বিএনপি কি আওয়ামী লীগের বিকল্প?
সুভাষ সিংহ রায়
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
২০০৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একাধিক জাতীয় দৈনিকে একটি লেখা প্রকাশ করেছিলেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
সম্ভবত ওটাই তার নামে ছাপানো এখন পর্যন্ত শেষ লেখা। ‘ডানপন্থির বামে, বামপন্থির ডানে’ শিরোনামে লেখা ওই নিবন্ধের বড় একটি অংশজুড়ে বিএনপির উত্থান ও রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। যার একপর্যায়ে অকপটে স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পুরোভাগে ছিল আওয়ামী লীগ।
তবে সঙ্গে এ-ও লিখেছেন, ‘দেশ স্বাধীন করলেও দেশের উপযোগী রাজনৈতিক দল হিসাবে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থতার পটভূমিতেই বিএনপির জন্ম।’ লেখাটি শেষ হয়েছে এভাবে-‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলই এ দেশের মূলধারা, বিএনপিই বাংলাদেশের জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের ওই লেখার ১৪ বছর পর সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি আমাদের সামনে এসেছে তা হলো-এক. ‘আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায়’ (খালেদা জিয়ার মতে) জন্ম নেওয়া বিএনপি কি আসলেই কখনোই আওয়ামী লীগের বিকল্প ছিল, নাকি হতে পেরেছে বা পারবে? দুই. একের পর এক বিদেশনির্ভরতা, গণতন্ত্রের অন্যতম বড় উপাদান নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নিজেদের ‘মূলধারার দল ও জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান’ দাবি করে বিএনপি কি তার রাজনৈতিক চরিত্র হারাচ্ছে না?
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধ সামনে রেখে জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেন। এতে একদিকে সাবেক মুসলিম লীগসহ ইসলামপন্থি বিভিন্ন দলের নেতাদের তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন, অন্যদিকে চীনপন্থি বাম নেতাদেরও জায়গা করে দেন।
‘ইসলামি মূল্যবোধ সামনে রেখে বিএনপির রাজনীতি শুরু’ এ কারণে যে, মুক্তিযুদ্ধের পর জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল; জিয়ার বহুদলীয় গণতন্ত্রের আড়ালে যা আবার চালু হয়। যুদ্ধাপরাধী জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজনীতি করার সুযোগে বাড়ে সাম্প্রদায়িকতা। দেশ হয় অস্থিতিশীল।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান বিএনপির আগে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল বা ‘জাগদল’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। কিন্তু জাগদল রাজনৈতিক দল হিসাবে জনগণের মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর ঠিক দুই মাসের মাথায় ১ মে সমমনা দল ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে গঠন করেন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট।
১৯৭৮ সালের ২৮ আগস্ট ‘জাগদল’ বিলুপ্ত করে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন দল হিসাবে বিএনপির গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচি ঘোষণা করেন জিয়াউর রহমান। এ সময় ১৯ দফার একটি কর্মসূচিও ঘোষণা করেন জিয়া; যার প্রথম দফা ছিল-‘সর্বোতভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা।’
গত এক যুগের কর্মকাণ্ড হিসাব কষলে দেখা যাবে, দীর্ঘ এ সময়ে বিএনপি কখনো রাজনৈতিক উপায়ে নিজ পায়ে দাঁড়ায়নি। রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় একের পর এক বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে। স্বভাবতই তারা বাংলাদেশের প্রথাগত রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে বিএনপির সরে দাঁড়ানো। একটি বিষয় লক্ষ করলে দেখা যাবে, দল সরে দাঁড়ালেও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ২৯ জন বিএনপি নেতাকর্মী এবার নির্বাচনটির কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
প্রার্থী হওয়ার পরপরই তাদের সবাইকে দল থেকে আজীবন বহিষ্কারও করা হয়েছে। তবুও এর মধ্য থেকে ১১ জন নেতা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। ২৯-এ ১১ জন; অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশের বেশি। যে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয় না বছরের পর বছর, স্থায়ী কমিটির বৈঠক বসে মাঝে মাঝে, সেই দলের সমর্থিত প্রার্থীরা এত ভোট পেলেন কীভাবে? অন্যসব কারণের সঙ্গে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে’-এটাও নিশ্চয়ই বড় কারণ।
আরেকটি বিষয়, যদি জরিপ করা হয়, তাহলে বোঝা যাবে-যে কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা আগ্রহী। কারণ, নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের শক্তি ও সক্ষমতার জানান দিতে চান এবং এ সরকারের অধীনে যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয় না-সেই বার্তাটিও দিতে চান।
কিন্তু বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে বরাবরই বলা হয়েছে, স্থানীয় নির্বাচনেও নেতাকর্মীরা অংশ নিতে পারবেন না। তারপরও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে অনেকে ভোটে প্রার্থী হচ্ছেন, ভোট তো দিচ্ছেনই। তাহলে ঘোষণা দিয়ে বিএনপির নির্বাচনে যেতে সমস্যা কোথায়?
নির্বাচন বর্জন কিংবা প্রতিরোধ গণতন্ত্রের ভাষা না হলেও এ সংস্কৃতি বিএনপির পুরোনো। অতীত রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাবে, ২০১৪ সালে তারা জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। শুধু বর্জন বললে ভুল হবে, জামায়াতকে নিয়ে তারা নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা পর্যন্ত করেছিলেন।
কিন্তু পারেননি। ধরে নিলাম, নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি তার সরকার পতনের চিরাচরিত এক দফা আন্দোলনে যেতে চায়; গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলতে চায়। এটাও যদি তাদের এজেন্ডা হয়, তাহলে এর প্রতিফল কোথায়! না আছে তাদের মাঠ কর্মসূচি, আর না আছে সাংগঠনিক শক্তিশালী ভিত্তি। আমাদের সরল প্রশ্ন-আন্দোলনে অংশ না নিয়ে দলটি তাহলে কোন পথে রাজনীতিতে টিকে থাকতে চায়? আর কোন পথেই বা ক্ষমতায় যেতে চায়?
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে কোথাও কোনো অনিয়ম চোখে পড়েনি। এমন সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নিতেও যখন তাদের আপত্তি দেখা যায়, তখন বাস্তবিক অর্থেই প্রশ্ন জাগে, দলটির আসলেই জনসমর্থন আছে কিনা? সবচেয়ে বড় কথা, বহুদিন ক্ষমতায় থেকেও যে দল উন্নয়নের দৃশ্যমান কোনো উদাহরণ তৈরি করতে পারেনি, সেই দলকে মানুষ কোন আশায় বিশ্বাস করবে? আর তারা কীভাবেই বা আওয়ামী লীগের বিকল্প হবে?
লেখার শুরুতে একটি প্রশ্ন করেছিলাম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিএনপি কি আসলেই কখনো আওয়ামী লীগের বিকল্প হতে পারে? বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না, আওয়ামী লীগ এখনো এ দেশে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৮ সালে এর জন্ম হয়েছিল শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে। রাজনীতি যে গণমানুষের, সেটা বারবার প্রমাণ দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ।
আর এ কারণেই এ দলে যেমন উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত আছে, তেমনি আছে লাখ লাখ নিুমধ্যবিত্ত-বিত্তহীন নেতাকর্মী। স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী বাংলাদেশের নানা পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিয়েছে এ আওয়ামী লীগ। এখনো এই দল বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতিকে ধারণ করে থাকে। নিয়মিত কেন্দ্রীয় কমিটি হয়। গঠনতন্ত্র মোতাবেক সময়মতো কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের তাগিদ দেখা যায়।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গণদেবতা’ যারা পড়েছেন, তাদের মনে পড়বে সেখানে একটি সংলাপ আছে-‘সেকালের কিছু আর রইল না। কিন্তু আমরা জনাকতক মানুষ যে সেকালের মানুষ অকালের মতন পড়ে রয়েছি একালে, বিপদ যে সেইখানে।’ এখন যখনই আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শের কথা বলা হবে, তখন নতুন আগত সদস্যদের অনেকেরই কাছে মনে হতে পারে কথাগুলো অতি সেকেলে।
মহাত্মা গান্ধী একবার ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, যেদিন কংগ্রেসে গুন্ডামি, ভন্ডামি দলে জায়গা পাবে, সেদিন সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করব। মাহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই, ঢাকার আরমানিটোলার বাদশা গুন্ডা আওয়ামী লীগের জনসভা পণ্ড করতে এসেছিল। মুসলিম লীগ তাকে এ কাজের জন্য পাঁচশ টাকা দিয়েছিল।
কিন্তু বাদশা গুন্ডা শেখ মুজিবের নেতৃত্বের ইন্দ্রলিক জালে ধরা পড়েছিল। সভা তো পণ্ড করেইনি; বরং জনসভার ভেতরে দাঁড়িয়ে মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়েছিল। পাঁচ টাকার নোটগুলো (পাঁচশ টাকা) জনসভার ভেতর ছুড়ে মেরেছিল।
যে দলের আদর্শ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেই দলের শক্তি-সামর্থ্য বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া টানা কয়েক দশক ধরে দলের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। এ কারণেও এ দলের অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক সমৃদ্ধ। আজও শেখ হাসিনা সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে পরিশ্রমী রাজনৈতিক নেতা। লিডারশিপ হঠাৎ করে বিকশিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় ভিশন, পরিকল্পনা ও দক্ষতা, যা অতীত আওয়ামী লীগের ছিল, বর্তমান আওয়ামী লীগেও আছে।
এত এত অর্জন যে দলের ঝুলিতে; সেই দলের বিপরীতে দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামোর দল কীভাবে আওয়ামী লীগের বিকল্প হয়! তাছাড়া টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে দল ও সরকার আওয়ামী লীগ এখন অত্যন্ত সুদৃঢ়। মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে একদিকে যেমন দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও শেখ হাসিনা এখন অতি প্রশংসনীয় একজন প্রধানমন্ত্রী। ফলে গণতন্ত্রের সোজা পথ ছেড়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বিএনপির কতটা পূরণ হবে-সে উত্তর সহজেই অনুমান করা যায়।
সুভাষ সিংহ রায় : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
