Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চেতনায় বুদ্বুদ

ঢাকার ভূষণ, কেবল দূষণ আর দূষণ!

Icon

বদিউর রহমান

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকার ভূষণ, কেবল দূষণ আর দূষণ!

একবার আমরা পরপর দুর্নীতিতে বারপাঁচেক বিশ্বে প্রথম হয়েছিলাম, মনে পড়ে। দুর্নীতিতে প্রথম হওয়ার রেকর্ডের অধিকারী এক দলের শাসনামল তুলনামূলকভাবে বেশি, তবে অপর দলও বাদ যায়নি। এবার বায়ুদূষণে ঢাকা যে পরপর শীর্ষে এসে গেল, তা-ও আমাদের বোধকরি এক অনন্য গৌরবই। প্রথম হওয়ার স্বাদই আলাদা, তা ভালোর জন্যই হোক, কিংবা মন্দের জন্য, তা বিখ্যাতই হোক অথবা কুখ্যাত। আমরা ছোট থাকতে শুনতাম-এক নাম নাটার, আরেক নাম পাঁঠার। ছোট্ট একটা দেশ, বয়সই বা আর কত হয়েছে, মাত্র ৫০ পেরোলো। এর মধ্যে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটেছে, মধ্য-আয়ের দেশে যাচ্ছি, উন্নত দেশের স্বপ্নের সীমানা প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু পরিবেশ-প্রতিবেশে আবার যেন তলাবিহীন ঝুড়িতে পড়ে যাচ্ছি। তাহলে মোটের ওপরে লাভটা কী হচ্ছে? একদিকে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় উন্নয়নের ঝলকানিতে এগিয়ে যাচ্ছি, অপরদিকে অতিষ্ঠ এক জীবনের মধ্যে কেবল হাবুডুবু খাচ্ছি। তুলনামূলকভাবে মাপতে গেলে শেষাবধি লাভ-ক্ষতির হিসাবে দিন শেষে কী পেলাম? একটু আয় বেশি হলো, বাহ্যিক চাকচিক্য একটু চোখে পড়ার মতো হলো, রাস্তাঘাট-সেতু-কালভার্টে বেশ এগোলাম, কিন্তু রাস্তায় বেরোলে দম নিতে পারলাম না, নাক বন্ধ করে চলতে হলো-অবস্থাটা কেমন দাঁড়াল? কোথায় হারিয়ে গেল আমার নির্মল বায়ু, চারদিকে কেবল ধুলা আর ধুলা। গাড়ির ধোঁয়ায় দম বন্ধ করা অবস্থা। শুধু ইটভাটার দোষ দিলে কি হয়? আমরা কী চাই, তা-ই হয়তো স্থির করতে পারছি না। ঢাকায় নিশ্বাস নিলেও বিপদ, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকার অধিবাসীদের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে সাত থেকে আট বছর (প্রথম আলো, ২৯ জানুয়ারি)।

বায়ুদূষণ তো গেল, নাক বন্ধ করে, মুখ ঢেকে না হয় চললাম। উপায় নেই, চলতে তো হবেই, জীবন তো আর থেমে থাকবে না। করোনার জন্য নাক-মুখ ঢাকার অভ্যাস কাজে লাগছে। তারপরও ঢাকায় থাকব, বায়ুদূষণ মানব না, তা তো হতে পারে না। এটা না হয় মানলাম, কিন্তু পানির কী দশা? ওয়াসার পানি নিয়ে একাধারে এমডি থাকা তাকসিনকে একটা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার না দিলে তার প্রতি সম্মান দেখানো অপূর্ণ থেকে যেতে পারে। তাকসিন ছাড়া ওয়াসা যে অচল, আমার ভয় হয়, তিনি না থাকলে ওয়াসা কি ওয়াসার জলেই ভেসে যাবে? দুর্গন্ধ, ময়লা, আরও কত কত ময়লা থাকে এ পানিতে। এসব নাকি ওয়াসার পানির নিজস্বত্ব। ভূগর্ভস্থ পানি তো আর নিজে নিজে এসবের পয়দা করে না, এসব নাকি উঠতে উঠতে এসে যায়। ড্রেনের লাইনের নালি কিংবা ফুটো দিয়ে মিশে এমন হয়। হতে হবে, না হলে দূষণ হবে কীভাবে? এবার টের পেলাম আরেক গুণ-পানিতে বালতি ভিন্ন রঙে রঙিন হয়ে গেল। কী যে পাকা দাগ হয়ে যায়, ঘষে ওঠাতেও কষ্ট। সিদ্ধ করে খাওয়ার পানি চালিয়ে নিতাম, এবার আর পারা গেল না, অগত্যা চমকধারী বিজ্ঞানের একটা মাধ্যমের আশ্রয়ে যেতে হলো, গেল অনেক টাকা গচ্চা। থাকব ঢাকায়, তিলোত্তমা ঢাকায়, রাজধানী ঢাকায়, সুপেয় করার জন্য পানির পেছনে কিছু গচ্চা দেব না, তা কি হয়? অতএব, বায়ুদূষণ যেভাবে নাক টিপে ধরে মেনে নেওয়া গেল, পানিদূষণ সেভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব হলো না। গলাধঃকরণ করতে গেলে তা যে আর পারা যায় না। তারপরও পানি না থাকার চেয়ে ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত পানি পেলেও তো চলে মাঝে মাঝে, যে পানি পাওয়া যায় না তার থেকে যেমনই হোক পাওয়াটাতো ভালো। পানির অপর নাম জীবন। অতএব, পানি দূষণের বিরুদ্ধে শোরগোল অথবা, নিষ্ফল আবেদন, এটা মেনেই ঢাকায় থাকতে হবে।

এ পানির সঙ্গে এবার আসুক ঢাকার নদীর পানি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অনেক নদী তো মরেই গেল, অনেকগুলো তো হোমড়া-চোমড়াদের দখলে-দখলে হারিয়ে যাচ্ছে। বন্ধু দেশের অকৃত্রিম বন্ধুত্বে তো পানি প্রবাহই থাকে না। তারপরও ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর দূষণ দেখলে ওগুলো নদী, নাকি আলকাতরা বা কালো রঙের কোনো দুর্গন্ধের শরবতের নালা, তা বোঝা বড় কষ্টকর। হায়রে বুড়িগঙ্গা, হায়রে তুরাগ-পত্রপত্রিকায় ছবিতে দেখা যায় শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য কীভাবে এ নদীগুলোকে হজম করে ফেলছে। একবার নৌকায় কোনো এক জায়গায় যাওয়ার সময় টের পেয়েছি-পানির দুর্গন্ধ কাকে বলে। তাহলে ওয়াসার পানিকে শুধু দোষ দিয়ে কী লাভ? নদীর পানি তো আরও বেশি দূষিত, আর এ দূষিত পানিই ঢাকাকে ঘিরে রেখেছে। কবে বৃষ্টি হবে, অনেক অনেক বৃষ্টি, তারপর এসব পানি একটু গোসল করে সাফসুতর হবে-আল্লাহর মর্জির ওপর নির্ভর করে থাকা ছাড়া উপায় নেই। অতিবৃষ্টি হলে আবার বন্যা, সে-ও তো অসহ্য। তবুও বৃষ্টি হোক, নদীগুলো একটু স্নান করে পয়-পরিষ্কার হোক অন্তত কিছু সময়ের জন্য। হে আল্লাহ আমরা তো ঢাকার আশপাশের নদীগুলোকে মলমূত্র বর্জ্য দিয়ে অপবিত্র করেই যাচ্ছি, তুমি মাঝেমধ্যে তাদের একটু গোসল করিয়ে দিও-তোমার কাছে এ প্রার্থনাই করি। ‘নদী গিলে খাচ্ছে বেপরোয়া দখলদার’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩)। তাহলে নদীই বা আর থাকবে কীভাবে? দূষণ তো হবেই।

শব্দদূষণ নামেও নাকি একটা শব্দ আছে অভিধানে। কী এক বিচ্ছিরি অবস্থা, গা ঘিন ঘিন করে এ শব্দদূষণের কথা শুনলে। ডেসিবল বলে কী একটা মাপ যেন আছে এর মাত্রায়। গায়ের বল থাকে যদি, ডেসিবল আবার কী? যত জোরে পারা যায় হর্ন বাজাতেই হবে, যত ঘনঘন পারা যায় বাজিয়ে যেতেই হবে। গাড়ির ইঞ্জিনটা তো নড়বড়ে, ওটা তো দম নিতে গিয়ে আওয়াজ করতেই পারে, সাইলেনসরটা তো কবে যে ছুটিতে গিয়েছে তা আর শেষই হয় না। তেল-মবিলের অসীম মেয়াদ কীসের? চলছে তো চলছেই, বদলানোর কী প্রয়োজন? ধারণক্ষমতায় চেয়ে বেশি বেশি যান, শব্দ তো এমনিতেই বেশি হবে। তারপরও নিয়মকানুন মানার বালাই তো নেই মোটেও। আবাসিক এলাকায় অনাবাসিক স্থাপনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানার ঘ্যানর ঘ্যানর তো আরও দূষণ সৃষ্টি করে। কিসের সাইনবোর্ড, কে মানে? অতএব, কান যত ঝালাপালাই হোক, মেনে নিতে হবে। শহরে থাকবেন, শহুরে হবেন, তারপর আবার ঢাকায়, শব্দদূষণ কি আর ঢেকে রাখা যাবে? যাবে না। অনিচ্ছায় হলেও হরেক রকম হকারের হ্যান্ড মাইকের চিৎকার। ভিক্ষুকের মাইকের আওয়াজ, তারপর তরকারিওয়ালার মাইকের আওয়াজ আশপাশে হজম করতেই হয়। অতএব, কোন সময়ে যে আমরা খবর পেয়ে যাব, শব্দদূষণেও আমরা বিশ্বে শীর্ষে! আমি বলি, ভালোই হবে, শীর্ষে থাকার একটা আলাদা মজা আছে না! শব্দদূষণে নাকি অনেকের শ্রবণশক্তি হারিয়ে যাচ্ছে, মন্দ কী, না শুনতে পারলে তো অনেক যন্ত্রণা এমনিতেই কমে যাবে।

বায়ু তো প্রাকৃতিক সম্পদ, এটা নিজে নিজে দূষিত হয় না, আমরা করি। পানিও প্রাকৃতিক উৎস থেকে আসে, তখন এটা দূষিত থাকে না, আমরাই করি। শব্দদূষণ তো সরাসরি আমাদেরই কীর্তি। খাদ্যদূষণের কথা বলতে গেলে এবার ভিন্ন মাত্রায় চিন্তা করতে হয়। খাদ্য উৎপাদনের উপকরণে আমরা ভেজাল দেই, ফলে খাদ্য দূষিত হয়। খাদ্যে ভেজাল দেওয়া যেন আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। আমার এখনো ভাবতে অবাক লাগে, বৎসরাধিক আমি যখন আফ্রিকায় ছিলাম, একদিনও আমার পেটব্যথা হয়নি, যা খেয়েছি ভালো লেগেছে। নিজেদের রান্নার জন্যও যা-ই কিনেছি, ভেজাল পাইনি। খাদ্যের ভেজাল বুঝতে আমার পেটটাই ছিল বড় ডাক্তার। অথচ আমার প্রিয় বাংলাদেশে খাবারের অনেক ক্ষেত্রে যে অবস্থা, তাতে একটু খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ‘সিগন্যাল’ এসে যায়। ভেজালবিরোধী আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই ঠিকমতো, আপসে নাকি চলে অনেক কিছু। দেশে তো আইনের কমতি নেই, তারপরও ভেজাল কেন হয়? হয় দুকারণে-এক. লোভ, যত বেশি ভেজাল দেওয়া যায়, ততবেশি লাভ। কেবল লাভ আর লাভ-লাভে-লাভে লাভাকার। দুই. লোভীদের এ লোভ সামাল দেওয়ার জন্য আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই ঠিকমতো। আবার আইনেরও রয়েছে ফাঁকফোকর, অতএব, খাদ্যদূষণ এখন নিত্যনৈমেত্তিক ব্যাপার। আমাদের পেটে নাকি সব সয়। অতএব, দূষণ নিয়ে আমাদের ভাবনা কীসের? বরং বিশুদ্ধ খাবারই হয়তো এ পেটে আর সইবে না।

তাহলে আমরা কী দেখছি? দেখছি কেবল দূষণ আর দূষণ। ঢাকার বাসিন্দাদের এ দূষণের শিকার হতে হচ্ছে অতিমাত্রায়। কিছু দূষণে গোটা দেশ ভুক্তভোগী, কিন্তু বেশির ভাগ দূষণে ভুক্তভোগী ঢাকাবাসী। সুষম উন্নয়ন না করে, উন্নয়নকে সারা দেশে ছড়িয়ে না দিয়ে যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের সুযোগ কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক বেশি বেশি করায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। ফলে দূষণ এখানকার অপরিহার্য দুর্ভাগ্যে পরিণত হচ্ছে। বেশি উপার্জনের ক্ষেত্র হিসাবে একটা অঞ্চল অতিমাত্রায় অনুকূল হয়ে গেলে, জীবন ধারণের পরিপূরক সুবিধাদি এক অঞ্চলে বেশি থাকলে, নাগরিক ও কারিগরি বিকাশ এক অঞ্চলে অবারিত হয়ে পড়লে ওই অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই জনস্রোত বাড়বে। তখন অনেক দূষণের মধ্যেও জনগণ তুলনামূলক লাভজনক বিবেচনায় সে অঞ্চলে ভিড় করবে। ঢাকার অবস্থা হয়েছে এখন তা-ই। অতএব, ঢাকায় দূষণও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অবসরের পরও অনেকে গ্রামে যাচ্ছে না একমাত্র এসব সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতার কারণে, ঢাকায় বেশি বলে সবাই ঢাকায়ই থাকতে চাচ্ছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সুবিধা পাওয়ার জন্যই ঢাকার ওপর চাপ বাড়াচ্ছে মানুষ। সারা দেশে সুষম উন্নয়নের নীতি গৃহীত হলে এবং দাপ্তরিকভাবে এককেন্দ্রিক না করে ঢাকাকে ভাঙা হলে এ দূষণ তুলনামূলকভাবে কমানো যেত। অতএব, ঢাকা ভাঙার একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এখন সময়ের দাবি। ঢাকায় ভূষণ যে এখন কেবল দূষণ আর দূষণ, তা থেকে অব্যাহতি পেতে হলে আইন প্রয়োগে রাজনৈতিক সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ভাঙার উদ্যোগের বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। ঢাকা ভাঙা নিয়ে পরে আলাদাভাবে লেখার ইচ্ছা রইল।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

চেতনা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম