কিছুমিছু
বউয়ের কাছ থেকে বলদ উপাধি পাওয়ার পর...
মোকাম্মেল হোসেন
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
লোকমানের মুখে গরম পরোটা। সেটায় কামড় বসানোর আগমুহূর্তে শরাফত এসে সামনে দাঁড়াল। শরাফতের হোটেলে অনেকেই বাকিতে খাওয়া-দাওয়া করে। লোকমানও খায়। শরাফত কি বাকির খাতায় ঝাঁকি দিতে এসেছে? পরোটা মুখে রেখেই লোকমান জানতে চাইল-
: কিছু বলবা?
: হ।
: এক মিনিট।
বক যেভাবে জ্যান্ত মাছ গিলে খায়, পরোটার টুকরাটা সেভাবে পেটে চালান করার পর লোকমান বলল-
: যদি বাকি-বাট্টার বিষয়ে কিছু বলতে চাও, তাইলে আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুইলা আবেদন জানাব-ইয়া গাফুরুর রাহিম, আপনে শরাফত মিয়ারে ধৈর্য দান করেন।
মোনাজাতের ভঙ্গি শরাফতের মুখে হাসি ফোটাল। এটা ভালো লক্ষণ। এ হাসি যাতে ফানুসের ন্যায় সহসা হাওয়ায় মিলিয়ে না যায়, সে চেষ্টা করা দরকার। আবুলের কাঁঠাল প্রকল্পের কথা মনে পড়ল। অষ্টধার হাইস্কুলে পড়ার সময় আবুল প্রথমে লোকমানের সহপাঠী ছিল। পরে বার্ষিক পরীক্ষায় ডাব্বা মেরে এক বছরের জুনিয়র হয়। একবার সহপাঠীর কাছ থেকে পুরাতন একটা সাইকেল কেনার বন্দোবস্ত করার পর লোকমানের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিল আবুল। বলেছিল, চৈত্র মাসে আলু বিক্রি করে লোকমানের পাওনা পরিশোধ করবে। প্রতিবছরের ন্যায় সেবারও ব্রক্ষ্মপুরের চরজুড়ে মিষ্টি আলুর আবাদ হলো। চৈত্র মাসে অন্যান্য কৃষকের পাশাপাশি আবুলের বাবাও যথারীতি আলু বিক্রি সম্পন্ন করলেন; কিন্তু পাওনা টাকা আর আদায় করা গেল না। এ সময় একদিন অষ্টধার বাজারে যাওয়ার পথে আবুলের সঙ্গে দেখা হলো লোকমানের। আবুলের কাঁধে একটা পাকা কাঁঠাল। তাগাদা দিয়ে লোকমান বলল-
: কিরে! তুই কইছিলি চৈত্র মাসে টাকা দিবি। চৈত্র গেল, বৈশাখ পার হলো। অহন জ্যৈষ্ঠ মাসও যাই-যাই করতেছে; অথচ পাওনা পরিশোধের কোনো লক্ষণই তর মধ্যে দেখতেছি না!
লোকমানের কথা শেষ হতে না হতেই ফূর্তিমাখা গলায় আবুল বলল-
: দোস্ত! আর কোনো টেনশন নাই। টাকার ব্যবস্থা কইরা ফেলছি।
: তাইলে দিয়া দে। ঝামেলা শেষ।
আবুল কাঁধের কাঁঠাল মাটিতে রেখে বলল-
: আর কয়টা দিন ধৈর্য ধর। তর কাছে ঋণী থাকব না-এই নিয়ত কইরাই আব্বারে দিয়া বাজার থেইকা এই কাঁঠালটা কিনাইছি।
: কাঁঠালের সঙ্গে পাওনা পরিশোধের কী সম্পর্ক?
: সম্পর্ক আছে। কাঁঠালের কোয়াগুলা পেটে রপ্তানি করার পর সেইগুলা হজম হওয়ার আগেই সবচাইতে ভালো বিচিটা বিসমিল্লাহ বইলা মাটিতে পুঁইতা দিব। ইনশাআল্লাহ বিচি থেইকা গাছ হবে। সেই গাছে কাঁঠাল ধরবে। এরপর সেই কাঁঠাল বিক্রি কইরা সর্বপ্রথম তর পাওনা পরিশোধ করব। বিলিভ মি।
পাওনা পরিশোধের পরিকল্পনা শুনে লোকমান হাসি দমন করতে পারল না। লোকমানকে হাসতে দেখে আবুল বলল-
: দোস্ত! টাকা-পয়সা আসলেই মারাত্মক জিনিস। টাকার কথা শুনলে ফকির থেইকা শুরু কইরা রাজা-বাদশার মুখেও হাসি ফুটে। এই দেখ, যখনই তুই শুনলি টাকা পাওয়া যাবে, অমনি তর মুখে হাসি ফোটছে।
এখন জ্যৈষ্ঠ মাস। বাজারে পাকা কাঁঠালের অভাব নেই। শরাফতের সামনে কাঁঠাল প্রকল্প উপস্থাপন করলে বিষয়টা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যেতে পারে। এক মুহূর্ত চিন্তা করে লোকমান বলল-
: ভাবছিলাম, বৈশাখী ভাতা পাওয়ার পর বাকির হিসাব শূন্যের কোঠায় নামাইয়া আনব। কিন্তু কপাল খারাপ। রাজকর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৈশাখী ভাতা পাইলেও বেসরকারি কামলাদের পকেটে তা ঢুকে নাই। তবে চিন্তার কিছু নাই। সামনে কোরবানি ঈদের বোনাস আছে। বোনাস পাওয়ার পর...
আবুল ফর্মুলা অনুযায়ী শরাফতের মুখে হাসি ফোটার কথা। সে হাসছে না। ঘটনা কী! শরাফত যদি মনে করে, লোকমান তার সঙ্গে ইয়ার্কি করছে, তাহলে বাকির খাতা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। লোকমান ভবিষ্যৎ সুরক্ষার উপায় খুঁজছে, এ সময় গম্ভীর গলায় শরাফত বলল-
: স্যার! আপনে আমারে বলদ বলেন।
লোকমানের মুখ হা হয়ে গেল। কী আশ্চর্য! আগা নাই, পাছা নাই; মাঝখান থেকে একজন মানুষকে সে বলদ বলবে কেন? শরাফতের কাছে লোকমান জানতে চাইল-
: দেখ তো, আমার হা-করা মুখের ভেতরে আলাজিভ দেখা যাইতেছে কিনা?
লোকমানের কথা শুনে শরাফত প্রথমে অবাক হলেও পরে মাথা নিচু করে পর্যবেক্ষণ শেষে জানাল-
: হ। দেখা যাইতেছে।
: তোমার কথা শুইনা আমি আশ্চর্য হওয়ার সর্বশেষ স্তরে উপনীত হইছি-এর প্রমাণ হইল গলার মধ্যে লুক্কায়িত আলাজিভ দৃশ্যমান হওয়া। এইবার কও, আমার মুখ থেইকা বলদ ডাক শুনতে চাও কোন দুঃখে! তুমি কি নিজেরে বলদ মনে করো?
: না।
: তাইলে?
: অন্য একজন মনে করে।
: কে সে?
: আমার বউ।
শরাফতকে দিলখোলা হাসি উপহার দিলো লোকমান। স্ত্রীরাজ্যে প্রতিদিন বেশুমার শব্দ উৎপন্ন হয়। সেগুলো গায়ে মাখলে মাথার নাট-বল্টু আলগা হয়ে ‘লুজ কানেকশন’ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। আজ সকালের কথাই ধরা যাক। গায়ে জামা চাপাতে গিয়ে লোকমান দেখল, এক জায়গায় ছেঁড়া। গুটি বেগমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে বলল-
: জামাকাপড় কাঁচতে গিয়া ছিঁড়ল, না ফাটল-খেয়াল করবা না?
লোকমানের কথা শুনে গুটি বেগম তিড়িংবিড়িং করে উঠল। কঠিন স্বরে বলল-
: ফাটার জিনিস হইলে ফাটবে না? তোমার এই জামার মধ্যে আছে কিছু? গায়ে দিতে দিতে এইটার আত্মা মাইরা ফেলছ!
: আত্মা মরছে, না বডি মরছে-তোমার কাছে সেইটা জানতে চাই নাই। এরপর থেইকা দয়া কইরা কাপড়গুলা একটু যত্ন কইরা কাঁচবা।
: অসম্ভব। কাঁচকিমাছের মতো টিইপা টিইপা এইসব ন্যাকড়া ধোয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। এইবারের বাজেটে ওয়াশিং মেশিনের দাম কমানো হইছে। যাও, ওয়াশিং মেশিন কিইন্যা আনো।
: সম্ভব না।
: সম্ভব না হইলে কাপড় কাঁচার জন্য আলাদা লোক রাখো।
: এইটাও সম্ভব না; বরং এখন থেইকা নিজের কাপড় নিজেই কাঁচব।
: নিজেই কাঁচবা?
: হ। বাদশা নাসিরুদ্দিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করব। জানো তো-রান্না করার সময় একবার বাদশা নাসিরুদ্দিনের বেগম সাহেবার হাত পুইড়া গেছিল। তিনি স্বামীর কাছে অ্যাসিটেন্ট হিসাবে একজন বাঁদি নিয়োগের আবেদন জানাইলে বাদশা বলেছিলেন- দায়িত্ব পালন বাবদ রাজকোষ থেইকা যে কয় টাকা বেতন পাই, তা দিয়া সংসার চালাইতেই হিমশিম খাইতে হয়। বাড়তি লোক কেমনে নিয়োগ করব? এক কাজ করি-তোমার হাত ভালো না হওয়া পর্যন্ত রান্নাবান্নার কাজকাম আমিই করব। ইতিহাসের বর্ণনা শেষে গুটি বেগমের দিকে তেরছা চোখে তাকিয়ে লোকমান বলল-
: কী বুঝলা?
গুটি বেগম কিছুক্ষণ থুম ধরে থাকার পর বলল-
: ইতিহাস কেবল বাদশা নাসিরুদ্দিনরে লইয়া রচিত হয় নাই; মোগল সম্রাটদের নামও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করা আছে। সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রীর জন্য কী করেছেন, সেইটা বলো না কেন?
: আরে! শাহজাহান তো একটা ভণ্ডলোক ছিল। তার হেরেমে নারীর সংখ্যা কত ছিল, সেই তথ্য জানা আছে তোমার? থাক, জাইনা কাজ নাই; মাথা ঘুইরা পইড়া যাবা। ওই ব্যাটা শাহজাহান গণ্ডায় গণ্ডায় নারীর সঙ্গে মৌজ-মাস্তি শেষ কইরা জীবনের পড়ন্ত বেলায় মরহুমা মমতাজ মহলরে আঁকড়াইয়া ধইরা নিজে অমর হওয়ার ফন্দি-ফিকিরে তাজমহল নির্মাণ করছে। আরে! কেউ মইরা গোরস্থানে চিৎ হওয়ার পর তার জন্য তাজমহল গড়লেই কী, আর শীশমহল বানাইলেই কী! তোমার কি জানা আছে-১৪ নম্বর সন্তানের জন্ম দিতে গিয়া মমতাজ মহলের মৃত্যু ঘটেছিল! মরহুমার জীবদ্দশায় সম্রাট শাহজাহান তারে বছর-বছর গর্ভবতী করা ছাড়া আর কী করছে-কও আমারে!
শরাফতের ডাকে লোকমানের ভাবনার জাল ছিন্ন হলো। সে চোখ তুলে তাকাতেই অনুযোগের সুরে শরাফত বলল-
: স্যার, হাসি মাইরা নীরব হইয়া গেলেন; কিছু তো কইলেন না!
জোরে দম ছেড়ে লোকমান বলল-
: কী যে বলি তোমারে! বিশ্ববিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের নাম শুনছো?
: না।
: আলেকজান্ডার যুদ্ধ কইরা তামাম দুনিয়া কেপচার করেছিলেন। সেই আলেকজান্ডারকে তার বউ কী বলত- জানতে চাও?
: বলেন।
: উঠতে-বসতে ছাগল বইলা গালি দিতো।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন কিনা, জানা নেই লোকমানের। তবে মহাবীর আলেকজান্ডারের বউ ছিল এবং সেই বউ তাকে কথায়-কথায় ছাগল বলত শুনে শরাফত খুশি হলো। একজন সুখী মানুষ চারপাশে আর কোনো সুখী মানুষ আছে কিনা, তা দেখার প্রয়োজন অনুভব করে না। তবে দুঃখী তার দুঃখ ভোলার জন্য চারপাশে হাজারটা দুঃখী মুখ খুঁজে বেড়ায়। পরোটা খাওয়া শেষ। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে শরাফতকে লোকমান বলল-
: ছাগলের চেয়ে আকারে-আয়তনে বলদ অনেক বড়। আলেকজান্ডারের চাইতে তুমি ভালো অবস্থানে আছো। ঠিক কিনা?
: ঠিক।
: এইবার আমার প্রশ্নের উত্তর দেও।
: বলেন।
: তোমার বউ তোমারে বলদ বলছে, ভালো কথা। তার সুরে সুর মিলাইয়া আমাকেও একই কথা বলতে হবে কেন?
: স্যার, এইটা হলো মেন্টাল বিষয়। বউয়ের কাছ থেইকা বলদ উপাধি পাওয়ার বিষয়টা কিছুতেই হজম করতে পারতেছি না। সেইজন্য আপনেরে বলদ বলতে বলছি, যাতে আপনের বক্তব্যের নিচে নারীজাতির বক্তব্য চাপা পইড়া যায়।
যুক্তি খারাপ না। লোকমান হেসে বলল-
: নারীজাতি কী জন্য তোমারে বলদ উপাধি দিছে, জানতে পারি?
: কিছুদিন আগে সে বায়না ধরেছিল, একটা বিদেশি সেন্টের বোতল কিইন্যা দেওয়ার জন্য। আজ দেই, কাল দেই করতে করতে আর দেওয়া হয় নাই। এইবারের বাজেটে বিদেশি সেন্টের দাম বাইড়া যাওয়ার সংবাদ টেলিভিশনে দেখার পর পোলাপানের সামনেই সে আমারে বলল-
: তুমি একটা বলদ।
শরাফতের কথা শুনে সমবেদনা জানিয়ে লোকমান বলল-
: বাজেট আসলেই একটা কুদরতি জিনিস। এর চক্করে পইড়া তুমি যেমন চিপা খাইছো, তেমনি আমিও চাপে পড়ছি। কাজেই, এইটা লইয়া দুঃখ না কইরা আসো, চাপ-চিপ খাওয়া খালাত ভাই হইয়া এই বাজেটের উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন করি।
মোকাম্মেল হোসেন : সহকারী সম্পাদক, যুগান্তর
mokamia@hotmail.com
