Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শিখন ঘাটতি পূরণে এসাইনমেন্টই সবচেয়ে কার্যকর

Icon

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিখন ঘাটতি পূরণে এসাইনমেন্টই সবচেয়ে কার্যকর

সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) এক গবেষণা প্রতিবেদনে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পরিমাপ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

শিখন ঘাটতির ওপর এ গবেষণাটি যেহেতু করোনার সময় করা হয়েছে, সেহেতু মনে হচ্ছে করোনার কারণেই এ শিখন ঘাটতি। এ কারণে কিছু পত্রিকার রিপোর্টে এটিকে করোনাজনিত শিখন ঘাটতি হিসাবেই দেখানো হয়েছে। কিন্তু এ ঘাটতিকে করোনাজনিত শিখন ঘাটতি বলা যাবে না।

যে পদ্ধতিতে এ শিখন ঘাটতি নিরূপণ করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেই একই পদ্ধতিতে যেহেতু করোনার আগে কখনো শিখন ঘাটতি নিরূপণ করা হয়নি, তাই করোনার কারণে কতটুকু শিখন ঘাটতি হলো, তা এ গবেষণার ফলাফল দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। স্বাভাবিক সময়েও প্রতিবছর প্রায় সব শিক্ষার্থীর কিছু না কিছু শিখন ঘাটতি থাকে, যা মাউশি ২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৯ সালে পরিমাপ করার চেষ্টা করেছে; কিন্তু পদ্ধতিগত অমিল থাকার কারণে ২০২২-এর গবেষণার সঙ্গে সেগুলো তুলনা করা যাচ্ছে না।

যাই হোক, অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় শিক্ষার্থীদের পাঁচটি লেভেলে ভাগ করা হয়েছে-১ম লেভেল (উত্তম), ২য় লেভেল (ভালো), ৩য় লেভেল (স্বল্প মাত্রার শিখন ঘাটতি), ৪র্থ লেভেল (মধ্যমমাত্রার শিখন ঘাটতি) এবং ৫ম লেভেল (উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি)। রিপোর্টে যেসব ভৌগোলিক এলাকায় উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি (৫ম লেভেল) বেশি দেখা গেছে, সেসব এলাকায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। জাতীয়ভাবে ৫ম লেভেলে থাকা শিক্ষার্থীর হার বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে যথাক্রমে ৩১.৩, ৩৮.৫ ও ৩৮.৮ শতাংশ। গবেষণায় ৪র্থ ও ৫ম লেভেলের শিক্ষার্থীদের নিরাময়ের জন্য কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। সুপারিশগুলো হচ্ছে-টিভি ক্লাস, অনলাইন ক্লাস, অতিরিক্ত ক্লাস ও এসাইনমেন্ট।

সুপারিশগুলো ভালো এবং অতিরিক্ত ক্লাস ছাড়া আর বাকি তিনটি সম্পর্কে ইতোমধ্যে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে। ২০২০ সালের ১৬ মার্চ করোনার কারণে হঠাৎ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য মরিয়া হয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে টিভি ক্লাস শুরু করা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় অনলাইন ক্লাস। এ গবেষণাতেই দেখা যাচ্ছে, এ দুটো মাধ্যমই সেই সময় কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে; কিন্তু বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, টেলিভিশন ও ডিভাইসের অভাবে দেশের সব শিক্ষার্থী এ দূরশিক্ষণের সুবিধা নিতে পারেনি। এ কারণেই করোনা শুরু হওয়ার ৭-৮ মাসের মাথায় মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য একেবারে নতুন একটি শিখন-শেখানো-মূল্যায়ন পদ্ধতির (এসাইনমেন্ট) প্রবর্তন করতে হয়। উদ্দেশ্য ছিল ধনী-গরিব ও গ্রাম-শহরের মধ্যে যেন বিভেদ তৈরি না হয়। আরও উদ্দেশ্য ছিল, শিক্ষার্থীরা যেন স্ব-শিক্ষা গ্রহণে সচেষ্ট, সক্ষম ও উদ্যোগী হয়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে উদ্দেশ্য সফল হয়। ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে অন্য জায়গায়। অনেকে বললেন, বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে এসাইনমেন্ট পদ্ধতি উপযোগী নয়।

সমালোচকদের কথায় যুক্তি ছিল। তাদের অনেকেই বলছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় অধ্যাপকদের বিরুদ্ধে যেখানে নকল করে আর্টিকেল লেখার অভিযোগ ওঠে, সেখানে এসাইনমেন্ট লেখার সময় আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তো নকল করবেই। আর ওরা নকল করলে তো দেখারও কেউ নেই। শিক্ষকরা তো আর ভালো করে খাতা দেখবেন না। ফলে পুরো কার্যক্রমটাই যে ব্যর্থ হবে, তা তারা তাদের দিব্য চোখে স্পষ্ট দেখতে পেলেন। এই ভবিষ্যদ্বাণীতে যে লাভটা হলো তা হচ্ছে-আমরা শিক্ষা কর্মকর্তারা সতর্ক হয়ে গেলাম। এবং লক্ষ করলাম তাদের ভবিষ্যদ্বাণী একেবারে অমূলক নয়। শিক্ষার্থীরা সত্যি সত্যি ইউটিউব দেখে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকে এসাইনমেন্টগুলো লেখার চেষ্টা করছে। অবশ্য এটুকুতে আমাদের আপত্তি ছিল না, এসাইনমেন্ট লেখার আগে ওরা যত বেশি আলোচনা বা যত বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করে, ততই ভালো। আমাদের আপত্তি ছিল শুধু হুবহু নকলের ক্ষেত্রে। সেটা বন্ধ করার জন্য আমরা মনিটরিং বাড়িয়ে দিলাম, মৃদু শাস্তির ব্যবস্থা করলাম এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করলাম। তাতে কিছুটা কাজ হলো। প্রথম দিকে এ নকল করার কথা যতটা শুনছিলাম, পরের দিকে আর তত শুনিনি বা সরেজমিন খাতা পরীক্ষা করে তার তেমন নজিরও পাইনি।

এ গবেষণা অনুযায়ী বাংলায় ৭৬, ইংরেজিতে ৮২ ও গণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর যে উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি হয়নি, তার পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে এই এসাইনমেন্ট। আমরা যে ভেবেছিলাম শিক্ষার্থীরা সব নকল করবে আর শিক্ষকরা হেলাফেলা করে তা দেখেও না দেখার ভান করবেন, তা সত্যি হয়নি। যেমন এই গবেষণাই বলছে, যে শিক্ষার্থী যত ভালোভাবে এসাইনমেন্ট কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে, সে এ গবেষণার পরীক্ষাতেও তত ভালো করেছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ইংরেজিতে যেসব শিক্ষার্থী এসাইনমেন্টে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের ভেতর উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি ৩৮.২ শতাংশ; কিন্তু যারা এসাইনমেন্টে অংশগ্রহণ করেনি, তাদের মধ্যে উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি অনেক বেশি-৫৫.২ শতাংশ। আবার ওই ইংরেজিতেই যেসব শিক্ষার্থীর বেশিরভাগ এসাইনমেন্টের মন্তব্যের ঘরে ‘অগ্রগতি প্রয়োজন’ লেখা ছিল, তাদের ভেতর ৬৯.৬ শতাংশের উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি হয়েছে। যাদের মন্তব্যের ঘরে ‘ভালো’ লেখা ছিল, তাদের ভেতর উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি সম্পন্ন শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে ৫৯.৬ শতাংশ হয়েছে। যাদেরকে ‘উত্তম’ লেখা হয়েছিল, তাদের ভেতর উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি হয়েছে আরও কম-৪৫.১ শতাংশ শিক্ষার্থীর। আর ‘অতি উত্তম’ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভেতর মাত্র ৩১.৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি দেখা গেছে। আর স্কেল স্কোর দিয়ে বিবেচনা করলে ‘অগ্রগতি প্রয়োজন’ পাওয়া শিক্ষার্থীদের স্কেল স্কোর ৩২৭; ‘ভালো’ পাওয়া শিক্ষার্থীদের স্কেল স্কোর এর ১ বেশি-৩২৮। যারা ‘উত্তম’ পেয়েছিল, তাদের স্কেল স্কোর এরও ১৩ বেশি-৩৪১। এবং ‘অতি উত্তম’ পাওয়া শিক্ষার্থীদের স্কেল স্কোর তার চেয়েও ১৬ বেশি-৩৫৭। অর্থাৎ এতে প্রমাণিত হয় শিক্ষার্থীরা যেমন এসাইনমেন্ট তৈরি করে উপকৃত হয়েছে, শিক্ষকরাও তেমনি সেগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেছেন।

শুধু এ গবেষণা নয়, এর আগেও এসাইনমেন্টের ওপর বেডু আরেকটি গবেষণা করেছিল। সেখানেও দেখা গেছে, এসাইনমেন্ট করে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়েছে, তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে এবং তারা স্ব-শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। যেমন, এ রিপোর্টে ৭২.১ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৮৭.৬ শতাংশ অভিভাবক এবং ৯১.৮ শতাংশ শিক্ষক বলছেন, এসাইনমেন্ট শিক্ষার্থীদের স্ব-শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেছে। একইভাবে ৭৮.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৮৬.৯ শতাংশ অভিভাবক এবং ৮৪.৬ শতাংশ শিক্ষক বলছেন, এসাইনমেন্ট করতে দিলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় আরও বেশি মনোযোগী হয়।

সব দেশে সব সময় শিক্ষার্থীদের যা শেখার কথা, তা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই পুরোপুরি শেখে না বা শিখতে পারে না। করোনার কারণে এ ঘাটতি হয়তো এবার বেশি হয়েছে। এ ঘাটতি পূরণের জন্য সবচেয়ে কার্যকর, সবচেয়ে সহজলভ্য এবং সবচেয়ে পরীক্ষিত উপায় হচ্ছে এসাইনমেন্ট। টিভি ক্লাস ও অনলাইন ক্লাসও কার্যকর, কিন্তু সবার তো সেই ক্লাস করার সুযোগ নেই। বাড়তি ক্লাস নিয়েও এ নিরাময় করা সম্ভব, কিন্তু বাড়তি ক্লাস নিতে শিক্ষকদের বাড়তি সময় দিয়ে বাড়তি পরিশ্রম করতে হবে। অনেক স্কুলে শিক্ষক স্বল্পতার জন্য শিক্ষকদের এমনিতেই বাড়তি ক্লাস করতে হয়। এর ওপর আরও বাড়তি ক্লাস চাপিয়ে দিলে সেটা তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে।

শুধু শিখন ঘাটতি পূরণের জন্য নয়, আমাদের এমনিতেই এসাইনমেন্ট চালু রাখতে হবে। ২০২৩ সালে যে শিক্ষাক্রম আসছে সেটি হবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, ব্যক্তিগতকৃত ও স্ব-শিক্ষানির্ভর। ফলে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করার জন্য হলেও আমাদের শিক্ষার্থীদের এসাইনমেন্টে আরও বেশি অভ্যস্ত করে তুলতে হবে।

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক : মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক

দৃষ্টিপাত.

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম