লেখকের মৃত্যু হয়, বেঁচে থাকে লেখা
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাস্তবতা খুব কঠিন হয়। মানুষকে অসহায় করে নিজের চোখের সামনে নিজের বিবেককে পুড়তে দেখে মানুষ। কিন্তু করার তো কিছুই থাকে না। একদিন যত পথ তৈরি করেছিল সে, তা ক্রমাগত সংকুচিত হতে হতে মানুষকে পাথর বানিয়ে দেয়। আত্মসমর্পণ করে মানুষ তার অসহায়ত্বের কাছে। চোখ যত কাঁদে, মন তার থেকে অনেক বেশি কাঁদে। চোখের কান্নায় পানি থাকে, মনের কান্নায় আগুন। পরিস্থিতি মানুষকে কোনদিকে টেনে নিয়ে যাবে তা কেউ জানে না। অনিশ্চয়তা প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনের সঙ্গে ছায়ার মতো চলছে অথচ অনুকূল অবস্থার সঙ্গে থাকতে থাকতে মানুষ ভুলে যায় অনিশ্চয়তাকেই।
মানুষ বইপত্র, গবেষণা, পরীক্ষার খাতায় অনিশ্চয়তার তত্ত্বকে সীমাবদ্ধ রেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চায়, সেটির বাস্তব ফলাফলকে কখনো তার জীবনের সঙ্গে যাচাই করার মতো সাহস দেখাতে পারে না। অদ্ভুত বিষয় হলো, নিশ্চয়তা একটা নাটকের গল্পের মতো, অনিশ্চয়তা সেই গল্পের অসমাপ্ত উপসংহারের মতো। আমেরিকান লেখক ফ্রেডরিক ব্রাউন ‘নক’ নামে একটা ফ্ল্যাশ ফিকশন লিখেছিলেন। খুব ছোট একটা গল্প, ছোটর চেয়েও ছোট। অনেকটা আধুনিক গবেষণার ন্যানো-পার্টিকেলের মতো। গল্পটা এমনই যার সূত্রপাত হয়তো আছে, টান টান উত্তেজনা আছে, শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো শিহরণ আছে, সমাপ্তি নেই। যার সমাপ্তি থাকে না, তা নিয়ে মানুষের ভেতরে এক ধরনের রোমাঞ্চ থাকে, সে রোমাঞ্চ থেকে রহস্যের জন্ম হয়। যেখানে রহস্য থাকে সেখানে চিন্তার বৈচিত্র্য থাকে। তারপরও ফ্রেডরিক ব্রাউনের শেষটা কেমন হতো তা মিলিয়ে নিতে না পারার এক ধরনের অনিশ্চয়তাও মানুষের মধ্যে থাকে। একটা অতৃপ্তি মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায় যেমন মানুষ তাড়িয়ে বেড়ায় গল্পের শেষটা নিয়ে তার নিজের চিন্তাকে। চিন্তাও তাহলে দৌড়ায়, যেমন পৃথিবীটা সূর্যের চারদিকে দৌড়ায়।
ফ্রেডরিক ব্রাউনের ক্ষুদ্রতম গল্পটি হলো এমন-'The last man on Earth sat alone in a room. There was a knock on the door', যার বাংলা অনুবাদ হচ্ছে-পৃথিবীর সর্বশেষ মানুষটি একাকী একটা রুমে বসে আছেন। হঠাৎ কে যেন তার দরজায় নক করল। অনেকভাবে গল্পটিকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যে কারণে জীবনের পরীক্ষায় কখনো কখনো মানুষ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকগুলো জানালা খুলতে পারে। মানুষ জীবনের পরীক্ষায় লড়তে গিয়ে অনেক দুর্বোধ্য আবেগকে হাতুড়ি বানিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে। জীবনের পরীক্ষা যেখানে মানুষকে থামিয়ে দেয়, কঠিন ধাক্কা দিয়ে দাবিয়ে দেয়, সেখান থেকে জেগে ওঠার অমিত শক্তিটা মানুষকে অনেকটা পথ ধরে টেনে এগিয়ে নিয়ে যায়। পরীক্ষার খাতার মতো জীবনের খাতায় কল্পনা দিয়ে গল্পটা মানুষকে তার মতো করে লিখতে শেখায়।
যদি গল্পটা এমন হয় : সারা পৃথিবী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মৃত্যুপুরীর মধ্যে বেঁচে আছে মাত্র একজন। দুঃসহ শূন্যতার দহন জ্বালা বুকে নিয়ে একটা অন্ধকার ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে আছে সে। সে পুরুষ বা নারী যে কেউ হতে পারে। পৃথিবী কি তবে থেমে যাবে? জীবনের পরীক্ষাগুলো তবে কি আর কারও দেওয়া হবে না? এমন একটা সময়ে দরজায় একটা ঠকঠক আওয়াজ, পিনপতন নীরবতার অচলায়তন ভেঙে হতচকিত চোখ। ঘরের ভেতরে চোখ বন্ধ করে বসে আছে যে, হয়তো তার বিপরীত লিঙ্গের কেউ হবে। কেউ তারা কাউকে চেনে-জানে না। তবে জীবনের পরীক্ষা তাদের খুব কাছাকাছি টেনে আনে। যাদের সম্পর্কের বন্ধনে জন্ম নেবে মানুষ। মানুষের পর মানুষ। মানুষের ভেতরে মানুষ। পৃথিবী মরে যাওয়া জনপদের জীবনের পরীক্ষায় সফল হয়ে আবার গড়ে তুলবে সভ্যতা। সভ্যতার পর সভ্যতা। সভ্যতার ভেতরে সভ্যতা।
হঠাৎ হাতের কলমটা থেমে গেল, কলমের কালিটাও শেষ হয়ে গেল, কাগজগুলো সব নাই হয়ে গেল। তারপরও মানুষ লিখছে, কারণ লেখা কখনো বন্ধ করা যায় না। লেখকের মৃত্যু হয়, লেখার মৃত্যু হয় না।
২.
ফেসবুকে একটা লেখা পেলাম ‘তুমি ভাবছ তোমার দুঃখী মুখটা দেখে কেউ খুব কষ্ট পাবে? তোমার আর্তনাদে কারও বুকটা ভারী হয়ে উঠবে? না রে বোকা! এ পৃথিবীর মানুষের সময় নেই তোমার দুঃখ দেখে নিজের বুকটা ভারী করার। এ পৃথিবীতে কেউ কারও দুঃখের বোঝা নিয়ে নিজের বুকটা ভারী করতে চায় না। নিজের দুঃখের বোঝাটুকু কেবল নিজেকেই বহন করে যেতে হয়।’
কথাগুলো খুব সত্য। কারও দুঃখকে পুঁজি করে হয়তো তাকে বোকা ভাবতে ভাবতে একটা নির্দয় আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। আবার কখনো কখনো তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে দেখানোর চেষ্টা করে যে তাদের চেয়ে এত পরম হিতৈষী পৃথিবীতে আর কেউ নেই। সবটাই তাদের কাছে একটা খেলা, একটা স্বার্থের রাজনীতি। সময় যত যাচ্ছে, মানুষ তত কমছে, অভিনেতা তত বাড়ছে। এখন মানুষের চেয়ে অভিনেতার সংখ্যা অনেক বেশি। মানুষ এখন মানুষের আবেগ নিয়ে খেলে, দুঃখ নিয়ে খেলে, ভালোবাসা নিয়ে খেলে, বিশ্বাস নিয়ে খেলে। খেলা শেষ হলে অসহায় মানুষটাকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে। মানুষ নিজে নায়ক সেজে অসহায় মানুষটাকে জোকার বানায়। তারপর তাকে একটা সার্কাসের খেলা বানিয়ে ভেতরে ভেতরে হাসে। অথচ তাদের বাইরের বিশ্বাসঘাতক চোখ দিয়ে কান্নার অভিনয় করে।
খুব স্বার্থপর এ পৃথিবী। বাণিজ্যিক পৃথিবীর মানুষ ইট-পাথরের মূল্য বোঝে, মানুষের ভেতরের আর্তনাদ, কষ্ট, দহন, জ্বালা বোঝে না, মানুষ কাগজের টাকার মূল্য বোঝে, মানুষের ভেতরের প্রতিদিন অভাবের বিরুদ্ধে লড়াইকে বোঝে না, মানুষ নিজেরটাই বেশি বোঝে, অন্যেরটা তার কাছে মূল্যহীন।
অর্থনীতি নিমিষেই ভোগনীতি হয়ে যায়। যেখানে অসহায় মানুষদের সবটাই কেড়ে নিয়ে আবার তাদের স্বপ্ন সাজানোর গল্প লেখা হয়। মানুষ কাঁদে, সে কান্না ট্র্যাজেডি হয়ে কারও কারও কাছে সিনেমার প্লট হয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সে সিনেমা নিয়ে মাতামাতি হয়। অথচ অসহায় মানুষটার জীবনের কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
আপনি ততক্ষণ মানুষের প্রিয়জন, যতক্ষণ আপনাকে কারও না কারও প্রয়োজন। তারপর আপনার স্থান ডাস্টবিনে। কারণ মানুষের আরও প্রয়োজন আছে, যেগুলো মেটানোর জন্য আরও নতুন নতুন প্রিয়জন দরকার। আপনাকে প্রিয়জনের জায়গায় রেখে শুধু শুধু কেউ জায়গা নষ্ট করতে চাইবে না। ঠিক কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের মতো, হার্ডডিস্ক পূর্ণ হয়ে গেলে যেমন মানুষ অপ্রয়োজনীয় ফাইল মুছে ফেলে, তেমনি আপনিও মুছে যাবেন সবার মনের হার্ডডিস্ক থেকে, যখন তাদের প্রয়োজন শেষ হবে।
সব যেন এখন লোকদেখানো, ছেলেভোলানো ছলাকলার মতো, সেখানে জীবন নেই, মানুষ নেই, মানুষের অনুভূতি নেই। যন্ত্র আছে, যন্ত্রের কাল্পনিক যন্ত্রণা আছে। যন্ত্ররা কি আর মানুষকে ভালোবাসতে পারার মতো কখনো যোগ্য হয়ে উঠতে পারে! সবটাই প্রশ্ন, সবটাই বিস্ময়, অনেকটা লেজবিহীন টিকটিকির শরীর বেয়ে দেওয়ালে ওঠার মতো।
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
