Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তারুণ্যের পথিকৃৎ শেখ কামাল

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তারুণ্যের পথিকৃৎ শেখ কামাল

শোকাবহ আগস্ট মাস। জন্ম-মৃত্যুর করুণ অবগাহনে আনন্দ-বিষাদের ধূসর চন্দ্রাতপ আচ্ছাদনে বিশ্বের সমগ্র বাঙালির স্মরণ জগতে গভীর প্রজ্ঞপ্তি প্রতিধ্বনিত হয়।

১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট জন্ম এবং ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে সপরিবারে শাহাদাতবরণের অমর-অক্ষয় অধ্যায়ের সূচনা। পৃথিবী নামক এ ধরিত্রীর কিংবদন্তি অবিসংবাদিত বিশ্বনেতা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতাসহ পরিবারের সব শহিদ সদস্যের স্মৃতির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা নিবেদন করে অকুতোভয় শহিদ শেখ কামালের জন্মের প্রতিকর্ষকেও হৃদয়ের আড়াল করা কোনোভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।

বিশিষ্ট গীতিকার প্রয়াত মো. নুরুল হুদা রচিত এবং খ্যাতিমান সুরকার প্রয়াত লাকী আকন্দ সুরারোপিত একটি গান আমাদের সময়কালের তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে গভীর ক্রন্দনের স্মৃতিকে এখনো বেঁচে থাকা প্রৌঢ়ত্বের মানুষগুলোকে প্রচণ্ড আবেগতাড়িত করে। ‘আগে যদি জানিতাম, তবে মন ফিরে চাইতাম- এই জ্বালা আর প্রাণে সহে না’ শিল্পীর এ গান ও কথামালা পোড়ামনে বারবার সেই স্মৃতিকে তীব্র বেদনাদায়ক করে তুলছে। জনশ্রুতি আছে, এ গানটি শহিদ শেখ কামালের স্মরণেই প্রণীত হয়েছিল।

আমাদের কলেজ ও পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রজীবনে, এমনকি এখনো নিগূঢ় এক যন্ত্রণাকাতর দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এ গানটি। আমাদের ছাত্রজীবনকালে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন তথা মুজিববাদে নিরন্তর বিশ্বাসী ছাত্র-যুবকদের মনে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র জাতির শ্রেষ্ঠসন্তানদের অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ শেখ কামালের রাজনীতি, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমানস কত যে নিবিড়ভাবে প্রোথিত, তা আমরা প্রতিনিয়ত অনুধাবন করতে পারি।

গোপালগঞ্জ জেলার পাটগাতি ইউনিয়নের এক নিসর্গ শোভিত গাঁয়ের নাম টুঙ্গিপাড়া। আজ এ পাড়া শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্ব পরিমণ্ডলে সুখ-দুঃখের ঐতিহাসিক তীর্থস্থান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। এ গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন মহাকালের মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৯ সালে ৫ আগস্ট এ টুঙ্গিপাড়ায় জন্মেছিলেন কিংবদন্তি তারুণ্যের প্রতিকৃত শহিদ শেখ কামাল।

এটি বিপুলভাবে প্রচারিত যে, চট্টগ্রামের বার আউলিয়ার অন্যতম সুফিসাধক হজরত সুলতান বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর দক্ষিণহস্তখ্যাত উঁচু মার্গের আধ্যাত্মিক পুরুষ হজরত শেখ বোরহান উদ্দিন এ শেখ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। বঙ্গবন্ধুর পরম শ্রদ্ধেয় পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের অনুমতিসাপেক্ষে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্কের ‘কামাল’ ও শেখ পরিবারের উপাধি সমন্বিত করে শেখ কামালের নামকরণ করা হয়।

বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে শেখ কামালকে নিয়ে তার আবেগ উপস্থাপিত করেছেন এভাবে- ‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম।

হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। এক সময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দুজনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা।’ কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না।

নিজের ছেলেও অনেকদিন না দেখলে ভুলে যায়।’ সত্যি বিষয়টি হলো, এ জন্মের অল্প সময়ের মধ্যেই পিতার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন অবুঝ শেখ কামাল; কারণ তার জন্মের কয়েক মাসের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু আবার কারাবরণে চলে যান।

আধ্যাত্মিকতার পরিক্রমায় সুফি দর্শনের আলোকে একদিকে ধার্মিকতা, অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িকতা ও বিশ্বজনীন মানবতাবাদের ধারণায় পিতার মতো সমৃদ্ধ ছিলেন শেখ কামাল। হজরত শেখ আবদুল আউয়াল (র.)-এর অষ্টম ও নবম উত্তর পুরুষ ছিলেন যথাক্রমে বঙ্গবন্ধু ও শহিদ শেখ কামাল। ধারাবাহিকভাবে নৈসর্গিক গ্রাম্য জীবনের সহজ-সরল ও অন্যের মঙ্গল ভাবনাকে ঘিরে বঙ্গবন্ধু যেমন নিজের জীবনচরিত নির্মাণ করেছেন, জাতির পিতার সুযোগ্য তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও শহিদ শেখ কামালসহ পরিবারের সব সন্তানের ওপর এর প্রভাব ছিল অত্যন্ত জোরালো। এজন্যই তো সব মোহ-মায়া ত্যাগ করে পিতার আহ্বানে দেশের সব জনসাধারণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ বিসর্জনের লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সন্তান পরিচয়ে নয়, অন্য সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার মতো অপরিমেয় কষ্ট স্বীকার করে ট্রেনিং নিয়েছেন এবং দেশের ইতিহাসে যুগান্তকারী অধ্যায় সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ৬১ জন কমিশনপ্রাপ্তদের মধ্যে একজন অফিসার ছিলেন শহিদ শেখ কামাল। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানী সাহেবের অধীনে এডিসির গুরুদায়িত্ব বহন করে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নিজের অবস্থানকে অত্যন্ত সুদৃঢ় করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা তাদের সেই অন্ধ ও কালিমাযুক্ত কুৎসিত চিন্তাচেতনা ও প্রচারণা চালিয়ে গৌরবদীপ্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে যেমন বিকৃত করার চেষ্টা করেছে, তা থেকে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরাও কেউই রেহাই পাননি।

শহিদ শেখ কামালের চরিত্র হরণের জন্য বহু বানোয়াট, মিথ্যা ও জঘন্য উদ্দেশ্যমূলক বিরূপ এমন কিছু প্রচার করে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা দীর্ঘদিন অব্যাহত ছিল। কিন্তু এটিই চরম সত্যি, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক জান্তা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে সম্পদ, অর্থ বা অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করেও বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অপবাদ ন্যূনতমও প্রমাণ করতে পারেনি। শহিদ শেখ কামাল শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধা বা তরুণ বরেণ্য রাজনীতিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন কৃতী শিক্ষার্র্থী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পদে বঙ্গবন্ধু যাকে সমাসীন করেছিলেন, তৎকালীন সময়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের সর্বোচ্চ অভিভাবক অধ্যাপক আবুল ফজল ‘শেখ মুজিব- তাকে যেমন দেখেছি’ গ্রন্থে ‘শেখ কামাল : স্মৃতিচারণ’ অধ্যায়ে চমৎকার কিছু বিষয় উপস্থাপন করেছেন।

১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। অধ্যাপক আবুল ফজলের ভাষায়- ওইদিন ঢাকায় ছাত্রলীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অথিতি হিসাবে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন তিনি। যে ছেলেটি অধ্যাপক স্যারকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের সঙ্গে বিমানবন্দরে বরণ করে তার হ্যান্ডব্যাগটিও বিনয়ের সঙ্গে বহন করে বিমানবন্দর থেকে আসা-যাওয়ার পথে একা নিজে গাড়ি চালিয়ে স্যারের শুধু মন জয় করেননি, দেশের সর্বোচ্চ কর্ণধারের সন্তান হয়েও কোনোভাবেই তার প্রকাশ না ঘটিয়ে স্যারের হৃদয়ে আবেগের এক গভীর রেখাপাত স্থাপন করেছেন। অধ্যাপক আবুল ফজল স্যার এটি যখন চিত্রিত করেছেন তার গ্রন্থে, এ লেখাটি যিনিই পড়বেন তিনি শুধু আবেগতাড়িত হবেন না, অধিকন্তু চোখের জলে কী প্রগাঢ় অবনত চিত্তে শহিদ শেখ কামালের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন, যা সহজেই অনুমেয়।

বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ও কোমলমতি শিশু শেখ রাসেলসহ শহিদ শেখ কামালের প্রাণ বিসর্জন শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্ব ইতিহাসে কদর্য এক পরিশিষ্ট সংযোজন করে। ৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করে একই মাসের ১৫ তারিখ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় এবং আমাদের অন্তর গহিনে অবিনশ্বর নক্ষত্রের মতো চিরজাগরূক থাকবেন- এটিই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সব শহিদানদের পবিত্র স্বর্গের সর্বোচ্চ মর্যাদায় তাদের আসীন করবেন, বিনম্র চিত্তে মহান স্রষ্টার কাছে এতটুকুই বিনীত প্রার্থনা।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

শেখ কামাল.

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম