কিছুমিছু
মন্ত্রীর জন্য সবকিছু করা যায়
মোকাম্মেল হোসেন
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মন্ত্রী বাহাদুরকে ইতস্তত করতে দেখে ইব্বর আলী বলল-
: লিডার! সামনে ইলেকশন। দুনুমনু ভাব পরিত্যাগ কইরা নিয়ত বাইন্ধ্যা ফেলেন।
ঢাকা থেকে নিজের নির্বাচনী এলাকায় আসার সময় মন্ত্রী বাহাদুর নিয়ত করেছিলেন, আজ আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠির সঙ্গে একত্রে ইফতার করবেন। ইব্বর আলী এসে প্যাচ লাগিয়ে দিল। ইব্বর আলী পার্টির প্রবীণ কর্মী। তার কথায় যুক্তি আছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘরের দরজায় ঊকি মারছে। এসময় নামাজ-কালামের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত- যাতে ভোটাররা মনে করে, এতদিন বেলাইনে গাড়ি চালালেও এখন তিনি লাইনে উঠেছেন। আত্মীয়তা পরের রমজানে রক্ষা করলেও চলবে; এখন ভোটের বাক্স যাতে ভরে- সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া জরুরি। মন্ত্রী বাহাদুর ইব্বর আলীর কথা মেনে নিলেন। আগের নিয়ত গাঙের পানিতে নিক্ষেপ করে নতুন করে নিয়ত বাঁধলেন।
এখন যেতে হবে শহর থেকে ত্রিশ-পয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে; তার নির্বাচনী এলাকার শেষপ্রান্তে। সেখানকার একটা জামে মসজিদে ইফতারি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। মন্ত্রী বাহাদুর সে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। ইফতারির আগে ছোটখাটো বক্তৃতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। মন্ত্রী বাহাদুর বক্তৃতায় নতুন নতুন আশার কথা শোনালেন। হরেকরকম প্রতিশ্রুতি দিলেন। তারপর মসজিদে স্থানীয় মুসল্লিদের সঙ্গে ইফতার করতে বসলেন। ইফতারি শেষে মাগরিবের নামাজ আদায়ের পর মসজিদ থেকে বের হয়ে মন্ত্রী বাহাদুর আচানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন। তিনি দেখলেন, তার জুতাজোড়া যথাস্থানে নেই। পার্টির কর্মীরা অনেকক্ষণ ধরে অপহৃত জুতাজোড়ার সন্ধান করল। তবে এতে কোনো লাভ হল না। মনে হচ্ছে, কোনো জিন-পরী এসে মন্ত্রী বাহাদুরের জুতাজোড়া নিয়ে চলে গেছে। অগত্যা মন্ত্রী বাহাদুর কী আর করেন- জুতাজোড়া ছাড়াই গাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন। এ দৃশ্য দেখে নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিতদের একজন পেছন থেকে মন্ত্রী বাহাদুরের সামনে এসে দাঁড়াল। এই নিরাপত্তারক্ষীর নাম আজমল। আজমল আর্তনাদের সুরে বলে উঠল-
: স্যার...
মন্ত্রী বাহাদুর আজমলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
: কিছু বলবা?
: আপনি স্যার, খালিপায়ে স্যার, এইভাবে স্যার, গমন করবেন না স্যার!
আজমলের কথা শুনে মন্ত্রী বাহাদুর হেসে বললেন-
: আমার ঠ্যাং তো খালি না রে পাগলা! মোজা আছে।
ঘাড় নেড়ে আজমল বলল-
: কিন্তু আমি এইটা মাইন্যা নিতে পারতেছি না স্যার। আপনে এইরকমভাবে গোড়ালিতে ভর দিয়া বকের মতন দেড়ঠ্যাইঙ্গা হইয়া হাঁইট্টা যাবেন, জীবন থাকতে এইটা হইতে দিব না স্যার।
: কী করবা?
: যদি সম্ভব হইত তাইলে নিজের শরীরের চামড়া দিয়া আপনের জন্য পাদুকা তৈরি কইরা লইতাম। কিন্তু সেইটা তো আর সম্ভব না। অতএব...
: অতএব কী!
: আপনি আমার ঘাড়ে উঠেন স্যার। আমি আপনাকে গাড়ি পর্যন্ত বহন কইরা লইয়া যাই।
আজমলের কথা শুনে মন্ত্রী বাহাদুর রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারলেন না। হেসে বললেন-
: আমার ভার তুমি বইতে পারবা?
আজমল মাথা নিচু করে বলল-
: এই ঘটনা আগে ঘটলে সংশয় প্রকাশ করতাম বটে। কিন্তু অক্ষণ আর সংশয় প্রকাশের কোনো অবকাশ নাই। কারণ...
: কারণ!
: কারণ আপনে এখন মন্ত্রী।
মন্ত্রী বাহাদুর আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গি করলেন। চোখ বড় করে আজমলের উদ্দেশে বললেন-
: মন্ত্রীর জন্য সবকিছু করা যায়?
মুচকি হেসে আজমল বলল-
: শুধু মন্ত্রী বলতেছেন কেন স্যার! মন্ত্রীর বৌ, মন্ত্রীর পোলা, মন্ত্রীর মাইয়া, শালা-সমন্ধি, চাচা-জ্যাঠা, চাচি-ফুপু, ভাতিজা-ভাইগ্না এবং তাদের ইয়ার-দোস্ত-পোষ্য, এমনকি মন্ত্রী মহোদয়ের পোষা বিড়ালটার জন্যও জান কোরবান করা যায় স্যার।
আজমলের কথা শুনে মন্ত্রী বাহাদুর খুশি হলেন। বিগলিত স্বরে বললেন-
: তোমার কথায় বোঝা যাইতেছে, মন্ত্রীর জন্য সাতখুন মাফ।
: সাত নয়, চৌষট্টি খুন মাফ। আপনের সদয় অনুমতি পাইলে উদাহরণ সহযোগে বিষয়টা খোলাসা করবার চাই।
: বলো, শুনি।
: আপনি যখন মন্ত্রী ছিলেন না, তখনকার কথা ভাইব্যা দেখেন স্যার। ওই সময় আপনার বায়ু নির্গমন হইলেই আমরা বলতাম- ব্যাটা কাপড় নষ্ট কইরা ফেলছে, ড্রাইওয়াশ দরকার। আর এখন আপনের বায়ু নির্গমন ঘটলে বলি, প্রকৃতি বিনামূল্যে বিশুদ্ধ বাতাস লাভ করল। ওই সময়ে আপনে রাস্তায় বাইর হইলে বলতাম, রাস্তা জনগণের, আপনে তফাৎ যান। আর এখন আপনে রাস্তায় বাইর হইলে বলি- রাস্তা মান্যবর মন্ত্রীর; জনগণ তফাৎ যাও। পূর্বে কেউ আপনাকে ডাইক্যা আনতে বললে বাইন্ধা আনতাম। আর বর্তমানে বাইন্ধা আনতে বললে কোলে তুইল্যা আনি। পূর্বে আপনে যা বলতেন, সবই মিথ্যা প্রতিপন্ন করতাম। আর এখন আপনেরা যা বলেন, সবকিছু দৈববাণীর ন্যায় সত্য ভাবি।
: তার মানে এই জুতা চুরির ঘটনা যদি পূর্বে ঘটত, তাইলে অবিশ্বাস করতা?
: আলবৎ করতাম স্যার এবং শুধু তাই নয়- বলতাম, আপনে বগলের নিচে জুতা লুকাইয়া রাইখ্যা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য নতুন কাহিনীর অবতারণা করছেন। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি প্রদান কইরা এইটা যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার মারাত্মক চক্রান্ত, সেই ব্যাপারে দেশবাসীকে সতর্ক করা হইত।
: আর এখন?
মন্ত্রীর প্রশ্ন শুনে আঙুল মুচড়িয়ে আজমল বলল-
: বলতে কিঞ্চিৎ শরম বোধ হইতেছে।
মন্ত্রী বাহাদুর হেসে বললেন-
: তোমার কথা শুনতে ভালোই লাগতেছে। বইল্যা ফেল।
আজমল দম নিয়ে বলল-
: এখন যদি আপনে ল্যাংগুট হারাইয়া যাওয়ার কথাও প্রকাশ করেন, আমরা কোনো প্রশ্ন উত্থাপন না কইরা বিশেষ উদ্ধার কর্মসূচি ঘোষণা করব। বিষয়টা লইয়া সংবাদমাধ্যমে বিশেষ প্রতিবেদন, বিশেষ অনুষ্ঠান ও জাতির কাছে দুইটা প্রশ্ন রাখব।
: দুইটা প্রশ্ন কেন!
: বুঝতে পারলেন না স্যার?
: না।
: এর আগে জাতির কাছে একটা প্রশ্ন উত্থাপন করা হইয়া গেছে। এখন পুনরায় একটি প্রশ্নের অবতারণা করা মানে কলঙ্ক। কাজেই আগের চাইতে ডাবল করতে হবে।
: ডাবল?
: হ, ডাবল। আগে যেখানে একটা মিথ্যাচার হইছে, এখন সেইখানে দুইটা মিথ্যাচার করতে হবে। যে ঘটনাকে উপলক্ষ করিয়া আগে একটা খুন হইছে, এখন সেই একই কারণে দুইজনকে ডেথ সার্টিফিকেট প্রদান করতে হবে। আগে একঘন্টায় একজন ধর্ষণের শিকার হইলে এখন একঘন্টায় দুইজনকে ধর্ষণ করতে হবে। আগে কেউ এক টাকা ঘুষ খাইলে তারে দুই টাকা খাইতে বলতে হবে। আগে যেখানে একটা চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে, এখন সেখানে দুইটা চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটাইতে হবে। আগে যেখানে একটা দখল ঘটনা ঘটছে, এখন সেখানে দুইটা দখলের ঘটনা ঘটাইতে হবে। তাইলেই মান-সম্মান থাকবে। ইজ্জত রক্ষা হইবে।
: এমন পরামর্শ কি তুমি আমার পূর্ববর্তী মন্ত্রীদেরও প্রদান করছো?
: জি স্যার, করছি স্যার।
: এখন আবার আমারেও করতেছো?
: জি।
: তোমারে তাইলে কোন পক্ষের লোক বইল্যা গণ্য করব?
: আমার কোনো পক্ষ নাই স্যার। আমি হইলাম আপনের গায়েব হইয়া যাওয়া জুতার মতন। যখন যার পদযুগলে থাকি, তখন তাকেই ধারণ করি।
: এইটা তো মিয়া মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। তাছাড়া যেসব কথাবার্তা তুমি বললা, তার সবই ধ্বংসাত্মক। এইসব না কইরা আমরা যদি মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে গিয়া সত্যভাষণের চর্চা করি, খুন-খারাবির পরিবর্তে জীবনর গান গাই, মা-বোনদের সম্ভ্রম রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, ঘুষ-চাঁদাবাজি-দখলদারির বদলে নৈতিকতা, শৃঙ্খলাবোধ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করি, তাইলে কেমন হয়?
: অতি উত্তম হয় স্যার। কিন্তু এরূপ করতে গেলে আপনের মন্ত্রিত্ব ছুইট্টা যাবে আর আমারও চাকরি থাকবে না।
: আমার মন্ত্রিত্ব ছুইট্টা যাবে কেন!
: কারণ বর্তমানকালের রাজনীতি হইল আঘাতের বদলে প্রতিঘাত, সুযোগের সদ্ব্যবহার, সুবিধাবাদ, নৈতিকতার বিসর্জন এবং প্রতিহিংসা চরিতার্থের চারণভূমি। এখানে আপনে পুষ্পচর্চা করতে গেলে অবশ্যই বাতিল মাল বইল্যা গণ্য হবেন।
: হু! বুঝলাম। কিন্তু তোমার চাকরি চইল্যা যাবে কেন, বুঝতে পারতেছি না।
মন্ত্রী বাহাদুরের প্রশ্নের উত্তরে আজমল হেসে বলল-
: স্যার, আপনে যা যা বললেন- রাজনীতি সেই পরিবেশ তৈরি করে, তাইলে তো বন্দুকের নলে নারকেল তেল মালিশ করা ছাড়া আমাদের কোনো কাজ থাকবে না। এই দেশ তখন সুইজারল্যান্ড হইয়া যাবে। বাংলাদেশ যদি সুইজারল্যান্ড হইয়া যায়, তাইলে আমাদের আর প্রয়োজন কী?
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
onnachitra.bd@gmail.com
