Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মানুষটা মানুষ, না গিনিপিগ?

Icon

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষটা মানুষ, না গিনিপিগ?

ছবি: সংগৃহীত

গিনিপিগদের কথা ভাবছি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনো গবেষণা সফল নাকি বিফল হতে চলেছে, তা প্রমাণ করার মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয় গিনিপিগদের। নিতান্তই ইঁদুরের মতো ছোট একটা অবহেলিত প্রাণী, মানুষের রঙের দুনিয়ায় কিইবা মূল্য আছে তার। অথচ মানুষের জীবনকে টেনে টেনে আরও কতটা বড় করা যায় তার মহান দায়িত্ব যেন বর্তেছে গিনিপিগদের ওপর। মানুষের চোখে গিনিপিগ তো গিনিপিগই; তার মতো তুচ্ছ একটা প্রাণীকে মানুষের জন্য জীবন-মরণের পরীক্ষায় বেছে নেওয়া হয়েছে, এর চেয়ে তার জীবনে আর কিইবা মূল্যবান হতে পারে!

মানুষের স্বার্থপর মন ডিগবাজি খেতে খেতে এমনটাই ভাবে, চশমার ভেতরে লুকিয়ে থাকা মানুষের স্বার্থপর চোখ তার নিজের জন্য যেটা ভালো তেমন করেই দেখতে ভালোবাসে। মানুষের চোখ যা দেখে, মানুষ তাকে মিথ্যে বানায়; মানুষের চোখ যা দেখে না, মানুষ তাকেই সত্য বানায়। মানুষের মন যেটা চিন্তা করে, সেটা বিশ্বাস করে না; মানুষের মন যেটা চিন্তা করে না, সেটাকেই বিশ্বাস করে। মানুষের এই অতি সুবিধাবাদী চরিত্র বড়ই অদ্ভুত। যেটা সুসময়ের দিকে ঝুলতে ঝুলতে যখন সেখানে দুঃসময়ের গন্ধ পায়, তখন আবার পথ বদলে নতুন আরেকটা সুসময়ের দিকে ঝুলতে ঝুলতে এগিয়ে যায়।

অথচ মানুষ গিনিপিগ নিয়ে এমন করে খেলতে খেলতে নিজেই যে কখন গিনিপিগ হয়ে যায় সেটা বোঝার মতো অনুভূতি মানুষের মধ্যে থাকে না। মানুষের ভেতরে ভেতরে একটা অতীব আত্মতৃপ্তির থিওরি কাজ করে, যেখানে মানুষ মনে করে তাকে নিয়ে কেউ খেলার যোগ্যতা রাখে না; বরং অন্য মানুষদের নিয়ে সে নিজে খেলার যোগ্যতা রাখে। এটা সেই মানুষটার একটা ভ্রান্ত ধারণা, মানুষ নিজেকে যতটাই বড় ভাবতে থাকে, সে ততটাই ছোট হতে থাকে।

বড় বড় খেলার খেলোয়াড়রা কখনো দৃশ্যমান হয় না; বরং ছোট ছোট খেলার খেলোয়াড়রা সব সময় দৃশ্যমান থাকে। তবে এর গভীরতম দর্শনগত দিকটি হচ্ছে, সব মানুষই কোনো না কোনোভাবে একে অন্যের খেলার পুতুলের মতো। সারা পৃথিবীতে এখন তাই গিনিপিগদের গিনিপিগ বলাটা যতটাই কঠিন, মানুষকে গিনিপিগ বলাটা ততটাই সহজ।

অর্থনীতির জটিল জটিল কুটিল তত্ত্ব ছোট ছোট মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে বড় বড় মানুষদের খাদ্যে পরিণত করে। বড় বড় মানুষদের পেট ছোট ছোট মানুষদের গিলতে গিলতে শরীর থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসে একেকটা স্ফীত ভুঁড়ির জন্ম দেয়। সেই স্ফীত ভুঁড়ি এতটাই লোভী হয়ে ওঠে যে, তার মধ্যে কোনো ধরনের ক্ষুধার প্রবৃত্তি না থাকলেও তার খাদ্য গ্রহণের মুখটা বন্ধ হয়ে যায় না; বরং ক্রমাগত বাড়তে থাকে।

বৈষম্যের ধারণা এখান থেকেই সৃষ্টি হয়, যেটা শোষক ও শোষিতের জন্ম দেয়। শুধু অর্থনীতি নয়, সব নীতিতেই মানুষ এখন মানুষ থেকে গিনিপিগে রূপান্তরিত হচ্ছে, চেনাটা খুব কঠিন-মানুষটা মানুষ, না মানুষটা গিনিপিগ!

গ্রামের মেঠোপথ মাড়িয়ে যতই শহরের পিচঢালা রাস্তায় চোখ পড়ছে, ততই মানুষদের সংখ্যা কমতে কমতে গিনিপিগদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়ার সতর্কবার্তা মিলছে। খামবন্দি বার্তাটা খুলে দেখতে পারছি না, কারণ চিঠি ও খাম দুটোই এখন প্রাচীন ও অপ্রচলিত।

২.

পৃথিবীতে কিছু জিনিস আছে যা আমাদের কিনতে হয় না, অথচ সেগুলোর মূল্য কেনা জিনিসের চেয়ে অনেক বেশি।

মনে পড়ছে মেঘ ভেঙে নেমে পড়া বৃষ্টির কথা। বৃষ্টি দেখার মধ্যে যেমন একটা সুখ আছে, বৃষ্টিতে ভেজার মধ্যেও অন্যরকম একটা অনুভূতি আছে। বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন বৃষ্টিতে ভেজার তেমন একটা আবেগের কথা আমাদের বলেছেন। খুব অদ্ভুত সেই আবেগ, যেটা আমাদের বোঝায় জীবন শুধু যন্ত্রণার জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া বিজ্ঞান নয়, জীবন একটা আর্ট বা শিল্পও। তিনি বলতেন, ‘আমি বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালোবাসি, কারণ তখন কেউ আমার কান্না দেখতে পায় না।’ কী বিস্ময়কর জীবনের শিল্পবোধ, যেটা সৃজনশীলতাকে ভর করে কোনো সৃষ্টির উৎসবে মেতে ওঠে না; বরং নিজের চেনার ভেতর দিয়ে বাস্তবতাগুলোকে আলিঙ্গন করে খুব সন্তর্পণে।

মানুষ যতই বড় হয়, ততই তাকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। ছোটবেলায় মানুষ চোখের পানিতে চিৎকার করে কাঁদতে পারে, কিন্তু সময়কে পেছনে ফেলে যখন মানুষের বড়বেলা আসে, তখন চোখের পানি বরফ হয়ে যায়। সমাজ মানুষকে চোখের পানিতে কাঁদতে দেখে রক্ষণশীল হয়ে ওঠে, তখন কান্নাগুলো বোবা হয়ে যায়। বৃষ্টি তেমনই একটা মহা মূল্যবান জিনিস, যেটা সমাজের চোখ এড়িয়ে চোখের পানিতে মানুষকে প্রাণখুলে কাঁদতে দেয়। কারণ বৃষ্টির পানি তখন চোখের পানিকে লুকিয়ে রাখে।

আমি কাঁদছি না, আমার কোনো কষ্ট নেই, আমি কোনো আঘাতও পাইনি তারপরও চোখ গড়িয়ে দুফোঁটা পানি তখন মাটিতে। না, আমি কাঁদিনি, চোখে একটা পোকা ঢুকেছিল হয়তো বা, অবাধ্য হাতটা তখন তাই লোকচক্ষু এড়িয়ে পানি মোছার ব্যর্থ চেষ্টায় রত। সবার চোখে আমি হয়তো মানুষ নই, একটা যন্ত্র। যন্ত্রদের কাঁদতে নেই।

৩.

জীবনটা সহজ-সরল অঙ্ক নয়। জীবনের সমীকরণটা মেলানো খুব কঠিন। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। সবকিছু অনিশ্চিত, গন্তব্যহীন। যেখানে পলে পলে বদলে যায় সময়, বদলায় মানুষ। একটা ঘটনা মনে পড়ল। বিখ্যাত নর্তকি ইসাডোরা ডানকান একবার জর্জ বার্নার্ডশ’কে লিখলেন, ‘ভাবুন তো, আপনি আর আমি যদি একটা শিশুর জন্ম দিই, ব্যাপারটা কী চমৎকারই না হবে! সে পাবে আমার রূপ, আর আপনার মতো মেধা।’ বার্নাডশ’ জবাবে লিখলেন, ‘যদি আমার রূপ আর আপনার মতো মেধা পায়, তাহলে?’

পৃথিবীর সবকিছু এমনটাই। একজনের চিন্তা আরেকজনের চিন্তা থেকে ভিন্ন। একজনের কষ্ট আরেকজনের কষ্ট থেকে ভিন্ন। একজনের ব্যক্তিত্ব আরেকজন থেকে ভিন্ন। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ একটা ঘটনাকে সাধারণভাবেই নেয়। কিছু মানুষ ঘটনার গভীরে ঢোকার চেষ্টা করে, তবে তার কূল কিনারা পায় না। খুব অল্পসংখ্যক মানুষ আছে, যারা ঘটনার পেছনের ঘটনা, তার পেছনের ঘটনা বের করতে গবেষণা করে। খেলার পেছনে খেলা, তার পেছনের খেলা বের করে আনে। পেছন থেকে যারা কলকাঠি নাড়ে, তাদের হয়তো চিনতে পারে। কিন্তু চেনা মুখ অচেনা মুখোশ কখনো প্রকাশ করতে পারে না। কারণ চাঁদেরও যে কলংক আছে। আবার মানুষ ভালোকে মন্দ আর মন্দকে ভালো বানাতে সময় নেয় না। যেমন সত্য-মিথ্যা নিয়েও মানুষ সারা জীবন খেলে যায়।

বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’ প্রসঙ্গে কোনো এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘যে তরুণ বা তরুণী অল্প বয়সে এই উপন্যাস পড়ে লজ্জা অনুভব করতেন, তিনিই এখন পরিণত বয়সে এর ভেতরে খুঁজে পান মানবজীবনের গভীর দার্শনিকতা, অস্তিত্বের রহস্যময়তা ও কালস্রোতে কুটোর মতো ভেসে যাওয়া বেদনাহত জীবন।’ হয়তো সময় মানুষকে বুঝতে শেখায়। সূর্যের কঠিন রোদে পুড়ে মানুষ কল্পনাকে বিদায় জানায়। বাস্তবতার নর্দমায় মুখ থুবড়ে পড়ে।

মানুষ নিজেকে কাচের ভাঙা আয়নায় দেখে চমকে ওঠে। চেনা-অচেনার হাত ধরে উলটোপথে হাঁটতে থাকে। যদি কখনো দেখা মেলে নিজের অস্তিত্বের, আঁকড়ে ধরা খড়কুটো। কারণ জীবন তো থেমে থাকে না। একটার পর একটা মানুষ জন্ম নেয়। একেকজন মানুষের জীবন একেকটা উপন্যাস হয়, ইতিহাস হয়। বইয়ের কালো অক্ষরে তা বাঁধা যায় না। সময়ের ঘড়িতে আটকানো যায় না। কিন্তু কোনো একটা অজানা ঠিকানায় গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। যে ঠিকানা জানে শুধু যে মানুষটা থমকে দাঁড়ায় সে; আর কেউ জানে না।

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

 

গিনিপিগ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম