Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে প্লাস্টিক

Icon

ড. মো. ইকবাল সরোয়ার

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে প্লাস্টিক

আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের মানব-পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৫ জুনকে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। পরিবেশগত বিষয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ১৯৭৪ সাল থেকে নিয়মিতভাবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য-‘প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে শামিল হই সকলে’। প্লাস্টিক হলো কৃত্রিমভাবে তৈরি পলিমার, যা মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে রাসায়নিকভাবে তৈরি করা হয়। আলেকজান্ডার পার্কস ১৮৫৫ সালে সর্বপ্রথম প্লাস্টিক আবিষ্কার করে এর নাম দেন পার্কেসিন। পরে লিও বেকল্যান্ড ১৯০৭ সালে সম্পূর্ণ সিনথেটিক প্লাস্টিক আবিষ্কার করে নাম দেন বেকেলাইট এবং তিনিই প্রথম প্লাস্টিক শব্দটি ব্যবহার করেন। ব্যবহারের বহুমুখিতা, সহজে উৎপাদন হওয়া, সুলভ ইত্যাদি কারণে আবিষ্কারের পর থেকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্লাস্টিক। নানাবিধ ব্যবহারে জীবনযাত্রা সহজ করেছে যে প্লাস্টিকপণ্য, তা এখন পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।

আমরা নিত্যব্যবহার্য প্লাস্টিকের অধিকাংশ একবার ব্যবহার করে ফেলে দিই, যা জলজ প্রাণী, খাদ্য চেইন, এবং মানবজগতের জন্য এক বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ খাল, নালা, পুকুর, নদী হয়ে পরিত্যাক্ত প্লাস্টিকের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হলো সমুদ্র। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিষ্ট্রেশনের গবেষণায় দেখা যায়, মুদি দোকানের পণ্য ব্যবহার করা প্লাস্টিক ব্যাগ মাটিতে মিশতে সময় লাগে প্রায় ২০ বছর; চা, কফি, জুস তথা কোমল পানীয়ের প্লাস্টিক কাপের ক্ষেত্রে সময় লাগে ৫০ বছর; অন্যদিকে ডায়াপার ও প্লাস্টিক বোতল অপচন অবস্থায় প্রকৃতিতে বিদ্যমান থাকে প্রায় ৪৫০ বছর।

প্লাস্টিক দূষণ হলো পরিবেশ কর্তৃক প্লাস্টিক বর্জ্যরে আহরণ, যা পরে সামুদ্রিক ও বন্যপ্রাণীসহ তাদের আবাসস্থল, জল, স্থল এবং সর্বপোরি মানবগোষ্ঠীর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। গত ৫০ বছরে পৃথিবীতে মাথাপিছু এক টনের বেশি প্লাস্টিক পণ্য উৎপন্ন করা হয়েছে। এসব অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্যরে ১০ শতাংশ আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হলেও অবশিষ্ট ৯০ শতাংশ পরিবেশকে নানাভাবে বিপন্ন করে তুলছে প্রতিনিয়ত। উল্লেখ্য, অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে ৪০০ বছর থেকে প্রায় ১০০০ বছর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকতে পারে, যা প্রতিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। প্লাস্টিক দূষণকে আকারের ওপর ভিত্তি করে মাইক্রো, ম্যাক্রো ও মেসো এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। আকৃতিগত কারণে এগুলো দ্রুত পরিবেশের সঙ্গে মিশে দূষণের সৃষ্টি করে। প্লাস্টিক মাইক্রোকণাগুলো সহজে ও নিয়মিতভাবে মানুষসহ প্রাণীর খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে পানিচক্রের মাধ্যমে আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করছে। এভাবে ন্যানো প্লাস্টিক উদ্ভিদ ও প্রাণীর কোষের ভেতর অবস্থিত ডিএনএ ও আরএনএ অণুর মধ্যে মিউটেশন ঘটিয়ে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। প্লাস্টিক অপচনশীল পদার্থ হওয়ায় পুনঃচক্রায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটি পরিবেশে বিদ্যমান থাকে।

শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাপনের একটি পণ্য হিসাবে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার দিনদিন বাড়ছে। শহর এলাকায় মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীববৈচিত্র্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। খাবার, দৈনন্দিন বাজার, শপিং, সুপারশপ, অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রতিটি পণ্যে ও মোড়কে দিন দিন ব্যবহার বাড়ছে প্লাস্টিকের, যার ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ।

প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন ও দূষণে চীনের অবস্থান শীর্ষে। বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ৮ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, এর মধ্যে ৩৬ শতাংশ পুনঃচক্রায়ণ, ৩৯ শতাংশ ভূমি ভরাট এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ সরাসরি আমাদের পরিবেশে দূষক হিসাবে যোগ হচ্ছে। সিঙ্গেল ইউজ বা একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন ব্যাগ প্লাস্টিক বর্জ্যরে মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক। কারণ এসব প্লাস্টিকের যত্রতত্র ব্যবহার এবং ক্রটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার ফলে খাল, নদী ও নালার স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যার ফলে দেখা যায় জলাবদ্ধতা সমস্যা। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বাংলাদেশের চারটি প্রধান বিভাগীয় শহর ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেটের ওপর বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপম্যান্ট অর্গানাইজেশন পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে তরুণ ও যুবকরা প্লাস্টিক দূষণের জন্য বেশি দায়ী। ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সিরা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ৬৮ শতাংশ ব্যবহার করছে। যেসব খাবারের সঙ্গে প্লাস্টিক রয়েছে, সেগুলোর সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী হচ্ছে তরুণ ও যুবকরা।

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপন্ন হয়। এসব বর্জ্য রিসাইকেল হয় না বলে বছরের পর বছর নালা, খাল, বিল তথা প্রকৃতিতে বিরজমান থেকে যায়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২০২১ সালের বর্জ্যবিষয়ক রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন খাল হয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭৮৫ টন বর্জ্য প্রতিনিয়ত মিশছে বাংলাদেশের লাইফলাইন খ্যাত কর্ণফুলী নদীতে, যার অধিকাংশই পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্লাস্টিক ও পলিথিন। ফলে কর্ণফুলী নদী দূষণের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে এর গভীরতা, যা নদীর জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কর্ণফুলী নদীতে ২০১৮ সালের ড্রেজিংয়ের সময় ৪৮ লাখ ঘনমিটার বালুযুক্ত মাটি উত্তোলন করা হয়, এর মধ্যে ২২ লাখ ঘনমিটার ছিল পলিথিনযুক্ত বালুমাটি।

দেশে ২০০২ সালে আইন করে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে দেশে প্রায় ১২০০ কারখানায় পলিথিন তৈরি হচ্ছে এবং এগুলোর অধিকাংশই রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। আমাদের মাত্রাতিরিক্ত প্লাস্টিকনির্ভরতার ফলে দেখা যাচ্ছে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ তারা রয়েছে, সমুদ্রে প্লাস্টিকের পরিমাণ তার থেকেও বেশি।

এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, আমরা প্রতি মিনিটে প্রায় ১০ লাখ প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের পর ফেলে দিচ্ছি এবং এভাবে সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিক ব্যাগের বর্জ্য তৈরি করছি। সমুদ্রের পানিতে পাঁচ ট্রিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক ভেসে থাকে এবং প্রতিবছর ১৪ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক প্রতিনিয়ত সমুদ্রে জমা হচ্ছে। সমুদ্র থেকে আহরিত প্রতি তিনটি মাছের মধ্যে একটি মাছের পেটে প্লাস্টিকের দ্রব্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য একক সর্বাধিক হুমকিস্বরূপ, যা সামুদ্রিক মৎস্য, কচ্ছপ, তিমি ও সামুদ্রিক পাখির খাদ্য ও জীবন প্রণালিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিক দূষণের ফলে প্রতিবছর ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি ও ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু তিমি ও মাছের মৃত্যুর পর তাদের পাকস্থলীতে প্লাস্টিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বলেছেন, সমুদ্রে বর্তমানে ৫.২৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রো ও ম্যাক্রো প্লাস্টিকের কণা জমা হয়েছে। প্রতি বর্গমাইল সমুদ্রে রয়েছে ৪৬ হাজার প্লাস্টিক কণা এবং সমুদ্রে প্রতিদিন জমা হচ্ছে ৮০ লাখ টুকরা প্লাস্টিক। এসব প্লাস্টিক কণা মানুষ ও অন্য জীবের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে নানাবিধ দুরারোগ্য রোগের সৃষ্টি করে। প্লাস্টিক বর্জ্য এমন একটি ক্ষতিকর পদার্থ, যা পরিবেশের সঙ্গে মিশতে অথবা পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে দীর্ঘসময় প্রয়োজন। এর ফলে এটি পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় প্লাস্টিক দূষণ রোধে সচেতন নাগরিক হিসাবে আমাদের সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন-দৈনন্দিন বাজারের ক্ষেত্রে একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিনের পরিবর্তে কাপড় অথবা পাটের ব্যাগের বাধ্যতামূলক ব্যবহার; দুগ্ধ ও পানীয়জাতীয় দ্রব্য বহনে প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাচের বোতল ব্যবহার; গৃহস্থালি পর্যায় থেকেই প্লাস্টিক ও পলিথিনজাতীয় বর্জ্য পৃথক করা; প্লাস্টিক দূষণ ব্যবস্থাপনায় প্রণীত আইন ও বিধিমালাকে হালনাগাদ ও সময়োপযোগী করা; লন্ড্রিতে কাগজের ব্যাগ চালু করা; পাটের ব্যাগের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে ও খরচ কমাতে পাটের উৎপাদন বাড়ানো; নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনকারী, বাজারজাতকারী ও ব্যবহারকারীদের আইনের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা; প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস, পুনর্ব্যবহার, বর্জনের ক্ষেত্রে নাগরিকদের সচেষ্ট হওয়া এবং যত্রতত্র প্লাস্টিক না ফেলে এর ব্যবহার ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা।

ড. মো. ইকবাল সরোয়ার : সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

iqbalsrwr@cu.ac.bd

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম