কৃষ্ণচরিত্রে রাধা এলেন কীভাবে
নান্টু রায়
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অথর্ববেদের উপনিষদগুলোর মধ্যে গোপালতাপনী নামে অপেক্ষাকৃত আধুনিক উপনিষদে কৃষ্ণকে গোপগোপীপরিবৃত দেখা যায়। কিন্তু এতে গোপগোপীর অর্থ প্রচলিত অর্থের থেকে আলাদা। এখানে গোপী অর্থ অবিদ্যা কলা। আর গোপীজনবল্লভ অর্থ ‘গোপীনাং পালনশক্তিনাং জনঃ সমূহঃ তদ্বাচ্যা অবিদ্যাঃ কলাশ্চ তাসাং বল্লভঃ স্বামী প্রেরক ঈশ্বরঃ।’ উপনিষদে গোপীর এমন অর্থ আছে, অথচ রাসলীলার কোনো কথাই নেই। রাধার নামমাত্র নেই। একজন প্রধানা গোপীর কথা আছে বটে, তবে তিনি রাধা নন, তার নাম গান্ধর্বী। তার প্রাধান্যও কামকেলিতে নয়-তত্ত্বজিজ্ঞাসায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ আর জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্য ছাড়া কোনো প্রাচীন গ্রন্থে রাধা নেই।
ভাগবতের দশম স্কন্ধের ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩-এই পাঁচ অধ্যায়ের নাম রাসপঞ্চাধ্যায়। কৃষ্ণের বাঁশি শুনে গোপাঙ্গনাদের কৃষ্ণদর্শনে ধাবিত হতে এবং কৃষ্ণের সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত দেখা যায়। কিন্তু সেখানে ‘রাধা’ নাম কোথাও পাওয়া যায় না। রাধা নাম বৈষ্ণবাচার্যদের অস্থিমজ্জায় ঢুকে আছে। তারা টিকাটিপ্পনীর ভেতর বারবার রাধা প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, কিন্তু মূলে কোথাও রাধার নাম নেই। গোপীদের অনুরাগ প্রাবল্যজনিত ঈর্ষার প্রমাণস্বরূপ কবি লিখেছেন, তারা পদচিহ্ন দেখে অনুমান করেছিল, কোনো একজন গোপীকে নিয়ে কৃষ্ণ বিজনে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু তাও গোপীদের ঈর্ষাজনিত ভুলমাত্র। শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হলেন, এ কথাই আছে, কাউকে নিয়ে অন্তর্হিত হলেন, এমন কথা নেই এবং রাধার নামগন্ধও নেই। রাসপঞ্চাধ্যায় কেন, সব ভাগবতে কোথাও রাধার নাম নেই। ভাগবত কেন, বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশবা মহাভারতে কোথাও রাধার নাম নেই। অথচ এখন কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা। রাধা ছাড়া এখন কৃষ্ণনাম নেই। রাধা ছাড়া বাংলায় কৃষ্ণের মন্দির নেই, মূর্তি নেই। বৈষ্ণবদের অনেক রচনায় কৃষ্ণের চেয়েও রাধা প্রাধান্য লাভ করেছেন। যে রাধাকে নিয়ে ভারতবর্ষ বিশেষত বাংলা মাতোয়ারা, সেই রাধার উল্লেখ মহাভারতে নেই-বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ, এমনকি ভাগবতেও নেই। তাহলে এ রাধা এলেন কোথা থেকে?
রাধাকে প্রথম ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে দেখতে পাই। আদিম ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বিলুপ্ত। এখন যে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ পাওয়া যায়, তা পুরাণগুলোর মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ বলে বোধ হয়। এর রচনাপ্রণালি এখনকার ভট্টাচার্যদের রচনার মতো। এতে ষষ্ঠী মনসার কথাও আছে। এখনকার ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে এক নতুন দেবতত্ত্ব হাজির করা হয়েছে। আমরা চিরকাল জানি, কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার। অথচ এখানে বলা হচ্ছে, কৃষ্ণই বিষ্ণুকে সৃষ্টি করেছেন। বিষ্ণু থাকেন বৈকুণ্ঠে, কৃষ্ণ থাকেন গোলোকে রাসমণ্ডলে-বৈকুণ্ঠ তার অনেক নিচে। তিনি কেবল বিষ্ণুকে নন, ব্রহ্মা, রুদ্র, লক্ষ্মী, দুর্গা ইত্যাদি দেবদেবী, দানব ও জীব সৃষ্টি করেছেন। গোলকধামে গো, গোপ ও গোপিনীরা বাস করে। তারা দেবদেবীর ওপর সেই গোলকধামের অধিষ্ঠাত্রী কৃষ্ণবিলাসিনী দেবীই রাধা। রাধার আগে রাসমণ্ডল, রাসমণ্ডলে ইনি রাধাকে সৃষ্টি করেন। গোপীদের বাসস্থান গোলকধাম বৃন্দাবনের অবিকল নকল। এখানে কৃষ্ণযাত্রার চন্দ্রাবলীর মতো রাধার প্রতিযোগিনী গোপীর নাম বিরজা। মানভঞ্জন যাত্রায় যেমন যাত্রাওয়ালারা কৃষ্ণকে চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে নিয়ে যায়, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণকারও তেমনি কৃষ্ণকে গোলকধামে বিরজার কুঞ্জে নিয়ে গেছেন। তাতে যাত্রার রাধিকার মনে যেমন ঈর্ষা ও কোপের সৃষ্টি হয়, ব্রহ্মবৈবর্তের রাধিকার মনেও তেমনি ঈর্ষা ও কোপের সৃষ্টি হয়েছিল। তাতে আরেক মহা গোলযোগ ঘটে যায়। রাধিকা কৃষ্ণকে হাতেনাতে ধরার জন্য রথে চড়ে বিরজার মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে বিরজার দ্বার রক্ষা করছিলেন শ্রীদামা বা শ্রীদাম। শ্রীদাম রাধিকাকে দ্বার ছাড়ে না। এদিকে রাধিকার ভয়ে বিরজা গলে জল হয়ে নদীতে রূপান্তরিত হলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাতে দুঃখিত হয়ে তাকে পুনর্জীবন ও পূর্বরূপ প্রদান করলেন। বিরজা গোলকনাথের সঙ্গে নিত্য আনন্দ অনুভব করতে লাগলেন। ক্রমে তার সাতটি পুত্র জন্মাল। কিন্তু পুত্ররা আনন্দ অনুভবের বিঘ্ন, তাই মা তাদের অভিশাপ দিলেন, তারা সাত সমুদ্র হয়ে রইল। এদিকে রাধা কৃষ্ণবিরজা-বৃত্তান্ত জানতে পেরে কৃষ্ণকে যারপরনাই ভর্ৎসনা করলেন এবং অভিশাপ দিলেন যে, তুমি পৃথিবীতে গিয়ে বাস কর। অপরদিকে কৃষ্ণসখা শ্রীদাম রাধার এহেন দুর্ব্যবহারে অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে ভর্ৎসনা করলেন। শুনে রাধা শ্রীদামকে গালমন্দ করে শাপ দিলেন, তুমি পৃথিবীতে গিয়ে অসুর হয়ে জন্মগ্রহণ কর। শ্রীদামও কম যান না। তিনিও রাধাকে শাপ দিয়ে বললেন, তুমিও পৃথিবীতে গিয়ে রায়াণপত্নী (যাত্রার আয়ান ঘোষ) হয়ে জন্মগ্রহণ করবে এবং কলঙ্কিনীরূপে খ্যাত হবে।
অতঃপর দুজনেই কৃষ্ণের কাছে এসে কেঁদে পড়লেন। কৃষ্ণ শ্রীদামকে বর দিয়ে বললেন, তুমি অসুরেশ্বর হয়ে জন্মাবে, কেউ তোমাকে পরাজিত করতে পারবে না। শেষে শঙ্করের শূলের স্পর্শে মুক্ত হবে। রাধাকেও আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘তুমি যাও; আমিও যাচ্ছি।’ শেষে পৃথিবীর ভার লাঘবের জন্য তিনি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন।
এসব কথা নতুন এবং সব শেষে প্রচারিত হলেও এ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বাঙলার বৈষ্ণবধর্মের ওপর অতিশয় প্রভাব বিস্তার করেছে। জয়দেব প্রভৃতি বাঙালি বৈষ্ণবকবি, বাঙলার জাতীয় সংগীত, বাংলার যাত্রা মহোৎসবাদির মূল ব্রহ্মবৈবর্তে। তবে ব্রহ্মবৈবর্তকারকথিত একটা বড় মূল কথা বাঙলার বৈষ্ণবেরা গ্রহণ করেননি, অন্তত সেটি বাঙালির বৈষ্ণবধর্মে তেমনভাবে পরিস্ফুট হয়নি-রাধিকা রায়াণপত্নী বলে পরিচিতা, কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্তের মতে তিনি কৃষ্ণের বিধিসম্মত বিবাহিতা পত্নী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডের ১৫ অধ্যায়ে বিবৃত সেই বিবাহবৃত্তান্ত জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘একদা কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে নন্দ বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন। সেখানকার ভাণ্ডীরবনে গরু চরানোর সময় সরোবরের স্বাদু জল তিনি গরুদের পান করালেন, নিজেও পান করলেন। এবং বালককে বুকে নিয়ে বটমূলে বসলেন। হে মুনে! তারপর মায়াতে শিশুশরীরধারণকারী কৃষ্ণ অকস্মাৎ মায়ার দ্বারা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন করলেন, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এবং কাননান্তর শ্যামল; ঝঞ্ঝাবাত, মেঘশব্দ, দারুণ বজ শব্দ, অতিস্থূল বৃষ্টিধারা এবং বৃক্ষসকল আন্দোলিত হয়ে ভেঙে পড়তে লাগল, দেখে নন্দ ভয় পেলেন। ‘বাছুরগুলোকে ছেড়ে কীভাবেই-বা নিজের আশ্রয়ে যাই, যদি গৃহে না যাই, তবে এই বালকেরই-বা কি হবে’, নন্দ এমন বলছেন, শ্রীহরি তখন কাঁদতে কাঁদতে মায়াভয়ে ভীত হয়ে বাপের গলা জড়িয়ে ধরলেন। এমন সময় রাধা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন।’
রাধার অপূর্ব রূপলাবণ্য দেখে নন্দ বিস্মিত হলেন, তিনি রাধাকে বললেন, ‘আমি গর্গমুখে জেনেছি, তুমি পদ্মারও অধিক হরির প্রিয়া; আর ইনি পরম নির্গুণ অচ্যুত মহাবিষ্ণু; তথাপি আমি মানব, বিষ্ণুমায়ায় মোহিত আছি। হে ভদ্রে! তোমার প্রাণনাথকে গ্রহণ কর; যেখানে খুশি যাও। পরে মনোরথ পূরণ করে আমার পুত্র আমাকে দিও।’
এই বলে নন্দ কৃষ্ণকে রাধার হাতে সমর্পণ করলেন। রাধাও কৃষ্ণকে কোলে করে নিয়ে গেলেন। দূরে গেলে রাধা রাসমণ্ডল স্মরণ করলেন, তখন মনোহর বিহারভূমি সৃষ্টি হলো। কৃষ্ণকে সেখানে নেওয়া হলে তিনি কিশোরমূর্তি ধারণ করে রাধাকে বললেন, ‘যদি গোলকের কথা স্মরণ হয়, তবে যা স্বীকার করেছি, তা পূর্ণ করব।’ তারা এমন প্রেমালাপে লিপ্ত ছিলেন, এমন সময় সেখানে ব্রহ্মা এসে উপস্থিত হলেন। তিনি রাধাকে অনেক স্তবস্তুতি করলেন। শেষে নিজে কন্যাকর্তা হয়ে যথাবিহিত বেদবিধি অনুসারে রাধিকাকে কৃষ্ণে সম্প্রদান করলেন। তাদের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে তিনি অন্তর্হিত হলেন। রায়াণের সঙ্গে রাধিকার যথাশাস্ত্র বিয়ে হয়েছিল কিনা, যদি হয়ে থাকে, তবে তা আগে না পরে, তা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সে-সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। রাধাকৃষ্ণের বিয়ের পর বিহারবর্ণন। বলা বাহুল্য, ব্রহ্মবৈবর্তের রাসলীলাও অনুরূপ।
পাঠক দেখবেন, ব্রহ্মবৈবর্তকার সম্পূর্ণ নতুন এক বৈষ্ণবধর্ম সৃষ্টি করেছেন। সে বৈষ্ণবধর্মের নামগন্ধ বিষ্ণু বা ভাগবত বা অন্য পুরাণে নেই। রাধাই এ বৈষ্ণবধর্মের কেন্দ্রস্বরূপ। কবি জয়দেবগীতগোবিন্দ কাব্যে এ নতুন বৈষ্ণবধর্ম অবলম্বন করেই গোবিন্দগীতি রচনা করেছেন। এ ধর্ম অবলম্বন করেই শ্রীচৈতন্য কান্তরসাশ্রিত অভিনব ভক্তিবাদ প্রচার করেছেন।
এখন দেখা যাক, এই নতুন ধর্মের তাৎপর্য কী এবং কোথা থেকে এর উৎপত্তি? ভারতবর্ষের প্রধান ছয়টি দর্শনের মধ্যে বেদান্ত ও সাঙ্খ্যের প্রাধান্য বেশি। বেদান্তের মূল কথা হচ্ছে, এই জগৎ ও জীবসকল ঈশ্বরের অংশ। তিনি এক ছিলেন, বহু হলেন। তিনি পরমাত্মা। জীবাত্মা সেই পরমাত্মার অংশ। ঈশ্বরের মায়া থেকে জীবাত্মার সৃষ্টি এবং সেই মায়ামুক্তি ঘটলেই আবার ঈশ্বরে বিলীন হবে। বেদান্ত দর্শন এই অদ্বৈতবাদে পূর্ণ।
আধুনিককালে শংকরাচার্য, রামানুজাচার্য, মাধ্বচার্য ও বল্লভাচার্য অদ্বৈতবাদের চার ধরনের ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। এগুলো যথাক্রমে অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ ও বিশুদ্ধদ্বৈতবাদ। কিন্তু প্রাচীন বৈষ্ণবধর্মে এত বিভেদ ছিল না, শুধু ছিল জগৎ ঈশ্বর বা ঈশ্বর জগৎ নন, কিন্তু ঈশ্বরে জগৎ আছে-‘সূত্রে মণিগণা ইব’।
অন্যদিকে কপিলের সাঙ্খ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। পরবর্তী সাঙ্খ্যরা অবশ্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। সাঙ্খ্যের মোদ্দা কথা হচ্ছে, জড়জগৎ বা জড়জগন্ময়ীশক্তি হচ্ছেন প্রকৃতি। ইনি সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কর্ত্রী। পরমাত্মা বা পুরুষ সম্পূর্ণ সঙ্গশূন্য। এ পুরুষপ্রকৃতিতত্ত্ব থেকে তান্ত্রিকধর্মের উদ্ভব। সাঙ্খ্যের প্রকৃতি তন্ত্রে এসে হলো শক্তি। বৈষ্ণবদের অদ্বৈতবাদ-বিরোধী মানুষের কাছে এই তান্ত্রিকধর্ম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখন তান্ত্রিকধর্মের সারাৎসার আত্মসাৎ করে ব্রহ্মবৈবর্তকার এই শক্তিকে বৈষ্ণবীশক্তি আখ্যায়িত করে অভিনব বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন। এখানে রাধা সাঙ্খ্যদের মূলপ্রকৃতিস্থানীয়া। যদিও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ব্রহ্মখণ্ডে বলা হয়েছে, কৃষ্ণ মূলপ্রকৃতিকে সৃষ্টি করে তারপর রাধাকে সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে দেখা যায়, কৃষ্ণ নিজেই রাধাকে বারবার মূলপ্রকৃতি বলে সম্বোধন করছেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, বেদান্তের মায়াবাদ সাঙ্খ্যে হলো প্রকৃতিবাদ। প্রকৃতিবাদ থেকে শক্তিবাদ। শক্তিবাদ থেকে ব্রহ্মবৈবর্তকারের বৈষ্ণবীশক্তিবাদ। পুরাণকার লিখেছেন, কৃষ্ণ রাধাকে বলছেন : ‘তুমি না থাকলে আমি কৃষ্ণ, তুমি থাকলে আমি শ্রীকৃষ্ণ।’ বিষ্ণুপুরাণে শ্রী সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে, ব্রহ্মবৈবর্তে রাধা সম্বন্ধে ঠিক তাই বলা হয়েছে। রাধা সেই শ্রী। রাধা ঈশ্বরের শক্তি, উভয়ের বিধিসম্মত পরিণয়, শক্তিমানের শক্তির পরিচয় এবং শক্তিরই প্রকাশ উভয়ের বিহার।
সুতরাং বিদ্যমান ব্রহ্মবৈবর্তে ‘রাধাতত্ত্ব’ কী, তা নিশ্চয়ই পাঠক বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু আদিম ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাধা কৃষ্ণ-আরাধিকা আদর্শরূপিণী গোপী ছিলেন, সন্দেহ নেই।
ওপরের দীর্ঘ আলোচনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বৃন্দাবনে বসবাসকালে কৃষ্ণের রাসলীলা বা হল্লীষক্রীড়া বা বস্ত্রহরণ অথবা শ্রীরাধিকার সঙ্গে প্রেমলীলা নিতান্তই কবিকল্পনা। এসব লীলাবিস্তার করে কৃষ্ণের মহিমান্বিত চরিত্রকে অযথা কলঙ্কিত করার চেষ্টা হয়েছে। কংসবধের কথা প্রসঙ্গে তার নিজের কথা থেকে মনে হয়, কংসবধের আগে থেকেই তিনি মথুরায় বাস করতেন। ভাবুন একবার, যদি বৃন্দাবনেই না গিয়ে থাকেন, তাহলে বৃন্দাবনলীলা আসে কোথা থেকে?
যা হোক, আবার কৃষ্ণচরিত বর্ণনায় ফিরে আসি। বৃন্দাবন পর্বে কৃষ্ণ অরিষ্ট (বৃষরূপী) এবং কেশী (অশ্বরূপী) নামে দুই অসুরকে বধ করেছিলেন বলে শিশুপালের কৃষ্ণনিন্দায় দেখা যায়। অত্যাচারী কংসের ভয়ে বসুদেব তার পত্নী রোহিণী ও দুই পুত্র রাম এবং কৃষ্ণকে নন্দালয়ে গোপনে রেখে এসেছিলেন, সে কথা আমরা ইতঃপূর্বে জেনেছি। কৃষ্ণের শৈশব ও কৈশোর সেখানে অতিবাহিত হয়। তিনি শৈশবে রূপলাবণ্যে ও শিশুসুলভ গুণে সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কৈশোরে তিনি অতিশয় বলশালী ছিলেন। বৃন্দাবনের অনিষ্টকারী পশুপাখি প্রভৃতি হত্যা করে তিনি গোপবালকদের সব সময় রক্ষা করতেন। তিনি শৈশবাবধি সব মানুষ ও জীবের প্রতি করুণাঘন ছিলেন-সবার উপকার করতেন। সবার সঙ্গে আমোদ-প্রমোদ করতেন, সবাইকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতেন এবং কৈশোরেই তার হৃদয়ে প্রকৃত ধর্মতত্ত্ব উদ্ভাসিত হয়। না হলে, রাজাকে যিনি হত্যা করেন, তিনিই রাজা হন-এটাই আমরা দেখে আসছি। কিন্তু কৃষ্ণ কংসকে বধ করার পরও রাজা হলেন না, বরং উগ্রসেনের রাজ্যে উগ্রসেনকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। [বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্রের আলোকে]
লেখক: ট্রাস্টি, হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়
