়, তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ২০১২-১৩ বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে এ যুক্তিতে যে, এখানে খুব বেশি দুর্নীতি হয়। ২০১৯-২০ সালে কিছুটা গুরুত্ব দেওয়া হলেও রাজনৈতিক বা দলকানা নীতির মধ্যে এটাকে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। দলীয় ও স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব থেকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে মুক্ত রাখতে হবে। কারণ, অসহায় মানুষকে সরকারি সাহায্য দিয়ে নির্বাচনে ভোট প্রার্থনা করার মতো হীন রাজনৈতিক চিন্তা বাংলাদেশের দারিদ্র্যকে দীর্ঘায়ুদানের অন্যতম প্রধান কারণ। সেটি না করে বরং সম্বলহীন, অসহায় মানুষকে স্বাবলম্বী করুন।
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান
