Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ভ্রাতৃত্ববোধই ঈদের মূল শিক্ষা

Icon

ড. মতিউর রহমান

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভ্রাতৃত্ববোধই ঈদের মূল শিক্ষা

রমজান শেষে খুশির বার্তা নিয়ে আবারও এসেছে ঈদুল ফিতর। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলমানরা ঈদুল ফিতর উদযাপন করবে। ঈদ নিছক ধর্মীয় উৎসব নয়, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে। আর ঈদের উৎসব সর্বজনীন। ঈদের সামাজিক অর্থ হলো উৎসব, আর ভাষাগত অর্থ হলো বারবার প্রত্যাবর্তন। তাই প্রতিবছর মুসলমানদের জীবনে ফিরে আসে খুশির ঈদ।

বাংলাদেশে ঈদ জাঁকজমকপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়। এদিন সবাই যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো পোশাক পরে। বাড়িতে ভালো মানের খাবারের ব্যবস্থা করে। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরাও এ আনন্দে শরিক হন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীও এ দিনটিকে যথাযথ মর্যাদা ও আনন্দের সঙ্গে পালন করে। মুসলমানরা ঈদগাহ বা মসজিদে নামাজ পড়ে।

ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে ঈদের আবেগ ও আনন্দ শেয়ার করা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সমাজের ধনী ও সামর্থ্যবানরা দরিদ্রদের একটি নির্দিষ্ট হারে জাকাত ও ফিতরা বিতরণ করে, যা ধনীদের জন্য ধর্মীয়ভাবে বাধ্যতামূলক।

সমগ্র বাংলা অঞ্চলের ঈদ ও ঈদ উৎসবের ইতিহাস আজও সঠিকভাবে জানা যায়নি। বাংলাদেশে রোজা ও ঈদুল ফিতর উদযাপনের ইতিহাস বিভিন্ন ঐতিহাসিক বই, সূত্র ও যোগাযোগ থেকে কিছুটা জানা যায়। ইতিহাসবিদ ও পণ্ডিতরা উল্লেখ করেছেন, ঈদ উৎসব ধ্রুপদি ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা বলেছেন, যদিও দ্বাদশ শতাব্দীতে বাংলায় ইসলামের আগমন ঘটে, তবে শাস্ত্রীয় ইসলাম চার থেকে পাঁচশ বছর ধরে নিবিড়ভাবে অনুসরণ করা হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। সেকালের বাংলায় ঈদ উৎসবের তেমন কোনো ঘটনা লক্ষ করা যায় না। এর দুটি কারণ হতে পারে : এক. গ্রামবাংলার মুসলমানরা দরিদ্র ছিল এবং দুই. মুসলমানদের মধ্যে স্বতন্ত্র সম্প্রদায়বোধ প্রবল ছিল না। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে সামাজিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার শর্ত তৈরি হয়নি। এটি সর্বজনবিদিত যে, একটি দৃঢ় সামাজিক ভিত্তি ছাড়া কোনো উৎসব প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সপ্তদশ, অষ্টাদশ, ঊনবিংশ শতাব্দীতেও বৃহত্তর বাংলায় ঈদ উৎসব দেখা যেত না।

অভিজাত ব্যক্তিরা (নবাব বা বাদশাহ) ঈদ উদযাপন করত, তবে তা তাদের ও উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ঈদ সাধারণ মানুষের সামাজিক উৎসব হিসাবে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেনি। উনিশ শতকজুড়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শহুরে জীবন এবং গ্রামীণ ধনী বা শিক্ষিত সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। অন্যান্য ধর্মের কঠোর আচরণবিধি বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রসারে সহায়তা করে। ফলে ইসলাম ধর্মের নানা অনুষঙ্গ ও উৎসব প্রচলিত হতে থাকে। সাধারণ মানুষ এসব উৎসব পালন করা শুরু করে।

যা হোক, ঈদুল ফিতর ভালোবাসা ও মিলনের উৎসব, মানুষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি গড়ে তোলার উদযাপন। এটি সবার জন্য আনন্দ নিয়ে আসে। ঈদ সব মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। জাতীয় জীবনে এর আবির্ভাব সর্বত্র দেখা যায়। সব ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব উল্লেখযোগ্য। ভিন্ন ধর্মের মানুষও ঈদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুফল ভোগ করে।

সামাজিক গুরুত্ব ছাড়াও ঈদের অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব রয়েছে। ঈদ উৎসবকেন্দ্রিক আয়োজনও কম নয়। ঈদ সামনে রেখে ঈদের বাজার চাঙা হয়, যা একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকেও মজবুত করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঈদের বাজারে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় বলে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন। দারিদ্র্য হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ায় ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন প্রতিবছর বাড়ছে।

ঈদ উপলক্ষ্যে প্রবাসীরা অনেক রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। ঈদের সময় বৈদেশিক অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হয়। ব্যাংক খাতও শক্তিশালী হয়। ঈদ উপলক্ষ্যে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় অন্য সময়ের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি লেনদেন হয়।

ঈদের আনন্দ উৎসব উপভোগ করতে সবাই চায় প্রিয়জনের কাছাকাছি থাকতে। এদেশের অনেক মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে বসবাস করে। তাদের অধিকাংশ পরিবার ও আত্মীয়স্বজন গ্রামে থাকে। তাই ঈদের উৎসবে তারা নাড়ির টানে গ্রামে ফেরে। বাড়ি না ফিরলে অধিকাংশ পরিবারই ঈদ উদযাপন অসম্ভব বলে মনে করে। তাই পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে গ্রামে ফেরেন তারা। ঈদের সময় অপেক্ষাকৃত বেশি ছুটি থাকায় অনেকেই আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারেন। এ কারণে সামাজিক সম্পর্ক জোরালো হয়।

ঈদে মানুষের যাতায়াত বেশি হয়। এটি এক ধরনের দুর্ভোগেরও কারণ হয় বটে। ট্রেন, বাস ও লঞ্চে আসন না পাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে প্রতিবছরই ভোগান্তিতে পড়তে হয় মানুষকে। তাছাড়া যানজটসহ অন্য আরও সমস্যা রয়েছে। ঈদের আগে ও পরে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকে নিহত ও আহত হয়। এসব পরিবারে ঈদে আনন্দের পরিবর্তে নেমে আসে বিষাদের ছায়া।

দেশের বেশিরভাগ মানুষ যখন দুর্ভোগ ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামে ছুটে যায়, সেসময় অনেক বিত্তবান ব্যক্তি দেশ ছেড়ে বিদেশে ঈদ উপভোগ করতে যায়। ধনী-গরিবের এ বৈষম্য ঈদ উৎসবের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঈদ উদযাপনের জন্য উৎসব ভাতা পান। দিনমজুর, কৃষক, রিকশাচালকসহ অনেক নিম্নআয়ের মানুষ এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাছাড়া অন্যান্য পেশার মানুষ কয়েকদিন ঈদের ছুটি উপভোগ করতে পারলেও উৎসবের দিনেও কাজ করতে হয় কৃষক-দিনমজুরদের। এদিকে ঈদের আগে বেতন-বোনাস না পাওয়ায় বেসরকারি খাতের অনেক শ্রমিক ও তাদের পরিবারের ঈদ উৎসব ম্লান হয়ে যায়।

ঈদের খুশির দিনেও অনেক অসহায়-গরিব মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটায়। এছাড়া অনেক পথশিশু কাগজ সংগ্রহ করে বিড়ি-সিগারেট বিক্রি করে ঈদের দিন পার করে। ঈদের আনন্দ তাদের নাগালের বাইরে। তাদের পক্ষে নতুন পোশাক পরা, বিনোদন বা আনন্দ উপভোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারা চিড়িয়াখানা ও শিশু পার্কসহ শিশুদের বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে যায়, তবে ঈদ আনন্দ উপভোগের জন্য নয়-বরং তাদের বেঁচে থাকার জন্য, জীবিকার সন্ধানে। কিছু ধনী ব্যক্তির দয়ার কারণে কিছু গরিব মানুষ নতুন জামাকাপড় পরে ভালো খাবার খেয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারে। সেক্ষেত্রে ধনীদের পাশাপাশি গরিবদের ঘরেও ঈদ কিছুটা আনন্দ নিয়ে আসে।

ভ্রাতৃত্ববোধ ও জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলাই ঈদের মূল শিক্ষা। পুরোনো বিদ্বেষ আর হানাহানির কথা ভুলে মুসলমানরা একে অপরকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে সাম্যের এ উৎসবে। পবিত্র ঈদুল ফিতরে জাতীয় ঐক্য, সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্ব সুসংহত হয়। তবে এক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায় আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কথাবার্তা ও আচরণে। এমনকি এই পবিত্র উৎসবের দিনেও তারা রাজনৈতিকভাবে বৈরী আচরণ করেন। তাদের কণ্ঠে জাতীয় ঐক্যের বদলে অনৈক্য শোনা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা জাতিকে আরও উৎকণ্ঠিত করছে। এ রাজনৈতিক অস্থিরতায় পবিত্র ঈদের সম্প্রীতি ব্যাহত হয়। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, আর্থসামাজিক বৈষম্যের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে ঈদের আনন্দ সীমিত হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে জাতীয় নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক অনৈক্যের কারণে ঈদের খুশি ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

মুসলমান সমাজের প্রধান আনন্দ উৎসব ঈদ। আর এ উৎসবের মূলে রয়েছে সামাজিক ঐক্য। ঈদুল ফিতরের সব অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা বিনিময়ের মাধ্যমে মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটাই ঈদুল ফিতরের সামাজিক তাৎপর্য। বিশ্বব্যাপী প্রত্যেক মুসলমান যাতে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, সেজন্য রমজান মাসে অধিক হারে দান, জাকাত ও ফিতরা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ধর্মে। এতে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমতে পারে। ঈদ উৎসবে কেনাবেচা বেড়ে যায়, যা অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে। এসবই ঈদুল ফিতরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব। পবিত্র ঈদ মানব সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন, যেখানে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কালো-সাদা নির্বিশেষে সবাই একই কাতারে মিলিত হয়।

ইতঃপূর্বে করোনা মহামারির কারণে দুবছর ঈদ উৎসব তেমন জমেনি। এবার রমজান মাস শুরু হওয়ার আগে ও রোজার মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণ ও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে ঢাকার বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডে বহু ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। এছাড়া নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের। তাই তাদের জন্য ঈদ উদযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া আবহাওয়ার বৈরিতা, বিশেষ করে তীব্র গরমে নিম্ন-আয়ের ও খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। তাদের উপার্জন কমে যায়; ফলে ঈদ উৎসব ম্লান হয়ে যায়। তবে এসব সত্ত্বেও ঈদ উৎসবের আর্থসামাজিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

ড. মতিউর রহমান : গবেষক ও উন্নয়কর্মী

 

ঈদুল ফিতর ঈদের মূল শিক্ষা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম