|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পৃথিবীতে এখন গতি নিয়ে কথা হচ্ছে। জাতিসংঘ একটি সপ্তাহ পালন করেছে, সেখানে তাদের স্লোগান ছিল ‘Kill Speed, Not Lives’. এর মানে হচ্ছে, গতিকে মার কিন্তু মানুষকে নয়।
গতি খুবই বিপজ্জনক। আমরা যদি গুলি বা রিভলবারের গুলির কথা বলি-এ গুলিটা কিন্তু অনেক ছোট। এটা যদি আস্তে কারও গায়ে ছুড়ে মারেন, তাতে কেউ কিন্তু আহত হবে না বা মারাও যাবে না।
অথচ ওই ছোট গুলির জন্যই কিন্তু মানুষ মারা যায়। কেন মারা যায়? কারণ হলো গতি। রিভলবার থেকে যখন গুলিটি বের হয় তখন এর গতি থাকে প্রচণ্ড। এ কারণে গুলিটি ছোট হলেও মানুষ আহত হয় কিংবা মারা যায়। এরপর দেখা যায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাতাসের গতি যখন ১০০/১৫০/২০০ কিলোমিটার অতিক্রম করে, তখন আবহাওয়া অফিস মহাবিপদ সংকেত জারি করে। ঝড় যেখানে ১৫০/২০০ কিলোমিটার বেগে যায়, সেখানে মহাবিপদ সংকেত দেওয়া হয়। ঝড়ে ‘বৃষ্টি আর বাতাস’ এ দুটির বেগের কারণে বিপদ সংকেত দেওয়া হয়। বৃষ্টি বা বাতাস এগুলো কিন্তু লোহার কোনো বস্তু নয়, এরপরও এখানে এই বেগের কারণে মহাবিপদ সংকেত দেওয়া হয়। এখন ভেবে দেখুন সড়কে যখন লোহার একটি বস্তু অর্থাৎ একটি গাড়ি যখন ১০০/১৫০ কিলোমিটার বেগে চলে এবং এই বেগে যদি সেই গাড়ি কাউকে আঘাত করে তাহলে কি অবস্থা দাঁড়াতে পারে? সেখানে বাঁচার কিন্তু কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। এ কারণে বলা হচ্ছে গতি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ। বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় এ গতির কারণে।
অতিরিক্ত গতিতে যখন কোনো গাড়ি চলাচল করে তখন রাস্তায় দুই পাশে কোনো কিছু ঠিকমতো দেখা যায় না। খুব দ্রুত পাশের বস্তুগুলো পার হয়ে যায়। যদি কোনো মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, সে এখন দৌড় দেবে কি হাঁটবে-এসব বিষয় কিন্তু ঠিকমতো লক্ষ করা যায় না। যে কারণে দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
সরকারিভাবে যে আইন করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, বিআরটিএ গতি নির্ধারণ করবে। কেউ যদি গতি লঙ্ঘন করে তাকে জরিমানা করা হবে। কিন্তু কোন্ সড়কে কত গতি, কোন্ গাড়ির কত গতি থাকবে বা থাকবে না, এর কোনো গাইডলাইন সেখানে নেই। আমরা এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিশেষ করে বিআরটিএ’র সঙ্গে বসেছি। সরকার সবাইকে নিয়ে বসে এ গাইডলাইন তৈরির কাজ করছে এবং এর দায়িত্ব বুয়েটের অজও (Accident Recherch Institute)-এর কাছে দেওয়া হয়েছে। আমরাও তাদের সঙ্গে কাজ করছি। সেই সঙ্গে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর পক্ষ থেকে চালকদের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বোঝাচ্ছি গতি আমাদের জন্য, সড়কের জন্য কতটা ক্ষতি করে। আমরা যদি গতিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে গাড়ি চালাতে পারি তাহলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমে আসবে।
দেশে এত অবকাঠামো হচ্ছে, মেট্রোরেল হচ্ছে-এরপরও দুর্ঘটনা রোধে কতটা সফল হতে পারছি আমরা? পারছি না। উন্নয়ন হলেও সুদূরপ্রসারী চিন্তা না থাকার কারণে এক্ষেত্রে উত্তরণ ঘটাতে পারছি না। সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে জাতিসংঘ যে পাঁচটি পিলারের কথা বলেছে, তা মেনে সুইডেন কিন্তু তাদের দুর্ঘটনার হার ০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। কোনো কোনো দেশ ৯০ শতাংশ, কোনো দেশ ৮০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে দুর্ঘটনার হার। আমরা কেন কমাতে পারছি না? কারণ হলো, আমাদের প্রথম থেকেই সেই ধারণাটাই ঠিকমতো ছিল না। আমাদের ধারণা ছিল, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের করণীয় কিছু নেই। এটা আল্লাহর হাতে আছে। মানুষের ভাগ্যে লেখা থাকে দুর্ঘটনা, অনেকে বলে ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’-এমন ধারণা ছিল সবার। এজন্য অনেক সময় আমি বলি-আমরা একটি দেশ পেয়েছি কিন্তু দেশ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা সে সময় আমাদের ছিল না। যে কারণে সঠিক পরিকল্পনার অভাব ছিল। ফলে আমাদের কী করণীয় সেটা নিয়ে সংসদেও বলতে শুনেছি, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের কোনো হাত নেই। এটি আল্লাহর হাতে।’ এ থেকে বোঝা যায়, দেশ পরিচালনার বিষয়টা আমরা এখনো শিখছি। এই শিখতে শিখতে মাঝখান থেকে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। আমাদের চিন্তা-চেতনার স্পিড এখনো বাড়েনি। আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি না।
যেমন পুরান ঢাকার নবাবপুর রোডটি একসময় অন্য রোডগুলোর তুলনায় একটু বড় ছিল। সেটা নিয়ে অনেকে সমালোচনা করেছে, এত বড় রোড অযথা কেন করা হয়েছে। এ কারণে দেখবেন, ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় সড়কগুলো কিন্তু ছোট ছোট। কারণ তখন তারা ভাবেনি আজ সড়কে ১০টা গাড়ি চলছে, ১০ বছর পর কয়টা চলবে। সে গাড়ি চলার জন্য আগাম কোনো ব্যবস্থা করা আছে কিনা। এই যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, সেই দৃষ্টিটা যদি আমাদের না থাকে, তাহলে আমরা উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত জায়গাটায় পৌঁছতে পারব না কখনোই। সুতরাং সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনা। জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সেইফটি সিস্টেম অ্যাপ্রোচ’ মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।
এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে জাতিসংঘের দেওয়া প্রথম ডিকেড আমরা ফেল করেছি, এখন দ্বিতীয় ডিকেডটি যেন ফেল না করি, সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। জাতিসংঘ কর্তৃক যে ডিকেড ঘোষণা করা হয়েছে তা হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সড়ক দুর্ঘটনার হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। তার মধ্যে জাতিসংঘের দেওয়া পাঁচটি পিলার ও পাঁচটি ‘রিক্স ফ্যাক্টর’ চিহ্নিত করা হয়েছে। এ জায়গাগুলো ধরে ধরে কাজ করতে হবে। এর ভেতর অগ্রাধিকার দিতে হবে গতিকে। কারণ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিকল্পনা তথা চিন্তার গতিকে দ্রুত বাড়াতে হবে এবং সড়কের গতিকে দ্রুত ম্যানেজমেন্টের আওতায় আনতে হবে। গতিকে ম্যানেজমেন্টের ভেতর রেখে পরিচালনা করতে হবে। এ চিন্তাগুলো এখন আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সড়কের বিভিন্ন রকম চরিত্র আছে। কোন্ সড়কে গাড়ি কত গতিতে চলবে সেটি যেমন নির্ধারণ করতে হবে, তেমনি যানবাহনের প্রকারভেদেও গতি নির্ধারণ করে দিতে হবে। সড়কের ব্ল্যাকস্পট বা দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলোকে ট্রিটমেন্টের আওতায় এনে সংশোধন করে যানবাহন যেন নির্বিঘ্নে নিরাপদে সঠিক গতিতে চলতে পারে সে ব্যবস্থা করে দিতে হবে এবং এটির জন্য উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারে, এ বিষয়গুলো তুলে ধরে দেখিয়ে দিতে পারে; কিন্তু উন্নয়নের যে গতিতে বাংলাদেশ আছে, সে গতি ধরে রাখতে হলে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
কারণ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বছরে যে জিডিপি ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষতি যদি সড়কে না হতো তাহলে দেশ আরও উন্নয়ন হতো, মানুষের জীবনমান আরও উন্নত হতো। সড়ক দুর্ঘটনাকে এ কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়ে কাজ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দ্রুত সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ গতি এখন সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ। পাশাপাশি গাড়ির ফিটনেস, চালকের দক্ষতা, মোটরসাইকেলে হেলমেট ব্যবহার, চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট ব্যবহার, শিশুদের জন্য আসন ব্যবস্থা-এসব বিষয় নিয়েও কাজ করতে হবে।
ইলিয়াস কাঞ্চন : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, নিরাপদ সড়ক চাই; চলচ্চিত্র অভিনেতা
