স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এক অনন্য দলিল
রাশিদুল হাসান
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক ঐতিহাসিক ও অনন্য দলিল। ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন সাংবিধানিক সরকার গঠন করা হয়, যা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রথম গণতান্ত্রিক ও আইনানুগ সরকার।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতার নাটক ব্যর্থ হওয়ার পর ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। ওই রাতে গণহত্যা চালানোর টার্গেট করে মূল অপারেশনাল পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়নের জন্য ১৮ মার্চ, জিওসির অফিসে জেনারেল রাও ফরমান আলী ও জেনারেল খাদিম রাজা বৈঠকে বসেন। বৈঠকে জেনারেল ফরমান হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল প্যাডের ওপর নতুন পরিকল্পনাটি লিপিবদ্ধ করেন। যার দ্বিতীয় অংশটি লেখেন জেনারেল খাদিম। পরিকল্পনাটি সংশোধনপূর্বক চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল আবদুল হামিদ খান অনুমোদন করেন (উইটনেস টু সারেন্ডার)। ওই কালরাত্রিতে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে জেনারেল ফরমানের নেতৃত্বে ঢাকায় এবং জেনারেল খাদিমের নেতৃত্বে বাকি ১০টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে অপারেশনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সামরিক অভিযানের কোড নেম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। রাত ১১টা ৩০ মিনিটে বেতারযন্ত্রসজ্জিত জিপটি প্রথমবারের মতো তীক্ষè শব্দে ফেটে পড়ল। ঢাকার পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের আবাসিক কোয়ার্টার, জগন্নাথ হল, তদানীন্তন ইকবাল হল প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। হাজার হাজার নিরস্ত্র বাঙালি ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যা বিশ্বের ইতিহাসে এক বর্বরোচিত গণহত্যা হিসাবে বিবেচিত হয়।
’৭১-এর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে (০০:২০) পাকিস্তান পার্লামেন্টের মেজরিটি পার্টির লিডার আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন-‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ অতঃপর রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় (সিদ্দিক সালিক, উইটনেস টু সারেন্ডার)। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তাটি তাৎক্ষণিকভাবে মগবাজার ওয়্যারলেস স্টেশনে পাঠানো হয়। স্বাধীনতার বার্তাটি ডিএইচএফ চ্যানেলে মগবাজার থেকে চট্টগ্রামের সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনে পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে লয়ালপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। লয়ালপুর মার্শাল ল কোর্টে মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়।
সায়মন ড্রিংই প্রথম ২৫ মার্চের পরিকল্পিত গণহত্যার খরবটি ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে অবহিত করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’। প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে তিনি তার বর্ণনায় বলেন, ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দখলপূর্বক, পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল লক্ষ্য করে কামান ও মর্টার হামলা চালায়। হলের ছাত্রদের গুলি করে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় এবং দুই দিন পরও মৃতদেহ একটু একটু করে আগুনে পুড়তে দেখা যায়। হলের পার্শ্ববর্তী পুকুরে শত শত লাশ ভাসছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের অগণিত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ‘আল্লহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং সন্ত্রস্ত এক নগরী’।
অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ‘দ্য রেপ অব বাংলাদেশ’ বইয়ের মুখবন্ধে বলেন, হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অমানবিক কার্যকলাপ পড়েছি। কিন্তু ইস্ট বেঙ্গলে যা দেখলাম, তার চেয়েও সেটা ভয়ংকর ও যন্ত্রণাদায়ক। গ্রন্থের ‘গণহত্যা’ অধ্যায়ে লিখেছেন, প্রদেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞের সুব্যবস্থার নমুনার সঙ্গে জেনোসাইড শব্দটির অভিধানিক সংজ্ঞার হুবুহু মিল রয়েছে।
তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, বিএসএফের ডিজি কেএফ রুস্তমজী ও গোলক মজুমদার ২ এপ্রিল ভোরে একটি সামরিক কার্গো বিমানে দিল্লির উদ্দেশে কলকাতা বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ৪ এপ্রিল সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব? ইজ হি অল রাইট?’ জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তার স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন’ (ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি)। উভয়ে প্রবাসী সরকার গঠনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান।
১০ এপ্রিল স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলো। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণকর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ’৭১-এর ২৬ মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রক্রিয়ায় আইনি দলিল হিসাবে স্বীকৃত।
২৬ মার্চ স্বাধীনাতা ঘোষণার পর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত জনপ্রতিরোধ শুরু হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়, যুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধুপ্রতিম ভারত সরকারের ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ওই সরকারের ভূমিকা ছিল অনন্য। এমএজি ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক এবং এমএ রবকে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল, কলকাতা পাকিস্তান মিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীর নেতৃত্বে সব কর্মকর্তা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ৬ এপ্রিল দিল্লি পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব কেএম শেহাবুদ্দিন আহমেদ ও আমজাদুল হক পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ভারতীয় ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ তার গ্রন্থ ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’তে লিখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তি যেভাবে ইংল্যান্ডের মাটিতে চার্লস দ্য গলের নেতৃত্বাধীন ‘ফ্রি ফ্রেঞ্চ ফোর্স’কে মদদ দিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই ভারতের সমর্থন পেয়েছিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার।
১৯৭১ সালের জুলাইয়ে ইউএস সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে পিকিং সফর করেন। চীন-মার্কিন সম্পর্কোন্নয়নে পাকিস্তান মধ্যস্থতা করে। ফলে ৯ আগস্ট দিল্লিতে ২০ বছরমেয়াদি ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের পক্ষে দলিলে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো। হিমালয়ের তুষার ও সোভিয়েতের বন্ধুত্ব, এ দুটি ছিল চীনের বিরুদ্ধে ভারতের রক্ষাকবচ। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
পর্বতপ্রমাণ কফিনের নিচে অখণ্ড পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। ৩০ লাখ শহিদের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা উপাখ্যানের পশ্চাতে রয়েছে মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও অপরিসীম আত্মত্যাগ। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজির নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য অস্ত্রশস্ত্রসহ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারের উপস্থিতিতে বিকাল ৪:৩১ মিনিটে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। বিশ্বের মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ।
রাশিদুল হাসান : সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় চার
নেতা পরিষদ
rhassan022@gmail.com
