নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
সব ক্ষেত্রে ‘সিন্ডিকেট’ থাকলে জনগণ যাবে কোথায়?
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ২০ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘মন্ত্রীদের ভেতর একটা সিন্ডিকেট আছে’। ‘সব কথা বলতে গেলে দেখবেন আমার লাশটা রাস্তায় পড়ে আছে’। এসব আমার নিজের কোনো কথা নয়। যুগান্তরের (১৬.০৫.২৩) খবরের শিরোনাম। দেখা যাচ্ছে, যুগান্তরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন আমাদের শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। শিরোনাম পড়ে আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি যে, এমন কথা শিল্প প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার কেউ বলতে পারেন।
এ কথা ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল আরেকটি শিরোনামের কথা এবং তা শিল্প প্রতিমন্ত্রীরই। ওই খবরটির শিরোনাম (১২.০৫.২৩) হচ্ছে, ‘মানুষ বাজার করতে গিয়ে কাঁদছে’। তিনি আরও বলেছেন, ‘কিছু ব্যক্তির কাছে অর্থনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে।’ এসব শিল্প প্রতিমন্ত্রীর কথা। দেখা যাক এবার পরিকল্পনামন্ত্রী কী বলেন। তার খবরটির শিরোনাম (১৬.০৫.২৩) হচ্ছে, ‘আসন ঠিক রাখতে প্রধানমন্ত্রীকেও আপস করতে হয়’। এ খবরটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘প্রণোদনার নামে উন্মাদনা থেকে পর্যায়ক্রমে বেরিয়ে আসা উচিত।’
পরিকল্পনামন্ত্রী দুঃখ করে বলেছেন, তিনি এলাকায় গেলে এলাকার লোক তার কাছেই আসে না। তার ভাষা তারা বোঝে না। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন, ‘অর্থনৈতিকভাবে আমাদের সঙ্গে তাদের ফারাক সৃষ্টি হয়েছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমার গ্রামের ছেলেরা স্কুলে যায় না। বাপ-মা তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানে পাঠায়।’ পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান আরও বলেছেন, ‘আমি গ্রামে যাই সরকারি মালামাল নিয়ে, এগুলো কোথায় যায় জানি না। এটা খুঁজে বের করাও কঠিন।’ তিনি বলেছেন, ‘হুন্ডির সঙ্গে পারি না।’ ঋণখেলাপিদের বিষয়ে মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, এর সঙ্গে নানাবিধ স্বার্থবাদী বড় বড় লোকেরা জড়িত আছে। তারা এখন পর্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। এদিকে আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘পণ্য মূল্যবৃদ্ধিতে কিছু ব্যবসায়ী সুযোগ নিচ্ছেন।’ (১৫.০৫.২৩)
উপরে একজন প্রতিমন্ত্রী এবং দুজন মন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরলাম। অবশ্য প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য আরও দীর্ঘ। এটি তার সাক্ষাৎকার। বলা যাবে না যে, ‘মিস রিপোর্টিং’ রয়েছে। তিনি তার সাক্ষাৎকারে যা যা বলেছেন, তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বক্তব্য হচ্ছে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে। তিনি বলেছেন, তার কাছে মন্ত্রণালয়ের ফাইল আসে না। সচিবের কাছ থেকে ফাইল মন্ত্রীর কাছে চলে যায়। কারণ তিনি কয়েকটি ফাইলে উলটো নোট দিয়েছেন। তিনি পণ্যের সিন্ডিকেটের কথা বলেছেন। কীভাবে বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরা সরকারি ব্যাংকের টাকায় ব্যাংকের মালিক হয়েছেন, তার কথা বলেছেন। সচিবরা কথা শোনেন না। মন্ত্রীদের তাদের কথামতো চলতে হয় বলে তিনি তার সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন।
বলা বাহুল্য, তার পুরো সাক্ষাৎকার পড়লে যে কোনো পাঠকের মনে নানা প্রশ্ন জাগবে। আমার মনেও প্রশ্ন জেগেছে। তিনি অভিমানে এসব কথা বলেছেন, না ক্ষোভে? হতে পারে, তিনি দেশের, অর্থনীতির, বাণিজ্যের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছেন। আবার বলেছেন, তিনি তার মতামত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন।
এসব পড়ে এবং শুনে আমার পুরোনো ঘটনা মনে পড়ছে। ঘটনা দুটি দুজন সাবেক অর্থমন্ত্রীর। একটি ঘটনা প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সময়ের। আরেকটি ঘটনা প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সময়ের। দুজনেরই প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু কাগজে দেখেছি তাদের কোনো কাজ ছিল না। একজন প্রতিমন্ত্রী হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ছুটির ফাইল ছাড়া তার কাছে আর কোনো ফাইল আসে না।
আরেকজন প্রতিমন্ত্রী, যিনি এখন পুরো মন্ত্রী, তার সঙ্গে তো মন্ত্রীর প্রকাশ্যে বাদানুবাদ হতো। কাগজে পর্যন্ত এসব খবর ছাপা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়। এসব ঘটনা ও অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয় প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী ইত্যাদি পদ শোভামাত্র। বাস্তবে তাদের কোনো কাজ নেই। পূর্ণ মন্ত্রীরা তাদের কোনো কাজ দেন না। কাজ না দিলে তারা কিছু করতে পারেন না। কারণ ক্ষমতার কাঠামোতে মন্ত্রী মহোদয়ই সর্বেসর্বা। তিনি প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীকে কাজ না দিলে তাদের বসে বসে ‘মাছি মারা’ আর বেতন নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
অবশ্য যদি স্বাধীনভাবে কাজের জন্য প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। এ যেন বাণিজ্যিক অফিসের মতো অবস্থা। যেমন গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরের সম্পর্ক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের সম্পর্ক। এসব ক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতার মালিক হচ্ছেন প্রধান নির্বাহী। বাকিরা আজ্ঞাবহ মাত্র, যদিও অফিসে অফিসে ‘ডেলিগেশন অফ পাওয়ার’ করা থাকে। এটা কথার কথা। বাস্তবে কোনো প্রতিষ্ঠানেই প্রধান নির্বাহী তার ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চান না। এর নামই ‘পাওয়ার’। খুব কম প্রধান নির্বাহীই দ্বিতীয়জনকে ক্ষমতা ‘ডেলিগেট’ করেন। সর্বত্র ভয়-ভীতি।
আমার ধারণা, বর্তমান মন্ত্রিসভাতেও সাধারণভাবে এটাই ঘটছে। হয়তো তার প্রতিফলনই আমরা দেখলাম শিল্প প্রতিমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারে। তিনি ক্ষোভেই হোক, অভিমানেই হোক, বাস্তব অবস্থা বোঝানোর জন্যই হোক, তার বক্তব্য জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন। এটুকু পর্যন্ত বোঝা গেল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তিনি শুধু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি; তিনি মন্ত্রীদের ‘সিন্ডিকেটের’ কথা বলেছেন। এটা তো ভীষণ কথা! এতদিন আমরা পণ্যভিত্তিক সিন্ডিকেটের কথা শুনেছি, ব্যাংকিং ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের কথা শুনেছি। শুনেছি আমলাদের মধ্যকার সিন্ডিকেটের কথা। শুনেছি অর্থনীতিতে সিন্ডিকেটের কথা। এখন প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বলছেন মন্ত্রীদের ‘সিন্ডিকেটের’ কথা। তিনি শুধু একথা উল্লেখ করেননি, বাস্তব কতগুলো ঘটনার কথাও উল্লেখ করেছেন।
পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের কথা বলতে গিয়ে তিনি সারের সিন্ডিকেটের কথা উল্লেখ করেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রীকে পরোক্ষভাবে উদ্দেশ করে কিছু কথা বলেছেন। অবশ্য শুধু এসব কথা বলেননি, তিনি ছোট ছোট ব্যবসা কীভাবে বড় বড় করপোরেট নষ্ট করে দিচ্ছে তার কথা বলেছেন। কীভাবে ঋণ কুক্ষিগত হচ্ছে, তার কথা উল্লেখ করেছেন। ‘এসএমই’ ঋণ পাচ্ছে না, তার কথা উল্লেখ করেছেন। আমলারা কীভাবে তাদের জায়গায় স্বৈরতন্ত্র চালু করছেন, তার কথা বলেছেন। এমনকি ধর্মীয় ব্যক্তিরাও যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ভেজাল, কারসাজি, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলেন না, তা আক্ষেপ করে উল্লেখ করেছেন।
ডলার সংকটের পেছনেও যে রয়েছে সিন্ডিকেট, তাও প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন। এক কথায় বলা যায়, সমসাময়িককালের বাস্তবতা তার সাক্ষাৎকারে প্রকাশ পেয়েছে। এদিকে পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায় না, তাও তিনি বলেছেন। সাহায্যের অর্থ কোথায় যায়, তাও জানা যায় না। হুন্ডিওয়ালারা অপ্রতিরোধ্য, এ কথা বলেছেন। সব মিলে দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রীরা অসহায়, অপারগ, দর্শক। এমনকি পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তারা অসহায় অথবা সহায়ক শক্তি। নিজের দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ। সিন্ডিকেটের কাছে তারা অসহায়। শিক্ষা নিশ্চিতকরণে, সরকারি পণ্য সুষ্ঠুভাবে বিতরণে তারা অসহায়। বলা বাহুল্য, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা যা বলেছেন, তা সাধারণ মানুষেরই কথা। তাদের মনের কথা।
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, দেশে সব ক্ষেত্রে ‘সিন্ডিকেট’ কাজ করছে। অর্থনীতি, বাণিজ্য, রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে। ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে ‘সিন্ডিকেট’ নতুন করে তৈরি হয়েছে। আমলারা ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি করে ফেলেছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিভিন্ন পেশাজীবীও নানাভাবে সিন্ডিকেটভুক্ত হয়ে পড়েছে। এমন একটা অবস্থাকে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন ‘সরকারের ভেতরে সরকার’। তারা সরকারকে এগোতে দিচ্ছে না। পরিকল্পনামন্ত্রীর কথা থেকে মনে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসব বোঝেন; কিন্তু তাকেও সমঝোতা করে চলতে হচ্ছে। কারণ ভোট দরকার। অতি সত্য কথা।
কথা হচ্ছে, এ অবস্থা তো একদিনে সৃষ্টি হয়নি। ধীরে ধীরে আমরা এমন একটা অবস্থায় উপনীত হয়েছি। আমরা বর্তমানে এমন একটা সংসদে উপনীত হয়েছি, যেখানে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদেরই প্রাধান্য। শুধু সংসদে নয়, মন্ত্রিসভারও একই অবস্থা। গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দখলে। ঢাকা মহানগরীর এক বড় অংশের নেতৃত্বেও বড় ব্যবসায়ী। দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে ব্যবসায়ীরা আর রাজনৈতিক দলকে সেভাবে চাঁদা দেন না, ‘ফিনান্স’ করেন না। এর বদলে তারা নিজেরাই রাজনীতিক। ‘ফুল টাইমার’/নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক কর্মীদের জায়গা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা দখল করে নিয়েছেন।
আবার রাজনীতিকরাই ‘বিগ বিজনেসে’র মালিক, ব্যাংকের মালিক। শিল্প প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার ঢাকা শহরে রাজনীতির বয়স ৫০ বছর। আমি দেখেছি অনেকে ব্রিফকেস নিয়ে ঘুরত, অনেকের কাছে টাকা ছিল না, অন্যের কাছে সিগারেট চেয়ে খেত-আজ তারা ব্যাংকের মালিক হয়েছে। আমি মনে করি, যারা সরকারি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকের মালিক হয়েছেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত তাদের নামগুলো প্রকাশ করা।’
এর থেকে কী বোঝা যায়? বোঝা যায়, অতি গরিবরাও প্রচুর টাকার মালিক হয়েছে, ব্যাংকের মালিক হয়েছে। শুধু ব্যাংক নয়; বিমা, লিজিং কোম্পানি এবং বিভিন্ন খাতের বড় বড় ব্যবসায়ীদের অনেকেরই একই ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’। তারাই আজ ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি করে দেশে কর্তৃত্ব করছে। অবশ্য আমি টাকা কামানোকে দোষণীয় কিছু মনে করি না। দশ পয়সার লোকও ‘বিলিয়ন বিলিয়ন’ টাকার মালিক হয়েছে। তা হতে পারে, কোনো আপত্তি এতে দেখি না। তবে কথা আছে। প্রতিযোগিতা, দক্ষতা, মেধা, উদ্যোক্তা গুণের বদৌলতে কেউ টাকা কামালে তাকে ‘সালাম’ দেওয়া দরকার। কিন্তু আমাদের হতভাগা দেশে কারা টাকা বানাচ্ছে?
বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করতে হয়। তিনি চারদিকের চুরি-চামারি দেখে ১৯৭২-৭৩ সালেই বলেছিলেন, ‘আমার কম্বলটা গেল কোথায়?’ বলা বাহুল্য, তখন বিদেশ থেকে বহু কম্বল পাওয়া গিয়েছিল সাহায্য হিসাবে। এ নিয়ে চলে চুরি-চামারি। সেই যে শুরু, তার কোনো সমাপ্তি নেই। মনে হয়, অনেকটা রাষ্ট্রীয় নীতির আনুকূল্যেই এটা ঘটে চলেছে। রাষ্ট্রের প্রভাবশালী একটা মহল মনে করে, কিছু লোকের হাতে টাকা ধরিয়ে দিতে হবে। তারাই ওই টাকা বিনিয়োগ করবে। দেশের শিল্পায়ন তারাই করবে। জিডিপি বাড়বে, কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু ফল হচ্ছে উলটো। নানা অসৎ উপায়ে টাকা বানিয়ে তারা দেশত্যাগ করছে। সাম্প্রতিক ঠিকানা শোনা যাচ্ছে আবুধাবী, দুবাই। এরাই ‘সিন্ডিকেটের’ মালিক। তারা এখন ‘ডলার’ কবজা করে সংকট তৈরি করছে। তাহলে উপায়? উপায়ের কথা আমার জানা নেই।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
