Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

পুষ্টি কার্যক্রমে সমন্বিত দায়িত্ব পালন করতে হবে

Icon

ডা. শামীম তালুকদার

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পুষ্টি কার্যক্রমে সমন্বিত দায়িত্ব পালন করতে হবে

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আজ থেকে ৪৮ বছর আগে জনগণের পুষ্টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের অংশ হিসাবে ১৯৭৪ সালে ‘জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল ‘বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ’ গঠন করেন। জাতীয় পুষ্টি পরিষদ বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী প্রাতিষ্ঠানিক অবদান। দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৭ সালে জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টিনীতি এবং প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।

১৯৯৮ সাল থেকে পরিষদ প্রতিবছর জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ পালন করে আসছে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পুষ্টি পরিষদ ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে ছিল-অধুনা যা আবার প্রাণ ফিরে পায়।

কিন্তু জনগণের প্রয়োজন অনুযায়ী জাতীয় পুষ্টি পরিষদ কতটুকু কর্মক্ষম, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তাদের প্রয়োজনীয় জনবল কতটুকু সরকার জোগান দিয়েছে বা প্রয়োজনীয় অর্থের চাহিদা কতটুকু মিটিয়েছে, তাও বিশ্লেষণে রাখা জরুরি। তাছাড়া গত কয়েক বছরে এ পরিষদ কতগুলো পুষ্টিবিষয়ক নীতিমালা তৈরি করেছে। নীতিমালাগুলো বাস্তবায়নে কতদূর সফল হয়েছে, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

২৩ থেকে ২৯ এপ্রিল পালিত হচ্ছে জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ। সময় এসেছে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সফলতা ও ব্যর্থতা দুটি দিকেই ফিরে তাকানো। এবারের পুষ্টি সপ্তাহের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সঠিক পুষ্টিতে সুষ্ঠু জীবন’। যারা এ প্রতিপাদ্য ঠিক করেছেন, প্রথমেই তারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

কারণ বাংলাদেশ অল্প পুষ্টি ও অধিক পুষ্টি উভয় সমস্যায়ই ভুগছে। তাছাড়া এ দেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৭০ শতাংশ অধিক পুষ্টি বা খাদ্যাভ্যাসজনিত অসংক্রামক রোগে, অন্যদিকে অর্ধেকের বেশি নারী পুষ্টিজনিত রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। এ পরিস্থিতিতে পুষ্টি পরিষদকে শুধু নামকাওয়াস্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সপ্তাহ পালন করে সফলতার ঢেকুর তুললেই হবে না, বাস্তবিক অর্থেই নীতি বাস্তবায়নের সফলতার ফল ঘরে তুলতে হবে।

আমরা যদি পেছনের পুষ্টির সফলতার দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব বিগত কয়েক বছরে শিশুদের অল্প পুষ্টি ও মৃত্যুর হার কমেছে। বাংলাদেশে শিক্ষা ও খাদ্য উৎপাদনেও বেশ অগ্রগতি হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ও হেলথ জরিপ (BDHS) ২০১৭-১৮-এর তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের বয়স অনুপাতে কম উচ্চতা হার ৩১ শতাংশ এবং উচ্চতার অনুপাতে কম ওজন হার ৮ শতাংশ, যা এখনো তুলনামূলক অনেক বেশি। অন্যদিকে MICS Survey 2019 অনুযায়ী এ হার যথাক্রমে ২৮ ও ১০ শতাংশ। Bangladesh Adolescent Health and Wellbeing Survey 2019-20 অনুযায়ী প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কিশোরী এবং এক-পঞ্চমাংশ কিশোরের মধ্যে পুষ্টিহীনতা ছিল।

একই জরিপে দেখা যায়, প্রায় দশজনের মধ্যে একজন অবিবাহিত কিশোরী কম ওজনের এবং দশজনের মধ্যে একজন অধিক ওজনের। বিবাহিত কিশোরী ও নারীদের মধ্যে ৪ শতাংশ কম ওজনের এবং ১৬ শতাংশ বেশি ওজনের ছিল। অধিকন্তু ওই জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৭৬-৮৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর পর্যাপ্ত খাদ্যতালিকাগত বৈচিত্র্য ছিল। বেশির ভাগ কিশোর-কিশোরী (৭০-৭৮ শতাংশ) আয়রনসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করে। অন্যদিকে এদের মধ্যে মাত্র এক-চতুর্থাংশ ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২০১৭-২০১৮-এর তথ্যানুসারে, ২০০৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত শিশুদের কম ওজন ৩৯.৫৩ থেকে ৩০.৯৬ শতাংশ কমেছে। একই সময়ের মধ্যে বয়ঃসন্ধিকালের মেয়েদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন/স্থূলতার প্রবণতা ১.৭৯ থেকে বেড়ে ১১.৪০ শতাংশ হয়েছে। BDHS ২০১৭-১৮ অনুযায়ী, ৬-৫৯ মাস বয়সি ৭৯ শতাংশ শিশু ভিটামিন-এ সম্পূরক গ্রহণ করেছিল, যা BDHS ২০১৪ সাল থেকে ৬২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্ব পুষ্টি রিপোর্ট বলছে, অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সীমিত অগ্রগতি হয়েছে। স্থূলতার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিকে কোনো অগ্রগতি হয়নি, আনুমানিক ৬.২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছর বা এর বেশি বয়সি) নারী এবং ৩.০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ স্থূলতার সমস্যায় ভুগছে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বেড়েছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের ব্যবহার আর সেজন্যই বাড়ছে স্থূলতা ও অসংক্রামক রোগের প্রকোপ।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রাবাসগুলোয় যে খাদ্য সরবরাহ করা হয় তা অত্যন্ত নিুমানের। ছাত্র ও অভিভাবকরা বলছেন, যুগ যুগ এভাবেই চলছে, অবস্থার উত্তরণে কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে পুষ্টিহীন খাবার খেতে খেতে শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে; ফলে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাছাড়া দেখা যায়, কেউ চিকিৎসকের কাছে গেলে অনেক সময় সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনার জন্য তারা রোগীকে পুষ্টিবিদের কাছে পাঠান; কিন্তু আমাদের দেশে পুষ্টিবিদদের কাজ তত্ত্বাবধানের কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই তাদের পুষ্টি চিকিৎসা দেওয়ার কোনো গাইড লাইন, আইনগত কোনো ভিত্তি ও মান নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে পুষ্টির আসল উদ্দেশ্য সফল হওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে যায়।

বর্তমানে খাদ্যের ভেজাল যে হারে বেড়েছে, তা দেখভাল করার জন্য জনবলের তীব্র অভাব রয়েছে। প্যাকেটজাতের নামে কুখাদ্য আমরা শিশুদের নিয়মিত খাওয়াচ্ছি। এক্ষেত্রে উদাসীনতা চোখে পড়ার মতো। কেউ কোনো প্রতিবাদও করছে না। আন্তর্জাতিক সংস্থার দ্বারা ‘সান সিভিল সোসাইটি’ গঠন করা হয়েছে, যাদের মূলত জনগণের পক্ষে কথা বলার কথা। কিন্তু তারা মুখ বন্ধ রেখে শূন্য হাতে প্রেসক্রিপশনপ্রাপ্ত হয়ে মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষার্থেই তৎপর থাকে। তবে তারা জনগণের পক্ষে ‘উহ্ আহ্’ করতে ভুল করে না। তখন মনে হয়-হায়রে পুষ্টি, হায়রে পুষ্টি সপ্তাহ!

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে যেসব পুষ্টি নিয়ে গবেষণা হয়, সরকারি বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয় এর বেশির ভাগই রয়ে যায় কাগজে-কলমে, বাস্তবে এর প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায় না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরও ২১টি মন্ত্রণালয় পুষ্টি কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আছে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়হীনতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে না দিয়ে সব মন্ত্রণালয়কে পুষ্টি কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমন্বিতভাবে দায়িত্ব নিতে হবে।

পুষ্টি সপ্তাহ পালনে অন্য মন্ত্রণালয়গুলো কতটুকু সম্পৃক্ত হচ্ছে তা ভাবনার বিষয়। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া পুষ্টি পরিষদের নেতৃত্বে যে পুষ্টি সপ্তাহ পালন হচ্ছে, তাতে সবার আন্তরিক অংশগ্রহণ একান্ত কাম্য। তাছাড়া কোভিড-পরবর্তী পুষ্টিহীনতা, খাদ্যদ্রব্যের ঊর্র্ধ্বগতিতে পুষ্টি সপ্তাহ পালনের জন্য সামগ্রিক সমতা, বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং সুশাসনের মতো বিষয়গুলোয়ও সরকার নজর দেবে বলে আশা করি। সবশেষে সাধারণ মানুষের এবং গরিব জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় রেখে পুষ্টি সপ্তাহের সফলতা কামনা করি।

ডা. শামীম তালুকদার : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট

পুষ্টি .

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম