Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আশেপাশে চারপাশে

নদীভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা জরুরি

Icon

চপল বাশার

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নদীভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা জরুরি

বর্ষার শুরুতেই নদীভাঙন শুরু হয়েছে বিভিন্ন জেলায়। প্রতি বছর প্রধান প্রধান নদীর তীরে বিভিন্ন স্থানে ভাঙন শুরু হয় জুন থেকে, চলে আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

এই কয়েক মাসে নদীগর্ভে চলে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। বহু গ্রাম, জনপদ, ফসলের জমি হারিয়ে যায় নদীভাঙনে। হাজার হাজার মানুষ গৃহহারা, নিঃস্ব হয়।

বছরের এ সময়টা নদীতীরের ভাঙন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন এটা দেশবাসীর ভাগ্যের লিখন। সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে নদীভাঙনের খবর আসছে। ভাঙনের খবর আসবে আরও কয়েক মাস।

নদীভাঙনের শিকার মানুষগুলো সব কিছু হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেবে অথবা শহরাঞ্চলে ভিড় জমাবে জীবন-জীবিকার তাগিদে। নদীভাঙনের মতো নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাতীয় অর্থনীতি।

নদীভাঙন রোধের কি কোনো উপায় নেই? নাকি এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ভাগ্যের লিখন বলেই মেনে নিতে হবে? এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) একজন সাবেক মহাপরিচালক তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছেন, ‘নদীভাঙন অবশ্যই রোধ করা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা নিয়েই তা করা যায়। এজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের মধ্যে কার্যকর ও জোরদার সমন্বয়, ভাঙন ঠেকানোর উপযোগী নকশা প্রণয়ন, পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ, সময়মতো প্রকল্পের কাজ শুরু করা এবং দ্রুত শেষ করা।’ নদীভাঙন রোধে বাঁধ দেওয়া ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মূল দায়িত্ব পালন করে পাউবো। এজন্য প্রতি জেলায় পাউবোর অফিস রয়েছে। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীর অধীনে প্রয়োজনীয় জনবল থাকে। তারা সংশ্লিষ্ট এলাকায় নদীর গতিবিধি ও ভাঙন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠান।

পাউবো ছাড়াও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরও কয়েকটি সংস্থা রয়েছে, যারা নদীভাঙন সম্পর্কিত পূর্বাভাস দেন, গবেষণা করেন, নদী ব্যবস্থাপনার উপযোগী মডেল ও নকশা তৈরি করেন। এসব সংস্থার রিপোর্ট এবং মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলীদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে পাউবো নদীভাঙন রোধের পরিকল্পনা ও প্রকল্প তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায় অনুমোদন ও বাজেট বরাদ্দের জন্য। অনুমোদন ও বরাদ্দ পাওয়া গেলেই কাজে হাত দেওয়া হয়।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) নামে একটি গবেষণা সংস্থা রয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। উপগ্রহের মাধ্যমে প্রাপ্ত ছবি ও তথ্যের ভিত্তিতে এ সংস্থা নদীভাঙনের পূর্বাভাস দিচ্ছে ২০০৪ সাল থেকে। মূলত দেশের প্রধান নদী যমুনা, গঙ্গা ও পদ্মার তীরের কোনো কোনো স্থানে ভাঙন হতে পারে এবং নদীর গতিপথ বা স্রোতধারা কোথাও পরিবর্তিত হতে পারে কিনা সে সম্পর্কেই সংস্থাটি পূর্বাভাস দিয়ে থাকে।

এ সংস্থার পূর্বাভাস ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সঠিক বলে দাবি করা হয়। সিইজিআইএস চলতি মৌসুমের জন্য যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তাতে বলা হয় ১৩টি জেলার ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভাঙনের ফলে নদীগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে। এটি গত বছরের চেয়ে বেশি।

২০২০ সালে নদীতীরের ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভাঙনের ফলে বিলীন হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছরের দীর্ঘস্থায়ী বন্যা নদীতীরের যে ব্যাপক ক্ষতি করে গেছে, সে কারণেই এবার ভাঙন ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

যে ১৩ জেলা এবার নদীভাঙনের কবলে পড়তে পারে সেগুলো হচ্ছে-কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, রাজশাহী, ফরিদপুর ও মাদারীপুর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা মাদারীপুর জেলায়। সেখানে সাড়ে ৯ বর্গকিলোমিটার জমি নদীগর্ভে যেতে পারে। গঙ্গা ও যমুনার তীরে ২০টি স্থান ‘সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। টাঙ্গাইল, গাইবান্ধা ও রাজবাড়ী জেলার ৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা এবার নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সিইজিআইএস ছাড়া আরও যেসব প্রতিষ্ঠান নদী সম্পর্কিত গবেষণা করে, তার মধ্যে ফরিদপুরের নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডাব্লিউএম) অন্যতম।

এ দুটি প্রতিষ্ঠান বন্যার পূর্বাভাস, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে এবং সরকারকে রিপোর্ট ও সুপারিশ প্রদান করে। সবকটি সংস্থার পূর্বাভাস ও রিপোর্ট এবং নিজস্ব প্রকৌশলীদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে পাউবো নদীভাঙন রোধের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নদীভাঙন নিয়ে গবেষণা ও সুপারিশ করলেও ভাঙনরোধের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাউবোর। কিন্তু এক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব লক্ষ করা যায়।

সিইজিআইএস নদীভাঙনের পূর্বাভাস এবার দিয়েছে জুনের প্রথম সপ্তাহে। কিন্তু নদীর ভাঙন তখনই শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন স্থানে। এই পূর্বাভাস যদি আরও আগে, অন্তত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে দেওয়া যেত, তাহলে পাউবো তখনই জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে পারত, নদীভাঙনও ঠেকানো যেত কার্যকরভাবে। ভাঙন যেখানে চলতে থাকে, সেখানে তখনই বালুর বস্তা ফেললে তা কার্যকর হবে বা ভাঙন বন্ধ হবে, তা আশা করা যায় না। সময়মতো কাজ শুরু করলে এবং তা দ্রুত শেষ করলে নদীভাঙন অবশ্যই রোধ করা যায়।

পাউবো এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় গড়ে তোলার দায়িত্ব উচ্চতর কর্তৃপক্ষ তথা মন্ত্রণালয়ের। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সার্বক্ষণিক নজরদারি পাউবো ও অন্যান্য সংস্থার মধ্যে কার্যকর ও জোরদার সমন্বয় সৃষ্টি করতে পারে, যার মাধ্যমে নদীভাঙন রোধের কার্যক্রম ফলপ্রসূ করা সম্ভব।

নদীভাঙন রোধের জন্য পাউবো প্রকল্প তৈরি করে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন অনেক বিলম্বিত হয়। প্রায় সব প্রকল্প বাস্তবায়নেই এক বা দুবছর লেগে যায়। এজন্য পাউবো প্রকল্প অনুমোদনে মন্ত্রণালয়ের বিলম্ব এবং পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ না পাওয়ার কথা বলে থাকে।

মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প অনুমোদন ও বাজেট বরাদ্দে দীর্ঘসূত্রতা একটি সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রেই এই অভিযোগটি পাওয়া যায়। নদীতীরের ভাঙন রোধে যথাসময়ে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

নদীভাঙন রোধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ তৈরির কাজ জনস্বার্থে অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজের জন্য কোনো পর্যায়েই দীর্ঘসূত্রতা বা বিলম্ব কাম্য নয়। বরং এ ধরনের প্রকল্পকে জরুরি ভিত্তিতে অগ্রাধিকার দিয়ে পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করা উচিত। কারণ এর সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এবং জাতীয় অর্থনীতির প্রশ্ন জড়িত।

নদীভাঙন রোধে সিজিআইএসের পূর্বাভাসের জন্য অপেক্ষা করা উচিত নয়। নদীতীরের মানুষরা, বিশেষ করে যারা প্রবীণ ও অভিজ্ঞ তারা কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারেন, নদীর ভাঙন আসন্ন কিনা। নদীপাড়ে দীর্ঘকাল বসবাসের কারণে তারা নদীর গতিধারা, নদীর স্রোতের তীব্রতা থেকেই ধারণা করতে পারেন নদীর ভাঙন কখন কোথায় শুরু হবে। পাউবোর প্রকৌশলীরাও শিক্ষিত ও দক্ষ। তাদেরও বোঝা উচিত ঠিক কোন জায়গায় নদীভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে।

নদীপাড়ের প্রবীণ মানুষদের অভিজ্ঞতা ও মতামতকে আমলে নিয়ে নিজেদের দক্ষতায় প্রকৌশলীরা ভাঙনের সম্ভাব্য স্থান চিহ্নিত করে কাজ শুরু করে দিতে পারেন জরুরি ভিত্তিতে। এ ধরনের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ বিস্তীর্ণ এলাকা রক্ষা করতে পারে ভাঙনের কবল থেকে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পাউবোকে নদীভাঙন রোধে আগাম ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। শুধু উপগ্রহের পূর্বাভাসের অপেক্ষায় বসে থাকলে সবকিছু তলিয়ে যাবে নদীগর্ভে।

ভাঙন রোধে নদীতীরের দুর্বল স্থানগুলোতে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন ভাঙনপ্রবণ স্থানগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সিমেন্ট কংক্রিট ব্লক (সিসিব্লক) ফেলে নদীতীরকে মজবুত করা, যাতে নদীর তীব্র স্রোতকে ঠেকানো যায়। এ ছাড়া বালুর বস্তা তথা জিও ব্যাগ, বাঁশের তৈরি খাঁচা (পারকুপাইন) ফেলেও নদীতীরকে শক্ত রাখা যায়।

যা বলা হলো, তার সবকিছুই পাউবো কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় জানে। সদিচ্ছা থাকলে নদীভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন কিছু নয়। নদীভাঙন বন্ধ করা গেলে লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা বাঁচবে।

আশ্রয় ও জীবিকার সন্ধানে তারা শহরাঞ্চলে ছুটে আসবে না। বিস্তীর্ণ ফসলের জমি নদীতে তলিয়ে যাবে না, জনপদ, অবকাঠামো বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। একইসঙ্গে তা জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী রাখতে অবদান রাখবে।

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

 

বর্ষার শুরুতেই নদীভাঙন.

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম