কিছুমিছু
আহা রে পরান তুই শীতল হ
মোকাম্মেল হোসেন
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কারবার দেখছুইন
মেয়র সাব মাডিত বইছুইন;
আহা রে পরান তুই শীতল হ
মেয়র সাবের গুণের কথা জনে জনে ক।
আলাতুনের মনে হলো, আকাশ থেকে একদল পরি তার ঘরে নেমে এসেছে। দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ-কষ্ট-বেদনায় মানুষ যেমন কাঁদে; তেমনই হঠাৎ কোনো প্রাপ্তির আনন্দও তাকে কাঁদায়। আলাতুনের চোখের চারপাশে এখন যে কান্না ভিড় করেছে, সেটি আনন্দের। সমস্যা হলো, আনন্দের কান্নাটা এ মুহূর্তে কাঁদা যাচ্ছে না। কান্নাকে সযতনে মোড়কবন্দি করার পর স্বামীকে ফোন করল আলাতুন-
: রুবিনার বাপ?
: হ।
: অহন আমি কী করবাম!
: কী অইছে?
: ঘরভর্তি মেমান।
: মেমান কেডা?
: রুবিনার বান্ধবীরা আইছে।
: ভালা অইছে; মেমানদারি করো।
: কী করবাম?
: আবার কয় কী করবাম! ঘরে কিছু না থাকলে লোকমানের দোকানে যাও। যা যা লাগে লইয়া আসো; রাইতে আইসা আমি টেকা দিয়া দিমু।
: আইচ্ছা। আফনে কই?
: আমি মেয়র সাবের লগে দেখা করবার আইছি।
মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেই দেখা করা যায় না। এর জন্য কিছু নিয়ম আছে; কিছু বিধিবিধান আছে। বিশাল দপ্তরের বারান্দায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর বজলু একজনের শরণাপন্ন হলো। ভদ্রলোক তাকে বারান্দার শেষ মাথায় অবস্থিত কক্ষে যাওয়ার নির্দেশনা দিলেন। সেখানে গিয়ে বজলু বুঝতে পারল, লোকটা তার সঙ্গে মশকরা করেছে; এটি আসলে টাট্টিখানা। জগতে ছত্রিশ রকমের মানুষ আছে। তাদের মধ্যে কেউ অপরের দুর্দশা লাঘবে সদা তৎপর থাকে; আবার কেউ অন্যকে দুর্দশায় ফেলার জন্য ওত পেতে থাকে। বজলুর পড়ালেখা ৫ শ্রেণি পর্যন্ত। বিদ্যালয়ে অর্জিত জ্ঞানের অধিকাংশই ভুলে গেছে সে। তবে পাঠ্যবইয়ের একটি কবিতা তার স্মৃতিতে অটুট ও অমলিন রয়েছে। কবিতার নাম উত্তম ও অধম। এটি লিখেছেন শেখ সাদী। অনুবাদ করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। বজলুর রিকশায় সওয়ার হওয়া কোনো আরোহী যদি তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, তাহলে অন্যদের মতো কলহে-বিবাদে লিপ্ত না হয়ে সে শৈশবে মুখস্থ করা কবিতার কোলে আশ্রয় নেয়। আজও তাই করল বজলু। বেসিনের সামনে থাকা আয়না জল ও ধুলাবালির প্রলেপে ধূসর রূপ লাভ করেছে। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দেওয়ার পর অস্পষ্ট প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বজলু মনে মনে উচ্চারণ করল-
: কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে
মানুষের শোভা পায়?
ঘাড়ে থাকা গামছা দিয়ে চোখ-মুখ মুছতে মুছতে বারান্দার মাঝখানে সুপরিসর একটা কক্ষের সামনে এসে দাঁড়াতেই বজলু শুনল-চলমান ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। আলোচনার এক পর্যায়ে একজন বললেন-
: আপনেরা যতই মেসি মেসি করেন; আমি কিন্তু আমরার মেয়র সাবের কারবার দেইখা ‘থান্ডার ক্যাট’ হইছি।
বিপরীত দিকে বসে থাকা একজন উৎসুক দৃষ্টিতে বক্তার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন-
: কুন বিষয়ে!
: অই যে টিভিতে খেলা দেখার জন্য উনি পোলাপানের সঙ্গে মাটিতে বইছুইন।
কেশেকুশে গলা পরিষ্কারের পর কক্ষের এক কোনায় বসে থাকা একজন বলে উঠলেন-
: আমরার মেয়র সাব কি মানুষের ঘাড়ে উইঠ্যা বওয়ার লোক? উনি হইলেন একজন মাটির মানুষ; তাই মাটিতেই বিছানা পাতছুইন।
এসময় পাশ থেকে আরেকজন তার মতামত রাখলেন। বিজ্ঞের মতো তিনি উচ্চারণ করলেন-
: আমরার মেয়ব সাব বড় মনের মানুষ, এইটা ঠিক আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, শুধু এই কারণে তিনি মাটিতে বসেন নাই; একটা উদ্দেশ্য লইয়াই মাটিতে বইছুইন।
এবার পাশ থেকে অন্য একজন কৌতূহলী হলেন। জানতে চাইলেন-
: কী উদ্দেশ্য?
পূর্ববর্তী বক্তা বললেন-
: তিনি পোলাপানের লগে মাটিতে বইসা বিশ্বকাপ খেলা দেখছুইন, যাতে ফুটবলের ব্যাপারে পোলাপানের মনে আগ্রহ জন্মে, যাতে তারা উজ্জীবিত হয়, অনুপ্রাণিত হয়। এই ঘটনার মাধ্যমে তিনি আসলে আমরার নেক্সট জেনারেশনের চোখে স্বপ্নের রেণু মাখাইয়া দিছেন।
: কিন্তু নেক্সট জেনারেশন তো বেদিশা।
: আফনের খালি পিড়িং কাটার অভ্যাস। বলেন, এই কথা কেন কইতেছেন?
: আমরার মেয়র সাব নেক্সট জেনারেশনের মধ্যে ফুটবলের স্বপ্নবীজ বুনতে চাইলেও রাজনীতির মঞ্চ থেইকা ‘খেলা হবে-খেলা হবে’ বইলা নতুন এক খেলার ধারণা দেওয়া হইতেছে; চুইংগাম না চিবাইয়া সেই খেলার মন্ত্রে সবাইরে দীক্ষা নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান হইতেছে। এই অবস্থায় নেক্সট জেনারেশন যাবে কোনদিকে, এইটা বলেন আমারে!
বজলু দেখল, এতসব আলোচনা আর হট্টগোলের মধ্যেও বয়স্ক এক ব্যক্তি আপন মনে চুপচাপ কাজ করে চলেছেন। তাকে দলে টানার জন্য পাশ থেকে একজন বলল-
: বড় সাব, আফনে কিছু কইন।
যাকে বড় সাব বলে সম্বোধন করা হলো, তার নাম আবদুর রশিদ। লোকটার কথা শুনে রশিদ সাহেব মুচকি হেসে আবার কাজে নিমগ্ন হলেন। তবে এতে ওই ব্যক্তি হাল ছাড়লেন না। নাছোড়বান্দার মতো রশিদ সাহেবের কাছে তিনি প্রশ্ন রাখলেন-
: বড় সাব, কইনছেন-আমরার দেশ কি কোনোদিন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলতে পারবে?
রশিদ সাহেব কিছু বলার আগেই পাশ থেকে একজন মুখ বাঁকিয়ে বললেন-
: আরে ধুর! ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষ থেইকা ঘোষণা দেওয়া হইছিল-বাংলাদেশ ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপে অংশ নিবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থার কন্ডিশন কী? যতসব ফজুইল্যা আলাপ-কীয়ের মধ্যে কী; পান্তার মধ্যে ঘি।
এবার রশিদ সাহেব মুখ খুললেন। সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বললেন-
: চুল-দাড়ি তো আর এমনি এমনি পাকে নাই; বয়সে পাকছে। বহুত কিছু দেখছি। বহুত কিছু শুনছি। নেতারা জাতিরে স্বপ্ন দেখাইবেন, এইটাই তো স্বাভাবিক। তবে এইখানে একটা কিন্তু আছে। আমরার ভাটি অঞ্চলে একটা কথা প্রচলিত আছে-
: স্বপনে খাইলাম আমি কত মাংস পোলাও ছানা;
স্বপন ভাঙলে দেখি মুখে পুইল্যা একখান ত্যানা।
কথাটার শানে নুজুল হইল-এক লোক রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে মাংস পোলাও ছানা খাইতে খাইতে পেট ফুলাইয়া ফেলছে; কিন্তু সকালবেলা ঘুম ভাঙার পরে সে দেখল-মাংস-পোলাও ছানা মনে কইরা ঘুমের মধ্যে যে ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে কামড়াকামড়ি করছিল, সেইটার এক টুকরা ত্যানা তার মুখে ঝুলতেছে। এই হইল কারবার। ভাই রে! স্বপ্ন দেখা দোষের কিছু না। তবে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়াইয়া হেন করেঙ্গা-তেন করেঙ্গা বইলা কেবল গলা ফাটাইলে কোনো লাভ হবে না।
আলোচনার এ পর্যায়ে হঠাৎ রশিদ সাহেবের চোখ পড়ল বজলুর দিকে। বজলুর আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ শেষে তিনি জানতে চাইলেন-
: এই, তুমি কী চাও?
বজলু কোনো কথা না বলে পকেট থেকে একটা পেপার কাটিং রশিদ সাহেবের হাতে তুলে দিল। রশিদ সাহেব কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরে দেখলেন-সেখানে এক মেয়ের ছবি শোভা পাচ্ছে। ছবিতে মেয়েটি ফুল হয়ে ফুটে আছে; যার চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ। ছবির নিচে লেখা রয়েছে-এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেল রিকশাচালক বাবার মেয়ে রুবিনা। রশিদ সাহেব প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে বজলুর দিকে তাকাতেই সে বলল-
: যে সাম্বাদিক এইটা ছাইপায়া দিছিলাইন, তিনি আমারে ফোন কইরা কইলেন-আপনের মেয়ের সংবাদটা মেয়র সাব পড়ছুইন। মেয়র সাব আপনের মেয়ের পড়ালেখার ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করবার চান। আপনে তার লগে দেখা করেন।
: রুবিনা তোমার মেয়ে?
: জে হ।
হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা আবেগ সংবরণের চেষ্টা না করে রশিদ সাহেব বলে উঠলেন-
: শাবাশ!
কক্ষে এখন পিনপতন নীরবতা। সবাই উৎসুক হয়ে একবার রশিদ সাহেব আরেকবার বজলুর দিকে তাকাচ্ছে। রশিদ সাহেব নীরবে কাগজের টুকরাটা পাশের সহকর্মীর হাতে তুলে দিলেন। এভাবে কাগজটা হাতবদল হয়ে সারা ঘর ঘুরে আবার রশিদ সাহেবের হাতে আসার পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন-
: পত্রপত্রিকায় এ ধরনের সংবাদ দেখলে মনটা জুড়াইয়া যায়। আজকাল প্রায়ই চোখে পড়ে-দিনমজুরের ছেলে নয়তো রিকশাচালকের মেয়ে অথবা কোনো প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ অর্জন করছে। আহা রে! ঘরে পড়ার পরিবেশ নাই, খাবার নাই, কোনো গৃহশিক্ষক নাই, কোচিং সেন্টার নাই-তারপরও দরিদ্র ঘরের এসব ছেলেমেয়ে সমাজে কী অনন্য উদাহরণই না তৈরি করতেছে। আর আমরার পোলাপানরে মাস্টারের ওপরে মাস্টার, কোচিং সেন্টারের ওপরে কোচিং সেন্টার দিয়া রাখছি; তারপরও কোনো কাম হইতেছে না।
পাশ থেকে একজন বলল-
: কাম হবে কেমনে? মোবাইল ফোন হাতে পাইয়া পোলাপান তো আজকাইল বইয়ের দিকে তাকাইতেই চায় না। পুরা মাথা নষ্ট।
পাশ থেকে আরেকজন বলল-
: খালি কি নষ্ট? পুরা আউলা লাগাইয়া দিছে। আমার বোনের ছেলেটারে দেখি-সে রাস্তা দিয়া হাঁটার সময়ও মোবাইল টিপতেছে, খাওনের সময়ও মোবাইল টিপতেছে, টয়লেটে যাইয়াও মোবাইল টিপতেছে, এমনকি ঘুমের মধ্যেও মোবাইল টিপতেছে। এত টিপাটিপির মধ্যে থাকলে পড়ালেখাটা হয় কেমনে!
রশিদ সাহেব কাগজটা ভাঁজ করে বুকপকেটে রাখলেন। তারপর বজলুর উদ্দেশে বললেন-
: মেয়র সাব তো আইজ অফিসে নাই। উনি শীতকালীন নাট্যোৎসবের উদ্বোধন করতে শিল্পকলা একাডেমিতে গেছেন। তুমি আইজ চইলা যাও। সামনের সপ্তাহে দুপুরের পরে কোনো এক টাইমে আসবা। আমি মেয়র সাবের সঙ্গে কথা বইলা ব্যবস্থা কইরা রাখব। আমরার মেয়র সাব খুবই গুণী মানুষ। তিনি তোমার মেয়ের উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করবাইন-এই ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকো।
: জে আইচ্ছা।
পরের সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে রশিদ সাহেব বজলুর জন্য অপেক্ষা করলেন। এরপর আরও দুদিন অপেক্ষায় থাকলেন। চতুর্থ দিনেও যখন বজলু এলো না, তখন তিনি বেশ অবাক হলেন। আজ বৃহস্পতিবার। সপ্তাহের পঞ্চম কর্মদিবস। এরপর শুক্র-শনি দুদিন বন্ধ। আজ কি বজলু আসবে? কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অফিস সময়ের পর কোনো কারণ ছাড়াই আরও কিছুক্ষণ বসে রইলেন রশিদ সাহেব। তারপর খারাপ হতে থাকা মন নিয়ে রাস্তায় পা রাখলেন। শেষ বিকালের রোদ মরতে শুরু করেছে। রশিদ সাহেব অনেকটা পথ হেঁটে রাস্তার পাশে একটা খালি রিকশা দাঁড়ানো দেখে সেটায় উঠে বসার পর গন্তব্যের কথা জানাতেই রিকশাওয়ালা তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। রশিদ সাহেব ভেতরের অস্থিরতার প্রকাশ ঘটিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বললেন-
: কী খবর তোমার! তুমি যে আসলা না?
রশিদ সাহেবের কথা শুনে বজলু গামছায় চোখ মুছল। তারপর ভেজা গলায় বলল-
: যাওয়ার আর প্রয়োজন পড়ে নাই বড় সাব।
: কেন? কী হইছে?
: আপনারার অফিস থেইকা আসার পরদিন মেয়েটা হঠাৎ কইরা জ্বরে পড়ল। দুইদিন পরও জ্বর কমতেছে না দেইখা হাসপাতালে লইয়া গেলাম। ডাক্তর সাবরা কইল-মশার কামড়ে যে জ্বর হয়, সেই জ্বরে ধরছে রুবিনারে। এরপর...
কথা শেষ না করে বজলু হাউমাউ করে কান্না শুরু করল। কান্নার একপর্যায়ে রশিদ সাহেব বজলুর কাঁধে হাত রাখতেই সে উদাস কণ্ঠে বলল-
: গতকাল বাদ আসর রুবিনারে কবর দিছি।
রশিদ সাহেব রিকশা থেকে নেমে পড়লেন। বজলুও নামল। তারপর যেন রাস্তার ওপর দিয়ে দুটি পাথর গড়িয়ে যাচ্ছে-এমনভাবে তারা হাঁটতে লাগলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা গেল-একদল মানুষ একটা ব্যানার নিয়ে মানববন্ধন করছে। ব্যানারে লেখা-ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ মেয়রের পদত্যাগ চাই। রশিদ সাহেব মনোযোগ সহকারে কয়েকবার ব্যানারের লেখাগুলো পড়লেন। তার চাকরির মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আগামী বছর এলপিআরে যাবেন তিনি। রশিদ সাহেব চাকরির মায়া করলেন না। বজলুর হাতটা শক্ত করে ধরে মানববন্ধনে যোগ দিলেন।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
mokamia@hotmail.com
