নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
কেমন গেল দুর্গোৎসবের অর্থনীতি
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। পাঁচদিনের পূজার ৫ম দিন ছিল দশমী, তিথি অনুসারে। সারা দেশে ৩২ হাজার মন্দিরে-মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে খবর। এ সংখ্যা গতবারের চেয়ে বেশি। পূজা উপলক্ষ্যে দশমীর দিন ছিল সরকারি ছুটি।
মাঝখানে একটা দিন বৃহস্পতিবার অফিস খোলা। রোববার হবে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি। সেদিন সরকারি ছুটি আছে। এক কথায় বলতে গেলে, সপ্তাহের শেষ এবং সপ্তাহের প্রথম দিনটা ছুটিতেই কেটে গেল। পূজা উপলক্ষ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই পূজা মণ্ডপে গিয়ে পুণ্যার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
নবমীর দিন বেশ কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। ঘটেছিল সারা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয়। আশঙ্কা ছিল-এর সুযোগ নিতে পারে উগ্র একটা গোষ্ঠী। দৃশ্যত এমন কিছু ঘটেনি। বোঝা যায়, সরকারের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা কাজে লেগেছে। মণ্ডপে মণ্ডপে লাখ লাখ পূজার্থী ঘুরেফিরে পূজার আনুষ্ঠানিকতা উপভোগ করেছেন। উপভোগ করেছেন মনোরম আবহাওয়া। আসলে এটা শারদীয় উৎসব।
এখন আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি। শরৎকাল। দেশের অনেক জায়গায় অগ্রহায়ণী ফসল উঠতে শুরু করেছে। এটা হবে আমাদের আমন ফসল, যা একসময় ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধানি ফসল। এখন অবশ্য বোরো ফসল এর স্থান দখল করেছে। সে যাই হোক, কৃষিসভ্যতার কৃষকরা কিছুদিনের মধ্যেই সার্বিকভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন আমন ফসল ঘরে তুলতে। এ সময় পাট ফসল ঘরে তোলার সময়। সামনে হেমন্ত ও শীতকাল।
তখন প্রকৃতিগতভাবে আমাদের অঞ্চলের মানুষের জীবনে এক ধরনের শ্লথগতি দৃশ্যমান হয়। আমনের পর বেশকিছু সময় মোটামুটি অবসর। এই ফাঁকেই বাঙালি হিন্দরা দুর্গা উৎসবের অনুষ্ঠান করে। বস্তুত এই আনন্দ উৎসব দুর্গাপূজা দিয়েই শেষ হয়। দুর্গাপূজার পর পঞ্চদশীর (পূর্ণিমা) দিন হবে লক্ষ্মীপূজা (কোজাগারি পূজা)। ধনের সন্ধানে বাঙালি। তারপর কৃষ্ণপক্ষে অর্থাৎ অমাবস্যাতে তারা করবে কালীপূজা।
পরে পালাক্রমে হবে কার্তিক পূজার (কার্তিকী ফসল/অগ্রহায়ণী/আমন ফসল তোলা) উৎসব এবং সরস্বতী পূজা। চৈত্র মাসে বাসন্তী পূজা দিয়ে এ যাত্রা শেষ, যখন প্রকৃতি নতুন সাজে সাজবে। কৃষকরা ব্যস্ত হবে নতুন জীবনের জন্য, জীবনে গতি ফেরানোর জন্য।
বস্তুত পুরো বিষয়টিই ফসলকেন্দ্রিক। ফসলি সভ্যতার প্রতীক। ড. শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, দুর্গাপূজার নানা ধারা এসে মিশেছে পালাক্রমে। প্রধানটি হচ্ছে ‘শস্য’ ধারা বা শস্যপূজা। ‘শক্তির’ ধারা; ভগবতীর ধারা ধীরে ধীরে সংযোজিত হয়েছে। বলা যায় বিবর্তন। এই বিবর্তন এখনো চলছে আমাদের দেশে ও প্রতিবেশী ভারতে। এখন সর্বত্রই ‘থিম’ পুজা হয়। একেকটি ‘থিমের’ ওপর একেকটি মণ্ডপ/মন্দির। কোথাও অজন্তা-ইলোরা, কোথাও আগ্রার দুর্গ, কোথাও গৌতম বুদ্ধ-এমনই সব। সাবেকি পূজা ধীরে ধীরে বিবর্তিত হচ্ছে।
‘শস্য, শক্তি ও ভগবতী’-এই ধারা শুধু নয়, এখন ধারা উপকরণে প্রতিমা গড়ার চল হয়েছে। পূজা, দুর্গাপূজা ধীরে ধীরে উৎসব-অনুষ্ঠানপ্রধান হয়ে উঠেছে। প্রথমে ছিল ধনীদের বাড়িতে পূজা, পরে এসেছে বারোয়ারি (বারো ইয়ার) পূজা-আনন্দ বর্ধনের জন্য, মানুষের অংশগ্রহণের জন্য। পূজার যেমন ধর্মীয় দিক আছে, তেমনি আছে সংস্কৃতির দিক, আলোকসজ্জার দিক, রয়েছে বাণিজ্যিক দিক। পূজাকে কেন্দ্র করে বেশ বড় ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। আগে এমনটা ছিল না। অর্থকড়ির টানাটানি ছিল।
আগে জামা-কাপড়, জুতা-মোজা ও প্রসাধনী সামগ্রীর বাজারই ছিল মুখ্য। এসবের ব্যবসা হতো ভালোভাবে। গ্রামাঞ্চল নতুনভাবে সেজে উঠত। শহরের চেয়ে গ্রামে আনন্দ হতো বেশি। এখন শহর-নগর-গ্রামে কোনো তফাৎ নেই। সর্বত্রই ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’। প্রচুর ব্যবসা। ঢাকা শহরেও জামা-কাপড়, শাড়ি-ব্লাউজ, রেডিমেড পোশাক, প্রসাধনী সামগ্রীর বাজার জমে উঠেছিল।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তখনকার মধ্যবিত্তরা দেশত্যাগ করে চলে যায়। এরপর গত ৭০-৭৫ বছরে নতুন একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি, হিন্দু মধ্যবিত্ত তৈরি হয়েছে। তাদের মধ্যে অতিধনীরাও আছেন। গুলশান, বনানী, উত্তরা মডেল টাউনের দুর্গাপূজা তারই একটা লক্ষণ। এই নতুন মধ্যবিত্ত দুই বছর পর প্রাণভরে এবার পূজা উপভোগ করেছে। করোনার কারণে বিগত দুই বছর পূজায় অনেক সমস্যা ছিল।
কিন্তু এবার এসব বাধা-নিষেধ নেই। পরিবেশও শান্ত। এ কারণে পূজার বাজার জমে উঠেছে। প্রচুরসংখ্যক হিন্দু মধ্যবিত্ত দেশের বাইরে বেড়াতে গেছেন, দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তারা গিয়েছেন প্রতিবেশী ভারতে। এতে হোটেল, পর্যটন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবসা বেশ ভালোই হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম অত্যধিক। প্রায় দ্বিগুণ, দেড়গুণ। এতেও বাজার খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
পূজায় ফুলের ব্যবসা, কাঁশফুলের ব্যবসা, পদ্মফুল, শালুকের ব্যবসা ভালো হয়েছে। এগুলো পাঁচদিন ধরে পূজায় লেগেছে। পূজায় যেসব উপকরণ লাগে তার সবই কৃষি ফসল। ধান, দূর্বা, ফল, চাল, কলা, হরীতকী, আমলকী, হরিদ্রা থেকে শুরু করে কী লাগে না! লাগে বিশেষ ধরনের মাটিও, যার দ্বারা প্রতিমা তৈরি হয়। এসবের ব্যবসা হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী, কৃষক এতে উপকৃত হয়েছেন। খিচুড়ি, মিষ্টি, দুধ ইত্যাদির উপকরণ লেগেছে। এর ব্যবসা হয়েছে।
বস্তুত পূজাকে, পূজার ব্যয়কে অনেকে অনুৎপাদনশীল ব্যয় বলে মনে করলেও বাস্তবে দেখা যায় একে কেন্দ্র করে অর্থনীতি, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে, যেমন হয়ে ওঠে পবিত্র ঈদের সময়। পূজায় উপকৃত হন প্রতিমা শিল্পীরা, যারা প্রতিমা বানান। এটা একটা মাটির শিল্প। এ কাজ সবাই করে না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা ‘কাস্ট’ বা শ্রেণি আছে, যারা প্রতিমা বানায়। ৩২ হাজার প্রতিমা তৈরি করতে শিল্পীদের অনেকদিন ব্যস্ত থাকতে হয়েছে, যা তাদের জীবিকা। প্রতিমা বানাতে রং, মাটি, খড় থেকে শুরু করে নাান বিচিত্র ধরনের উপকরণ লাগে।
এসবের ব্যবসা হয়েছে। পূজা উপলক্ষ্যে বাদ্য-বাজনার সমারোহ ঘটে। ঢাকি সম্প্রদায়ের কদর বাড়ে। পাঁচদিনের জন্য তারা ভালো ব্যস্ত থাকেন-এটাও তাদের জীবিকা। ভালো ভালো ঢাকি, বাঁশিওয়ালাদের বেশ পারিশ্রমিক দিতে হয়। প্রতিমা স্থাপন করার জন্য মঞ্চ লাগে, আশপাশ সাজাতে হয়। আগের দিনে সাবেকি কায়দায় এসব কাজ হতো। এতে শিল্পীদের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। কিন্তু এখন তা নয়।
এখন ‘থিমের’ পূজা চালু হওয়ার পর শিল্পীদের, আর্ট স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তারা রীতিমতো পারিশ্রমিক পান, ভালো পারিশ্রমিক। বলাই বাহুল্য, তাদের অংশগ্রহণের ফলে পূজার মণ্ডপের/মন্দিরের শোভা বহুগুণ বেড়েছে। বস্তুত অনেক পূজার এই সাজসজ্জা, আলোকসজ্জা দেখার জন্য পুণ্যার্থীরা পাগল থাকেন। দিনভর তারা তা দেখতে থাকেন। অনেক পূজায় পাঁচদিনই ‘প্রসাদ’ বিতরণ করা হয়। শত শত, হাজার হাজার, পুণ্যার্থী বিনামূল্যে এই ‘প্রসাদ’ পান।
অনেক পূজায় আয়োজকরা পাঁচদিন মণ্ডপে খাওয়া-দাওয়া করেন। বিদেশে আজকাল বাঙালি হিন্দুরা দুর্গাপূজা করেন। বাংলাদেশ ও ভারতের কলকাতা থেকে তারা উপকরণ সংগ্রহ করেন। এসবকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের বাণিজ্য হয়। খাওয়া-দাওয়ার জন্য বস্তুত বড় বাজেট থাকে। এতে গরিবরাও খাবার পান পাঁচদিন। আলোকসজ্জার লোকেরা, বাদ্যযন্ত্রের লোকেরা পাঁচদিন আনন্দ-স্ফূর্তিতে উপকরণের আয়োজন করেন।
পূজার আরেকটা দিক হচ্ছে সাংস্কৃতিক। যতই দিন যাচ্ছে, ততই দুর্গাপূজার সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রধান হয়ে উঠছে। ‘থিম’ পূজার (অর্থাৎ কোনো একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে) সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী/সাহিত্যিক/লেখকদের যোগাযোগ পূজাকে সর্বজনীন করে তোলে। ছেলেমেয়েরা গান-বাজনা, কবিতা পাঠ, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি করে পূজাকে অনাবিল আনন্দে ভরে দেয়। বড় বড় শিল্পীর সমাগম ঘটে বড় বড় পূজায়।
যাদের পূজার বাজেট প্রচুর, তারা শিল্পীদের সম্মানিও দেয়। বিদেশে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজায় দেশ থেকে কবি/সাহিত্যিক/ গায়ক-গায়িকারা আমন্ত্রিত হয়ে যান। এতে আনন্দের মাত্রা আরও বাড়ে। আজকাল ইউটিউবের সৌজন্যে এসব উপভোগ করা যায়।
লক্ষণীয়, দুর্গাপূজা একসময় ছিল বাঙালি হিন্দুদের প্রধান পূজা। হতো আশ্বিন-কার্তিক মাসে। এখন তা আর বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমিত নেই, বিভিন্ন নামে দেবীর আরাধনা করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ। এতে দুর্গাপূজা হয়ে উঠেছে সর্বভারতীয় পূজা। বাংলাদেশেও তা-ই। পূজার কি সামাজিক দিক নেই? অবশ্যই আছে। আছে বলেই মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং রাজনৈতিক নেতাসহ সবাই শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। শারদীয় শুভেচ্ছা।
শরতের বিদায় কাল। আসছে হেমন্ত ও শীতকাল। পূজার আমেজ কাটতে না কাটতেই আসছে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি। সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের মানুষ পালন করবেন এ দিনটি অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে। ঘটনাক্রমে এদিনই (রোববার) পড়েছে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লক্ষ্মীপূজা। মহাআনন্দের দিন। দুই সম্প্রদায়ই পালন করবে তাদের স্ব স্ব ধর্মীয় উৎসব। এখানে একটা কথা বলতে চাই।
আমরা কিন্তু দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে একটা ধর্মীয় পর্যটনশিল্প গড়ে তুলতে পারি। এ উপলক্ষ্যে আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ থেকে হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশে আসতে পারেন। শত হোক, তাদের অনেকেরই জন্মস্থান বাংলাদেশ। যতটুকু জানি, তারা আসতে চান, যেমন চাই আমরা।
উপযুক্ত পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করলে এ থেকে আমরা অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। ইলিশ মাছ বাংলাদেশ থেকে যায় পশ্চিমবঙ্গে। এমনও তো হতে পারে, তারা এখানে এসে দুর্গাপূজা দেখবেন এবং ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করবেন। উত্তর ভারতে বৌদ্ধদের জন্য গৌতম বুদ্ধের কর্মস্থলে ধর্মীয় পর্যটনের সূত্রপাত করে প্রতিবেশী দেশ প্রচুর লাভবান হচ্ছে। আমরাও কি লাভবান হতে পারি না?
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
