ছয় দফার প্রস্তুতিপর্ব ও বঙ্গবন্ধু
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভাষা আন্দোলনের পর আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিকে। কারণ ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আরোপিত বৈষম্যের ফল হিসাবে এ অঞ্চলের মানুষ বিপন্ন দশায় পৌঁছেছিল। ১৯৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক চাকরি সূত্রে ঢাকায় এসে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এর বাস্তবতা। তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে।
তিনি লেখেন, ‘...ঢাকায় আমার স্ত্রী আসার পর আমি ঢাকা থেকে প্রায় চৌদ্দ কিলোমিটার দূরে টঙ্গীতে পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়ে কিছু তৈজসপত্রের অর্ডার দিলাম। যাওয়ার পথে, বাস্তবের এক নতুন চিত্র আমার সামনে উদয় হলো। দারিদ্র্যের করুণ সব দৃশ্য আমি দেখলাম। মহিলাদের লজ্জা নিবারণের জন্য সামান্য এক টুকরো কাপড়ও বলতে গেলে নেই। পুরুষরা সব খাটো আর অভুক্ত। চলন্ত গাড়িতে বসেও তাদের পাতলা কালো চামড়ার নিচে পাঁজরের হাড়গুলো গোনা যায়।
বাচ্চাদের অবস্থা আরও করুণ। তাদের কারও কারও কোমরে বাঁধা ঘুনটি টুং টুং করে ঝুলছে। এটাই তাদের একমাত্র খেলনা। যখনই গাড়ি থামিয়েছি, ভিক্ষুকরা মাছিরমতো আমাকে ঘিরে ধরেছে। আমি এটাই বুঝলাম যে বাংলার গরিবরা পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে গরিব মানুষটির চেয়েও গরিব। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণের যে অভিযোগ, তার অর্থগুলো আমি বুঝতে শুরু করলাম। নিজেকে অপরাধী মনে হলো।’
পাকিস্তানি শাসকদের হাতে নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ মুক্তির পথ খুঁজছিল। এদেশের ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ সবাই অনুভব করেছিলেন সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন লাভ না করা পর্যন্ত নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাই ১৯৬৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে একটি নতুন কর্মসূচি অনুমোদিত হয়। বাঙালির অধিকার রক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি ছয় দফা কর্মসূচি নামে পরিচিত। শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরের বিরোধী দলের এক সম্মেলনে প্রথম ছয় দফা উত্থাপন করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি সংবলিত এই ছয় দফা প্রস্তাব ১৮ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমান পেশ করেন। অচিরেই ছয় দফা বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়।
শেখ মুজিব ছয় দফা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে প্রচার করার জন্য একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। এখানে তিনি লেখেন, ‘এমন উদারতা, এমন নিরপেক্ষতা, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে এমন ইনসাফবোধই পাকিস্তানি দেশপ্রেমের বুনিয়াদ। এটা যার মধ্যে আছে কেবল তিনিই দেশপ্রেমিক। যে নেতার মধ্যে এই প্রেম আছে, কেবল তিনিই পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের ওপর নেতৃত্বের যোগ্য। যে নেতা বিশ্বাস করেন, দুইটি অঞ্চল আসলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দেহের দুই চোখ, দুই কান, দুই পাটি দাঁত, দুই হাত, দুই পা, যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানকে শক্তিশালী করিতে হইলে এসব জোড়ার দুইটিকেই সমান সুস্থ ও শক্তিশালী করিতে হইবে; যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানের এক অঙ্গ দুর্বল হইলে গোটা পাকিস্তানই দুর্বল হইয়া পড়ে; ইচ্ছা বা জানিয়া শুনিয়া যাহারা পাকিস্তানের এক অঙ্গকে দুর্বল করিতে চায় তাহরা পাকিস্তানের দুশমন; যে নেতা দৃঢ় ও সবল হাতে সেই দুশমনের শায়েস্তা করিতে প্রস্তুত আছেন, কেবল তিনিই পাকিস্তানের জাতীয় নেতা হইবার অধিকারী।
আমার প্রিয় ভাই বোনেরা, আপনারা দেখিতেছেন যে, আমার ছয় দফা দাবিতে একটিও অন্যায় অসঙ্গত পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব করি নাই। বরঞ্চ আমি যুক্তিতর্ক সহকারে দেখাইলাম, আমার সুপারিশ গ্রহণ করিলে পাকিস্তান আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হইবে। তথাপি কায়েমি স্বার্থের মুখপাত্ররা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার এলজাম লাগাইতেছেন। এটা নতুন ও বিস্ময়ের কথা নয়। পূর্ব পাকিস্তানের মজলুম জনগণের পক্ষে কথা বলিতে গিয়া আমার বাপ-দাদার মতো মুরুব্বিরাই ইহাদের কাছে গাঁজা খাইয়াছেন। তাহাদের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করিয়াছেন; আর আমি কোন ছার? দেশবাসীর মনে আছে, আমাদের নয়নমণি শেরেবাংলা ফজলুল হককে এরা দেশদ্রোহী বলিয়াছেন। দেশবাসী এও দেখিয়াছেন যে, পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা, পাকিস্তানের সর্বজন মান্য জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও দেশদ্রোহীতার অভিযোগে কারাবরণ করতে হইয়াছিল তাহাদেরই হাতে। অতএব দেখা গেল পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবির কথা বলিতে গেলে দেশদ্রোহিতার বদনাম ও জেল জুলুমের ঝুঁকি লইয়াই সে কাজ করিতে হইবে।
অতীতে এমন অনেক জেল-জুলুম ভুগিবার তকদির আমাদের হইয়াছে। মুরুব্বিদের দোয়ায় সহকর্মীদের সহৃদয়তায় এবং দেশবাসীর সমর্থনে সেসব সহ্য করিবার মতো মনের বল আল্লাহ আমাকে দান করিয়াছেন। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানির ভালোবাসাকে সম্বল করিয়া আমি এ কাজে যে কোনো ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি। আমার দেশবাসীর কল্যাণের কাছে আমার মতো নগণ্য ব্যক্তির জীবনের মূল্যই বা কতটুকু। মজলুম দেশবাসীর বাঁচার দাবির জন্য সংগ্রাম করিবার চেয়ে বৃহৎ কাজ আর কিছু আছে বলিয়া আমি মনে করি না। মরহুম জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ন্যায় যোগ্য নেতার কাছে আমি এ জ্ঞান লাভ করিয়াছি। তাহার পায়ের তলায় বসিয়াই এতকাল দেশবাসীর খেদমত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। তিনিও আজ বাঁচিয়া নাই। তাই আমাকেই তাহার রাখিয়া যাওয়া অসমাপ্ত কাজ করতে হইতেছে।
প্রিয় ভাই-বোনেরা, আল্লাহর দরবারে শুধু এই দোয়াই করিবেন, বাকি জীবনটুকু আমি যেন নিজেকে আপনাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনায় নিয়োজিত করতে পারি।’
ছয় দফা দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য মুক্তির সনদ। তাই এ দাবির প্রতি সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছিল। দাবি আদায়ের জন্য তাই এদেশের ছাত্র-শিক্ষক, রাজনীতিবিদসহ সবাই আন্দোলন শুরু করে। ছয় দফা দাবির জনপ্রিয়তায় সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং একে রাষ্ট্রদ্রোহী আন্দোলন বলে অপপ্রচার করতে থাকে। ক্রমে সরকার ছয় দফা আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার জন্য দমননীতি শুরু করে। ১৯৬৬ সালের ৮ মে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তারের সংবাদ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। আওয়ামী লীগ প্রথমে প্রতিবাদ দিবস পালন করে। অতঃপর বন্দি নেতাদের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল কর্মসূচি আহ্বান করা হয়। সরকার হরতাল বন্ধের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত জনতা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে মিছিল বের করে। মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ।
শেখ মুজিব ছয় দফা দাবির সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রদেশের জেলায় জেলায় সফর করতে থাকেন। ছয় দফা যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুক্তির সনদ, একথা বুঝতে পেরে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায়। এ আন্দোলন বাঙালির মনে জাতীয়তাবাদের ধারণার জন্ম দিয়েছিল। এই ছয় দফার মধ্যে ছিল ভবিষ্যৎ স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। এসব কারণে ছয় দফার দাবি বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
ছয় দফার জনপ্রিয়তায় সরকার ভীত হয়ে পড়ে। নানা অপপ্রচার শুরু করে। এই লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নিজে পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ১৯৬৬ সালের ১৬ মার্চ রাজশাহীর এক জনসভায় তিনি ছয় দফা দাবির বিষয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখান এবং শেখ মুজিবকে হুমকি দেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কনভেনশনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি জানান, ছয় দফার প্রতিক্রিয়ায় গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। কিন্তু এসব হুমকিতে মুজিব তার লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি। ২০ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অধিবেশনের সমাপ্তি সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে জানিয়ে দেন, এসব হুমকিতে বাংলার মানুষ তাদের প্রাণের দাবি থেকে সরে আসবে না।
এদিকে সরকার চাপ বাড়াতে থাকে। ১৭ এপ্রিল শেখ মুজিব খুলনার এক জনসভা শেষ করে ঢাকা ফেরার পথে যশোরে গ্রেফতার হন। পূর্ব পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের ৪৭/৫ ধারার বলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে তিনি যশোর আদালত থেকে জামিন নিয়ে ঢাকায় ফেরেন। কিন্তু ২১ এপ্রিল এই জামিন বাতিল করে দেওয়া হয়। অবশ্য ঢাকার সেশন জজ তার জামিন মঞ্জুর করেন। জেলমুক্তির পর ধানমন্ডির বাসায় ফিরে এলে রাতেই আবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। পাঠিয়ে দেওয়া হয় সিলেটে। পরদিন সকালে সিলেট মহকুমা আদালতে জামিনের আবেদন নাকচ হয়ে যায়। ২ দিন জেলে থাকার পর শেখ মুজিব জামিনে মুক্তি পান ২৩ এপ্রিল। কিন্তু বাঙালির মুক্তির অগ্রদূত শেখ মুজিবের নিস্তার মিলেনি।
এ দিনই আরেকটি মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। মামলাটি ময়মনসিংহে দায়ের করা ছিল বলে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহের জেলা ও দায়রা জজ ২৫ এপ্রিল তার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। অকুতোভয় মুজিব আদালত থেকে বেরিয়েই এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। তার বক্তব্যের প্রধান বিষয়ই ছিল ছয় দফা। এই অপরাধে সেই রাতেই আবার গ্রেফতার হলেন।
এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। শেখ মুজিব ও তার সহকর্মীদের মুক্তির দাবিতে ঢাকা শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের হতে থাকে। ১৩ মে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে প্রাদেশব্যাপী পালিত হয় ‘প্রতিবাদ দিবস’। এর ধারাবাহিকতায় ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এদিন পুলিশ বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি চালায়। জেলখানার ভেতরে শেখ মুজিব যে খবর পাচ্ছেন এবং তার যে উপলব্ধি হয়েছিল, এর চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
এখানে তার বক্তব্য উদ্ধৃত করা হলো, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কি হয় আজ? আবদুল মোনায়েম খান যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রচীর ভেদ করে খবর আসলো দোকান-পাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে। এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে। আবার সংবাদ পাইলাম পুলিশ-আনসার দিয়ে ঢাকা শহর ভরে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই জনগণ বে-আইনি কিছুই করবে না। শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষের রয়েছে। কিন্তু এরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে দিবে না।
আবার খবর এলো টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। লাঠি চার্জ হইতেছে সমস্ত ঢাকায়। আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না।...১২টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয় দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তিস্বাধীনতা চায়। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচবার দাবি তারা চায়-এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ৭০-৭১)।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
