Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষা : সংস্কার প্রয়োজন

Icon

সোহেল রানা

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষা : সংস্কার প্রয়োজন

আধুনিক সমাজব্যবস্থা যে ভিত্তিগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের প্রাণীসত্তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে মানুষকে সামাজিক জীব হিসাবে গড়ে তোলে, মানুষকে আধুনিক ও অত্যাধুনিক সভ্যতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

শিক্ষা আমরা নানা উপায়ে অর্জন করে থাকি; কখনো প্রকৃতি থেকে, কখনো আমরা যেসব মানুষ বা প্রাণীর সংস্পর্শে আসি, তাদের থেকে, কখনো অভিজ্ঞতা থেকে, কখনো বা দার্শনিকদের মতো চারপাশকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। আবার কখনো কখনো এই শিক্ষা ঐশ্বরিকও হতে পারে। আধুনিক মানুষের জীবনব্যবস্থায় শিক্ষার এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনুধাবন করে পৃথিবীর প্রায় সব জাতিই শিক্ষার একটি আনুষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড় করিয়েছে।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সিংহভাগ দেশের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার যে কাঠামো রয়েছে তা মূলত প্রাথমিক ও প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ের মাধ্যমে শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন বাধ্যতামূলক; সরকার বিনামূল্যে এ শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে।

২০১৬ সালের প্রাথমিক শিক্ষা শুমারির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের যেসব শিক্ষার্থীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়স হয়েছে, তাদের মধ্যে ১০০ জনে প্রায় ৯৮ জন শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে (তথ্যসূত্র : প্রাথমিক শিক্ষার অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট)। আর এই ৯৮ জনের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পেরেছে প্রায় ৮০ জন, ঝরে পড়েছে প্রায় ১৮ জন শিক্ষার্থী।

পরিসংখ্যানে এ হার দেখতে বেশি হলেও প্রাথমিক শিক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীর হারের সঙ্গে জনগোষ্ঠীর দক্ষ হয়ে ওঠার সম্পর্ক সমানুপাতিক নয়। উদাহরণস্বরূপ, একই সময়ে সিঙ্গাপুরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ১০০ জনে প্রায় ৯৮ জন। তাই বলে কি আমরা সিঙ্গাপুরের মতো দক্ষ প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনকারী জনগোষ্ঠী গঠন করতে পেরেছি? সম্ভবত না।

ভর্তির শতকরা হারের পরিসংখ্যানে এগিয়ে থাকার পরও একটি দেশ নানা কারণে প্রাথমিক শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে একটি হলো পলিসি বা নীতিমালা। প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে কোন কোন শিক্ষণ লক্ষ্যমাত্রা (ব্যক্তিগত ও সামাজিক) অর্জিত হবে, এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উপকরণ যেমন-কারিকুলাম, শিক্ষণ পদ্ধতি, শিক্ষক ও মূল্যায়ন পদ্ধতি কেমন হবে; যারা শেখাবেন, তাদের মান কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে; কীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা চলবে-এসব প্রশ্নই মূলত নীতিমালার অংশ।

শিক্ষানীতি যত সময়োপযোগী হবে, বাস্তবায়নযোগ্য হবে ও সৃষ্টিশীল হবে, ততই এ নীতি অনুসরণকারী শিক্ষা ব্যবস্থা তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা সহজে অর্জন করবে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বিধৃত নীতিমালা সময়োপযোগী, বাস্তবায়নযোগ্য ও সৃষ্টিশীল হওয়ার এ চাহিদা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে?

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে, প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে মূল যে লক্ষ্য বাংলাদেশ অর্জন করার চেষ্টা করবে, তার মধ্যে অন্যতম হলো-১. মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ, পাঠ্যপুস্তকে দেশজ উপাদান ও আবহকে অন্তর্ভুক্ত করা, ২. আনন্দময় পরিবেশে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধন, ৩. কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন পাঠ্যক্রমে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির অধীনে দেশের সব বিদ্যালয়ে পাঠদান সম্পন্ন করা, ৪. পিছিয়ে পড়াদের দিকে বিশেষ নজর ও বিশেষ ব্যবস্থা, ৫. আদিবাসীসহ ও সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা, ৬. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত জনগোষ্ঠী তৈরি, ৭. শিশুর মনে ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, মানবাধিকারের বোধ জাগ্রত করা ইত্যাদি।

আমাদের শিক্ষানীতির সময়োপযোগিতা দেখতে ভারতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-এ বিধৃত উদ্দেশ্যগুলোর দিকে তাকানো যেতে পারে। ভারতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের শিক্ষা নীতিমালা অনুসারে, দুই দেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে কিছু মিল থাকলেও মৌলিক কিছু ভিন্নতা আছে, যা শিক্ষার সময়োপযোগিতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

যেমন ধরা যাক, বর্তমান সময়ের শিক্ষায় নানা বিষয়ের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান; অর্থাৎ বিজ্ঞান, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়গুলো আলাদা আলাদাভাবে শেখানো হলেও এসব বিষয়বস্তু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ভারতীয় শিক্ষানীতিমালায় এ পারস্পরিক সম্পর্ককে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ভারতীয় শিক্ষানীতির মূল দলিলে লেখাটি এরকম-‘multidisciplinarity and a holistic education across the sciences, social sciences, arts, humanities, and sports for a multidisciplinary world in order to ensure the unity and integrity of all knowledge.’ আবার ধরা যাক, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার ব্যাপারে ভারতীয় শিক্ষানীতিতে জোর দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ অনেকটাই নিষ্ক্রিয় প্রকৃতির। এ অংশগ্রহণ যতক্ষণ পর্যন্ত না সক্রিয় হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় নিজেদের শতভাগ যুক্ত করবে না। নীতিমালার এসব বিষয় শিক্ষার মানসংশ্লিষ্ট হওয়ায় নীতিমালাকে সময়োপযোগী হতে হলে মানের সঙ্গে সম্পর্কিত এ বিষয়গুলো পরিষ্কার করার প্রয়োজন হবে এবং সরকারের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বর্তমান লক্ষ্যমাত্রার আলোকে নীতিমালার সংস্কার প্রয়োজন।

অপরদিকে, শিক্ষার ধারণা দুনিয়াব্যাপী বদলে গেছে। ইন্টারনেটের কারণে শিক্ষা উপকরণগুলো সহজলভ্য হয়েছে; যে কোনো জ্ঞানের উৎসে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে প্রবেশাধিকার পাওয়া যাচ্ছে। স্বশিক্ষা অর্থাৎ সেলফ-লার্নিং এখন ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে সহজ। এর ফলে শুধু ইউটিউব দেখেই অনেকে উড়োজাহাজ বানিয়ে ফেলছে। এ রকম এক প্রেক্ষাপটে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কাঠামো নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন টিচিং রোবট। বর্তমান যুগের নদীর মতো স্বাধীন শিক্ষার এ বহমানতাকে আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। কীভাবে এক একজন শিশু দক্ষ সেলফ-লার্নার হয়ে উঠতে পারে, সেটি বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।

জাতীয় শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে তথ্য ও প্রযুক্তি শিক্ষায় জোর দেওয়া হলেও প্রযুক্তির সঙ্গে শিক্ষণ পদ্ধতির এ সম্পর্ককে খুব একটা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তবে আশার কথা হলো, সরকার শিক্ষণ পদ্ধতি হালনাগাদ করার এ প্রয়োজন উপলব্ধি করে সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

বৈষম্য আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম বড় সীমাবদ্ধতা এবং এ বৈষম্য দূরীকরণে আমাদের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা আছে। শিক্ষানীতিতে এ বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ করা হলেও এসব কৌশলের বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এই বৈষম্যগুলো মূলত অবকাঠামোগত দুর্বলতা, আর্থ-সামাজিক পরিবেশ, শিক্ষকদের মানের ভিন্নতা, শিক্ষার ব্যবস্থাপনার ভিন্নতা ইত্যাদি থেকে উৎসারিত হয়। শিশুরা যতটা না প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থেকে শেখে, তার চেয়ে অনেক বেশি চারপাশ থেকে শেখে। শিক্ষানীতিতে শিক্ষার এ চারপাশ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকলে নীতিমালাটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো।

সর্বোপরি একটি পূর্ণাঙ্গ, সময়োপযোগী, সৃষ্টিশীল ও বাস্তবায়নযোগ্য শিক্ষা নীতিমালা প্রাথমিক শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা, বিশেষ করে গুণগত মান সম্পর্কিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া এ নীতিমালা ঠিক কত সময় পরপর হালনাগাদ করা হবে, সেটিও সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) অভীষ্ট ৪-এ অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষার লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে। এ অভীষ্ট ২০১৫ সালে প্রণীত হওয়ায় এবং শিক্ষা নীতিমালা ২০১০ সালে প্রণীত হওয়ায় নীতিমালায় অভীষ্টের সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তাছাড়া পৃথিবী যে হারে বদলে যাচ্ছে, তাতে শিক্ষা নীতিমালা অন্ততপক্ষে প্রতি পাঁচ বছরে পরিমার্জন করা এমনিতেই প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

আর এ নীতিমালা প্রণয়নে গবেষণাকে যত বেশি অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তত বেশি কার্যকর হবে। যদিও নীতিমালা তৈরি করলেই যে সেটি আমাদের দেশের মতো এত চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে শতভাগ বাস্তবায়ন করা যাবে, তেমনটিও নয়; তদুপরি, একটি বাস্তবায়নযোগ্য পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান ও ফলাফল উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।

সোহেল রানা : উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ব্রাহ্মণপাড়া, কুমিল্লা

প্রাথমিক শিক্ষা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম