Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

পহেলা বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা

Icon

একেএম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পহেলা বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা

নতুন বছরকে বরণ করা সারা পৃথিবীর মানুষের একটি সহজাত রীতি। প্রকৃতি প্রেমের সঙ্গে এর সম্পর্ক। এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষ তাদের আগমনকে স্মৃতিময় করে রাখার জন্য, তাদের জীবন ও জীবিকার উৎসের জন্য বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আনন্দময় করার প্রত্যাশা সামনে রেখে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে।

দীর্ঘকাল ধরে নববর্ষ পালনের বাঙালি সংস্কৃতিটি একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসাবে পালিত হয়ে এসেছে। এরপর অশুভ রাজনীতির লক্ষ্য পূরণ করতে আইয়ুব খান এদেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরির জন্য বাঙালির সাংস্কৃতিক আয়োজনকে হিন্দু সংস্কৃতি বলে প্রচার করে দেওয়াল তুলতে চেয়েছিলেন।

একই কাজ অন্যভাবে করার চেষ্টা ছিল ভারতের ব্রিটিশ শাসকদেরও। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য বিভাজন নীতি প্রয়োগ করে ইংরেজ শাসক। আর এসব কাজে সমাজে ঘুণপোকা তৈরির জন্য সুবিধালোভী মোল্লা ও পুরোহিত পেতে তাদের সমস্যা হয়নি।

তাদের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ বাঙালিকে বিভাজিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। সরল বাঙালির প্রকৃত ধর্মচর্চার সীমাবদ্ধতাকে পুঁজি করে একদিকে মনস্তাত্ত্বিক ভাঙন তৈরি করা হয়েছে, অন্যদিকে তাদের আচরণে নিজ নিজ ধর্মের সৌন্দর্য কালিমালিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ছিলেন এই ইংরেজ মানসিকতার উত্তরাধিকার।

ভাষা আন্দোলনের সাফল্যের ফলে পাকিস্তানি শাসকদের উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হয়নি। তবুও হাল ছাড়েননি আইয়ুব খান। আবার ধর্মকে অপব্যবহার করে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন বাঙালি মুসলমানকে। প্রচার করার চেষ্টা করেছেন বাংলা ‘হিন্দুর’ ভাষা আর উর্দু ‘কুরআনের’ ভাষা বলে। উনিশ শতকে হিন্দু সমাজপতিরা ব্রাহ্ম আদর্শের অনুসারীদের হিন্দু বলে মানতে চায়নি।

সেই ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম নেওয়া কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পূর্ব পাকিস্তানে পরিত্যাগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এভাবে বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানার আরেক অশুভ চেষ্টা দেখেছিলেন এদেশের সংস্কৃতি কর্মীরা। প্রতিবাদে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ছায়ানট। প্রতিবাদ হিসাবে রবীন্দ্র সংগীত ‘এসো হে বৈশাখ’ গানের সুরমূর্ছনা দিয়ে শুরু হয় বাঙালির নববর্ষ পহেলা বৈশাখ পালনের প্রথম প্রহর।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে পরাজিত শক্তিগুলো হাতগুটিয়ে বসে নেই। যুগ যুগ ধরে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐক্যবদ্ধভাবে বাঙালি সংস্কৃতি লালন করে এসেছে। এর ভেতর অন্ধকার ছুড়ে দেওয়ার জন্য আইয়ুব খানের প্রেতাত্মারা হঠাৎ অতি ধর্মাশ্রয়ী করতে সচেষ্ট হয়েছে বাংলাদেশের সরল ও প্রকৃত ধার্মিক মানুষদের। ধর্মীয় আলোচনাগুলোতে বাঙালি মুসলমানকে ধার্মিক না করে ধর্মান্ধ করার চেষ্টা ছিল।

পোশাকি মুসলমান বানাতে চেয়েছে বাঙালিকে। তাই জীবনের মাঝপর্বে এসে শুনতে হচ্ছে পহেলা বৈশাখ পালন, অধুনা মঙ্গল শোভাযাত্রা করা ‘হিন্দুয়ানী’। অর্থাৎ ইতিহাস-মূর্খ বা জ্ঞানপাপীরা অবলীলায় বাঙালির সাংস্কৃতিক অধিকার থেকে বাঙালি মুসলমানকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছে। আর একশ্রেণির অসচেতন বাঙালি ইসলাম ধর্মের কাছ থেকে সঠিক শিক্ষা না নিয়ে ওদের ফাঁদে পা দিয়ে সমাজকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে।

আমরা বরঞ্চ একবার ইতিহাসের দরজা খুলে দিয়ে পহেলা বৈশাখের উৎস খুঁজে নিতে পারি। বাংলা নববর্ষকে নির্দিষ্ট করতে ভূমিকা রেখেছিলেন অবাঙালি মোগল সম্রাট আকবর। ইতিহাসটি একটু অন্যরকম। মোগলদের রাজস্ব আয়ের একটি বড় অঞ্চল ছিল বাংলা। জমিদারদের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় হতো। বাংলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। বন্যা, ঝড়, খরায় প্রায়ই ফসলহানি ঘটত। এমন বিপর্যয় ঘটলে প্রজা এসে নিবেদন করত খাজনা মাফ করার জন্য। তখনো তেমনভাবে প্রজা পীড়নের যুগ শুরু হয়নি।

বাস্তব অবস্থা মেনে মোগল দরবারে জমিদার প্রকৃত তথ্য জানাতেন। এতে সংকট হলো মোগল অর্থনীতিতে। বারবার রাজস্ব না পেলে মোগল সম্রাট সাম্রাজ্য চালাবেন কেমন করে। তাই সম্রাট আকবর তার বিখ্যাত অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমলকে এ সমস্যার সমাধান করার দায়িত্ব দিলেন। টোডরমল বাংলার প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলেন বছরের যে সময় কৃষকের গোলায় কমবেশি ফসল উঠবে, তখন যদি খাজনা পরিশোধের দিনক্ষণ ঠিক হয়, তাহলে প্রজার খুব বেশি কষ্ট হবে না খাজনা দিতে।

এই বিবেচনায় তিনি বাংলা ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করলেন, যা অনেক পরে বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। ফসলের সঙ্গে এ দিনপঞ্জি সম্পর্কিত বলে সূচনায় ফারসি উচ্চারণে বাংলা সনের নাম হয়েছিল ‘ফসলি সন’। ফসলি সনের প্রথম মাসটি ছিল বৈশাখ। তাই সঙ্গত কারণেই পহেলা বৈশাখ হয়ে গেল ফসলি সনের প্রথম দিন অর্থাৎ বাঙালি নববর্ষের প্রথম দিন।

নববর্ষে আনন্দ উৎসব যুক্ত হওয়া ছিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মহানবির আমল থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে আরবে বাঙালির পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বিষয়টি জানা থাকার কথা নয়। তাই জোর করে এখানে ধর্ম যুক্ত করা ধর্মকে সংকীর্ণভাবে উপস্থাপন করার নামান্তর। বাঙালির নববর্ষ পালনে নানা উৎসব যুক্ত হওয়ার পেছনেও ইতিহাস রয়েছে। ফসলি সনে প্রজা যাতে উৎসাহের সঙ্গে খাজনা দিতে পারে, তার একটি যৌক্তিক পটভূমি তৈরি করেছিলেন জমিদাররা। সে যুগে খাজনা হিসাবে নেওয়া হতো উৎপাদিত ফসলের নির্দিষ্ট অংশ।

পহেলা বৈশাখের দিন বা আগের দিন অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির দিন খাজনা পরিশোধের তারিখ নির্দিষ্ট ছিল। এদিন প্রজারা খাজনার ফসল নিয়ে আসতেন জমিদারের দপ্তরে। সেদিন উৎসবের আয়োজন করতেন জমিদার। এ উৎসবের নাম ছিল ‘পুণ্যাহ’। ময়রারা জমিদার বাড়িতে বসেই মনে মনে মিষ্টি বানাত। প্রজাদের পেট ভরে মিষ্টি খাওয়াতেন জমিদার। প্রজাদের জন্য বিশেষ যাত্রাপালার আয়োজন হতো নাটমন্দিরে। এভাবে জমিদাররা সামাজিক মিলনের ব্যবস্থা করেছিলেন। একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হতো। এ পথ ধরেই নববর্ষ বাঙালি জীবনে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্ম দেয়।

নববর্ষে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ‘হালখাতা’র রেওয়াজ শুরু করে। পহেলা বৈশাখ প্রত্যুষে হিন্দু ব্যবসায়ী দোকান সাফসুতরো করেন। পুরোহিত পূজাঅর্চনা করে দিনের শুভ সূচনা করেন। পরে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। একইভাবে মুসলমান ব্যবসায়ী দোকান পরিষ্কার করে মিলাদ পড়িয়ে মিষ্টি বিতরণ করেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীর মিষ্টি হিন্দু ও মুসলমান খেতে দ্বিধা করেনি কোনো কালে।

এসব আনুষ্ঠানিকতা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে যুগ যুগ ধরে। এভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে না দেখে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবেই মানতে হবে। এখানে বিশেষ কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের সংস্কৃতির প্রতিফলন নেই, বরঞ্চ এর পুরোটাই সম্প্রদায় নির্বিশেষে একটি অভিন্ন বাঙালি সংস্কৃতি।

বেশ কয়েক বছর ধরে দেখছি, কোনো এক পক্ষের গাত্রজ্বালা পহেলা বৈশাখ উৎসবের অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে। মঙ্গল শোভাযাত্রার সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে। এটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে যুক্ত হয়েছে। এ সংবাদে বাঙালিমাত্রই গর্বিত হওয়ার কথা।

কিন্তু অন্ধকারের জীবরা এর ভেতর থেকে অন্ধকার খুঁজে বেড়ায়। আমার এক ধার্মিক মেধাবী ছাত্র যথার্থই বলেছিল, স্যার মুসলমান হিসাবে আমি নিজের ইমানকে মজবুত মনে করি, তাই মঙ্গল শোভাযাত্রা দেখে বা তাতে অংশ নিয়ে আমার ধর্মের ও ইমানের ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করি না। যাদের ইমান দুর্বল বা অন্য অভিসন্ধি আছে, তারা হায় হায় করুক, তাতে কান দেওয়ার প্রয়োজন কী! আমি ওর ব্যাখ্যাকে যথার্থ মনে করি।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় গাত্রদাহ কেন জানতে চেয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনের এক ছাত্রের কাছে। ও বলল, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি তৈরির পক্ষে যারা, তারা বলতে চায় শোভাযাত্রায় পেঁচার পট আঁকা হয়, নানা দেব-দেবীর বাহন তৈরি করা হয়-তাই এটি হিন্দুয়ানী। বুঝলাম আইয়ুব খানের প্রেতাত্মা আবার ভর করেছে। কোনো একটি উদ্দেশ্য আছে নিশ্চয় সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্টের।

পেঁচাকে শুধু লক্ষ্মীর বাহন হতে হবে কেন? বাংলার প্রকৃতিতে কি পেঁচা নেই? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাতের বেলা এসে শুনে যান শত পেঁচার ডাক। শোভাযাত্রায় তো প্রজাপতি, ফড়িং, মোরগ, দোয়েলসহ বাংলার প্রকৃতির নানা পশুপাখি যুক্ত থাকে। তাই বলব, কোন প্রাণী কার বাহন এসব ছিদ্রান্বেষণ না করে বাঙালি সংস্কৃতিকে সহজভাবে ভাবতে শিখুন। মনে রাখতে হবে, এদেশের সাধারণ মানুষ এসব সংকীর্ণতা নিয়ে কখনো ভাবে না। তাই তাদের ইমান দুর্বল হওয়ারও কোনো কারণ নেই।

যুগ যুগ ধরে পহেলা বৈশাখে দেশজুড়ে গ্রাম্য মেলা হয়। সেখানে নানা পসরা সাজে। পোড়ামাটির তৈরি নানা পশুপাখি তৈরি হয়। ছোটরা আনন্দের সঙ্গে এসব কিনে আনে বাড়িতে। এসবের কারণে বাঙালি মুসলমানের ধর্মহানি হয়েছে-এমন আওয়াজ তো কেউ তোলেনি। একই ধারার বাঙালি সংস্কৃতির নাগরিক উৎসবের অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। তাই বাঙালি হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের আনন্দ উৎসবের এ অনুষঙ্গকে শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক অধিকার বলার ক্ষমতা কে এই জ্ঞানপাপী অথবা জ্ঞান-মূর্খদের দিয়েছে?

পহেলা বৈশাখের উৎসবকে নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরির অবসান ঘটাতে হবে। কোনো অর্বাচীনদের বয়ানে নয়, প্রয়োজনে পবিত্র ধর্মগ্রন্থের প্রকৃত ব্যাখ্যা এবং ইতিহাসের সত্য থেকেই সুন্দরকে খুঁজে নিতে হবে।

ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

পহেলা বৈশাখ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম