Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আস্থা-অনাস্থার অর্থনৈতিক যাত্রা

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আস্থা-অনাস্থার অর্থনৈতিক যাত্রা

বাংলাদেশের অর্থনীতি নতুন বছরে কেমন হবে, তা নিয়ে ১ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে যুগান্তর।

এ সাক্ষাৎকারে যুগান্তরের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কেমন কাটবে এ বছরের অর্থনীতি, বড় ধরনের কোনো শঙ্কা আছে কিনা, মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে, প্রবৃদ্ধি ও রিজার্ভ নিয়ে সরকারের ভাবনা কী, আইএমএফের ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার অগ্রগতি কতদূর এবং ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূরীকরণে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কিনা।

অর্থমন্ত্রী প্রশ্নগুলোর যে জবাব দিয়েছেন তার সারমর্ম দাঁড়ায়, বিশ্বে যে অবস্থা বিরাজ করছে, আমরা এর বাইরে যেতে পারব না। অন্য দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের অর্থনীতি। ফলে শুধু আমাদের দেশ নয়, বিশ্বের সব দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এখন ভাবতে হয়। তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই আতঙ্কে আছে, কারণ আগামী দিনে আরও কোনো ভয়াবহ পরিস্থিতি আসে কিনা।

আমরা বলেছি, জানুয়ারিতে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে। এখনো দেশের অর্থনীতি বিপদমুক্ত ও স্থিতিশীল। এ স্থিতিশীলতার হাত ধরে নতুন বছরে এগিয়ে যাব। মোটামুটি এই ছিল অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য। বরাবরের মতোই আমাদের আশ্বস্ত করার স্বভাবসুলভ প্রয়াস।

আমাদের শাসকগোষ্ঠী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটগুলোর সঙ্গে বৈশ্বিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে থাকে; কিন্তু তা আংশিক ও পক্ষপাতদুষ্ট। যেমন, আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির কারণ হিসাবে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে নিজেকে নিরপরাধ কিংবা নিরুপায় হিসাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। বিশ্ববাজারের প্রভাবটি অমূলক নয়। তবে লক্ষণীয়, যে উদাহরণটি দেওয়া হয় না তা হলো, অর্থনৈতিক সংকটের দায় স্বীকার করে পদ থেকে সরে দাঁড়ানো। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হলো সাম্প্রতিক সময়ের ব্রিটেন।

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়ায় সেখানে তিন মাসের মধ্যে তিনজন প্রধানমন্ত্রীর মুখ দেখা গেছে। প্রথমে বরিস জনসন পদত্যাগ করলেন; ৪৫ দিন ক্ষমতায় থাকার পর লিজ ট্রাস আত্মসম্মান রক্ষার্থে পদত্যাগ করলেন। এরপর এ পদে অধিষ্ঠিত হলেন ঋষি সুনাক।

আমরা কিন্তু অনেক বড় সমস্যা-সংকটেও পদত্যাগের সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী নই। আমাদের শাসকরা তাদের অবস্থান থেকে বয়ান-বর্ণনা দেন, আর আমরা বঞ্চিতরা আমাদের অবস্থান থেকে তার মূল্যায়ন করি।

নতুন বছরের অর্থনীতি কেমন হবে? এ প্রশ্নকে আরও বেশি স্পষ্ট করা প্রয়োজন : এক. দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে নতুন বছরটি কেমন হবে; দুই. গেল ২০২২ সালের তুলনায় সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা ২০২৩ সালে কেমন হতে পারে। প্রথমটির উত্তর হলো, সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা, সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন নির্ভর করে রাজনৈতিক কমিটমেন্টের ওপর এবং তা একদিনে বা এক বছরে সাধনযোগ্য নয়। প্রয়োজন শাসন কাঠামোর পরিবর্তন।

দীর্ঘ ৫০ বছরেও আমরা সেই কাঠামো তৈরি করতে পারিনি। তাই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হলেও বণ্টনজনিত বৈষম্যের কারণে উন্নয়নের সুফল সার্বিক জনগোষ্ঠী ভোগ করতে পারেনি। উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করেছে এবং করছে একটি ক্ষুদ্র শ্রেণি। মাত্র দুজন কোটিপতি দিয়ে যাত্রা শুরু করা স্বাধীন বাংলাদেশে এখন কোটিপতির সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, বৃদ্ধি পেয়েছে পুঁজির কেন্দ্রিকতা আর আয়-বৈষম্য। আর বর্তমানে রাজনীতির যে ধারা, তাতে করে গরিবের ভাগ্য খুব সহসা সুপ্রসন্ন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দ্বিতীয় প্রশ্নটিই সাধারণত বছর শেষে কিংবা নতুন বছরের শুরুতে আলোচিত হয়। আমরাও সেদিকটাতেই আলোকপাত করতে চাই।

২০২২ সালে মূল্যস্ফীতির প্রচণ্ড চাপের মধ্যে অতিবাহিত করেছে বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে অসহনীয়ভাবে। দুটি কারণে এমনটি হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাজার মনিটরিংয়ের কাজটি করা যায়নি। ফলে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী মানুষের এ অসহায়ত্বের সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে। অন্য কারণটি হলো আন্তর্জাতিকভাবে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে; এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন। তাই বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি আক্রমণ করেছে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন বছরে এর প্রকোপ কিছুটা হ্রাস পাবে। কারণ, এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমতে শুরু করেছে। আশা করা যাচ্ছে, জ্বালানি তেল ও অন্যান্য পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে আগামীতে আরও কমবে। তাছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক দিকটিও গেল বছরের মতো প্রতিফলিত হবে না। কারণ হিসাবে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বলছেন, ওই যুদ্ধের প্রাথমিক ধকলটি সামলানোর অভিজ্ঞতা এ বছর কাজে লাগাতে পারলে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব কমে আসবে।

নতুন বছরের কৃষির অবস্থা বলতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, ‘বিশ্ব খাদ্য সংকট যাই থাক না কেন, আমাদের দেশে খাদ্য সংকট তীব্র হবে না। কৃষি খাতে সরকার যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়ার ফলে এ সক্ষমতা আমাদের তৈরি হয়েছে। আমনের ভালো উৎপাদন হয়েছে। বোরোতেও যেন তেমনটি হয়, সেজন্য জ্বালানি, সার ও কৃষিঋণের প্রতি সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুরুত্ব দিচ্ছে। এ নীতি সমর্থন অব্যাহত থাকলে বোরো উৎপাদনও ভালো হবে। তবে হাওড় অঞ্চলে বাঁধ মেরামত ও সম্প্রসারণে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে।’ তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, কৃষির ভালো অবস্থা কিংবা ভালো ফলন মানেই কৃষিমজুরের ভালো অবস্থা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইরি) যৌথ এক গবেষণা প্রতিবেদনে কৃষিমজুরদের ক্রয়ক্ষতা কমে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে। ক্রয়ক্ষমতা পরিমাপক হিসাবে চাল ক্রয়ের সক্ষমতাকে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালের পর থেকে গত চার বছরে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কৃষিশ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা ৩৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমে গেছে। ২০১৫ সাল থেকে কৃষিমজুরের ক্রয়ক্ষমতা বাড়তে থাকে এবং ২০১৯ সালে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর থেকে ক্রয়ক্ষমতা কমতে কমতে বর্তমানে ২০১৫ সালেরও নিচে নেমে গেছে। ২০১৫ সালে একজন শ্রমিক তার দৈনিক শ্রমলব্ধ মজুরি দিয়ে ১০ দশমিক ১ কেজি চাল কিনতে পারতেন। ২০১৬ সালে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং দৈনিক মজুরি দিয়ে তা ১০ দশমিক ৬ কেজিতে উন্নীত হয়। এভাবেই ২০১৯ সালে তা সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৪ কেজিতে দাঁড়ায়। এর পরের বছর থেকেই কমতে থাকে কৃষিশ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা। ২০২০ সালে একজন কৃষিশ্রমিক দৈনিক মজুরি দিয়ে চাল কিনতে পারতেন ৯ দশমিক ১ কেজি; ২০২১ সালে তা নেমে আসে ৮ দশমিক ৬ কেজিতে আর ২০২২ সালে তা ৮ দশমিক ৫ কেজিতে নেমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে খানাপ্রতি বার্ষিক ব্যয়ের প্রায় ৩৪ শতাংশ যায় খাদ্যের পেছনে। এ খাদ্যব্যয়ের ৪১ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় চাল কেনা বাবদ। গত তিন বছরে দেশে চালের দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ, যা গোটা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। তাই চালের দাম বৃদ্ধি নিুআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে। সুতরাং যাদের জন্য কৃষি খাত সক্ষমতা অর্জন করেছে, তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করাও সরকারের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

গেল বছরের চেয়ে এ বছরের অর্থনীতি খানিকটা ভালো হওয়ার পেছনে যুক্তি আছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও বঙ্গবন্ধু টানেল দৃশ্যমান হয়েছে। প্রাক্কলন অনুযায়ী শুধু পদ্মা সেতুর কারণেই জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ হবে। আর উল্লেখিত তিনটি প্রকল্প মিলে জিডিপিতে অতিরিক্ত প্রায় ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হতে পারে। তবে এ প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ কতটা ভোগ করবে, সে প্রশ্ন তো থেকেই যায়।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ নিয়েই ২০২২ সাল শেষ হয়েছে। গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ১ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ কমে গেছে। গত এক দশকে এটাই ছিল অর্থনীতির ওপর সবচেয়ে বড় চাপ। সেই আশঙ্কা এখনো কাটাতে পারছি না আমরা। যদিও অর্থমন্ত্রী আশ্বস্ত করে বলেছেন, রিজার্ভ এখন ৩৪ বিলিয়ন ডলার। উন্নয়ন সহযোগীদের হিসাবমতে, কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ থাকতে হয়। এ কথায় আশ্বস্ত হতে পারলে ভালো লাগত, কিন্তু তা হতে পারছি না। রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব উল্লেখিত অঙ্কের চেয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কম হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তাছাড়া আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ তো এক বছর আগেও ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনও আমাদের উদ্বেগকে সমর্থন করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩ হাজার ২৫৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানি করা হয়েছে ২ হাজার ৭৪ কোটি ডলার। তার মানে হলো, ১ হাজার ১৭৯ কোটি বা ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। এক ডলার সমান ১০২ টাকা হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। যদি ২০২৩ সালে রেমিট্যান্সের প্রবাহ আশানুরূপ হারে বৃদ্ধি না পায়, তাহলে বছর শেষে রিজার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে সন্দেহ নেই। সুতরাং, ২০২২ সালের অর্থনৈতিক চাপকে সঙ্গী করেই আমরা ২০২৩ সালে যাত্রা করেছি।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

দুর্নীতি অব্যবস্থা দূর

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম