দেশে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ
ড. মতিউর রহমান
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৭০-এর দশকের প্রথমদিকে এদেশে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়। বস্তুত কৃষিক্ষেত্রে রূপান্তরের মাধ্যমে ‘সবুজ বিপ্লব’ ঘটাতে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়, যার লক্ষ্য ছিল উচ্চফলনশীল শস্যের জাত, উন্নত সেচব্যবস্থা ও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাস করা। এ সময়ে সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাদের সহায়তায় দেশে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি চালু করার জন্য কর্মসূচি শুরু করে।
এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, কম্বাইন হারভেস্টার এবং অন্যান্য কৃষি সরঞ্জাম আমদানি ও বিতরণ। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক ছিল ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) প্রতিষ্ঠা। বিএডিসি যন্ত্রপাতি আমদানি, ভর্তুকি প্রদান এবং কৃষকের সুবিধার্থে ঋণ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গত কয়েক বছরে দেশে, বিশেষ করে প্রধান প্রধান কৃষি অঞ্চলে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার, কৃষিপ্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি খাত বিভিন্ন কর্মসূচি, প্রশিক্ষণ, উদ্যোগ এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে। লক্ষণীয়, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং কৃষিব্যবস্থায় এর গ্রহণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে একধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ক্ষুদ্র কৃষক, যারা কৃষি কর্মশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, তারা প্রায়ই আধুনিক যন্ত্রপাতিতে প্রবেশাধিকার ও সামর্থ্যরে ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন।
আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার দেশের কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। যেমন ট্রাক্টর, কম্বাইন হার্ভেস্টার এবং সেচব্যবস্থা কৃষিকাজের কার্যকারিতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। এ মেশিনগুলো কৃষকের কাজকে দ্রুত ও কার্যকরভাবে সম্পন্ন করতে সহায়তা করে, যার ফলে ফলন বৃদ্ধি পায় এবং শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়। এটি খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। এটি মানব শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে। যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে চাষ দেওয়া, বীজ বপন, ফসল কাটা এবং সেচের মতো কাজগুলো স্বল্প সময়ে এবং কম শ্রমিক দিয়ে সম্পন্ন করা যায়। এটি কৃষকের আয় এবং সামগ্রিকভাবে জীবিকার সুযোগ বৃদ্ধি করে।
আধুনিক তথা উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতি চাষাবাদকে অনেকাংশে নির্ভুল করে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাক্টরে জিপিএসভিত্তিক নির্দেশিকা সিস্টেমগুলো সুনির্দিষ্ট রোপণ ও নিষিক্তকরণে সক্ষম করে, ইনপুট অপচয় হ্রাস করে এবং ফসলের গুণমান উন্নত করে। উপরন্তু, যন্ত্রপাতি কীটনাশক ও ভেষজনাশক প্রয়োগে সহায়তা করে, পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে আরও কার্যকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে।
ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এবং কৃষিপণ্যের গুণগত মান রক্ষার জন্য ফসল-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যন্ত্রপাতি, যেমন শস্য শুকানোর যন্ত্র এবং পর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা ফসল কাটার পর অপচয় কমাতে সাহায্য করে। এটি কৃষককে সর্বোত্তম সময়ে তাদের পণ্য সংরক্ষণ ও বিক্রিতে সহায়তা করে, যার ফলে বেশি লাভ হয় এবং খাদ্যের অপচয় কম হয়। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির সঙ্গে উন্নত দক্ষতা, উচ্চ উৎপাদনশীলতা এবং খরচ সাশ্রয় কৃষকের আয়বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস এবং সম্পদের ব্যবহার অপ্টিমাইজ করার মাধ্যমে কৃষক উচ্চফলন এবং কম উৎপাদন খরচ নিশ্চিত করতে পারে।
আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার কৃষি খাতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে। এটি বিদ্যমান যন্ত্রপাতি উন্নত করতে, স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী নতুন যন্ত্রপাতি তৈরি করতে এবং টেকসই চাষাবাদের উপায় খুঁজে বের করার গবেষণা ও উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে উদ্দীপিত করে। এ সবকিছু দেশের কৃষি খাতের সামগ্রিক অগ্রগতি ও প্রতিযোগিতায় অবদান রাখতে পারে।
আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি গ্রহণের জন্য কৃষককে নতুন দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করতে হবে। যন্ত্রপাতি পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করার ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এ প্রযুক্তিগত দক্ষতা তাদের ক্ষমতায়ন করবে, যা তাদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বাড়াবে এবং কৃষি কর্মশক্তিতে অবদান রাখবে।
যদিও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি দেশের কৃষি খাতে অনেক সুবিধা নিয়ে এসেছে, তবে এসবের ব্যবহারের কিছু নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ দেশের ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যয়বহুল হতে পারে। এটি এ প্রযুক্তিগুলোতে প্রবেশাধিকার এবং গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একটি বাধা তৈরি করে, যার ফলে বড় ও ছোট কৃষকের মধ্যে কৃষি পদ্ধতি ও উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির জন্য প্রায়ই জ্বালানি, খুচরা যন্ত্রাংশ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন হয়। সম্পদ-সীমাবদ্ধ এলাকায় কৃষক এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে, যার ফলে যন্ত্রপাতি ব্যবহারে ব্যাঘাত ঘটতে পারে এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেতে পারে। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার পরিবেশগত বিরূপ পরিণতির কারণ হতে পারে। ভারী যন্ত্রপাতি, যেমন-ট্রাক্টর মাটির সংকোচন ঘটাতে পারে, যার ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায় এবং ক্ষয় ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
কীটনাশক ও সারের মতো রাসায়নিক ইনপুটগুলোর ব্যবহার যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করা না হয়, তাহলে তা পরিবেশ দূষণ আরও তীব্র করতে পারে। উপরন্তু, যন্ত্রপাতি থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব রাখে। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি গ্রহণের ফলে কৃষিকাজে কায়িক শ্রমের স্থানচ্যুতি ঘটতে পারে, যদিও এটি কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। এটি গ্রামীণ বেকারত্বের কারণ হতে পারে, বিশেষ করে কৃষি শ্রমিকের মধ্যে যারা তাদের জীবিকার জন্য কায়িক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। বিকল্প কর্মসংস্থানের সন্ধানে শহরাঞ্চলে অভিবাসনসহ এর আর্থসামাজিক প্রভাব পড়তে পারে।
আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার প্রচলিত হওয়ার ফলে কৃষকের মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভরতা তৈরির ঝুঁকি রয়েছে। যদি কৃষকের যন্ত্রপাতি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব থাকে, তাহলে তারা বাইরের পরিষেবা প্রদানকারীদের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে, ফলে তাদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা হ্রাস পেতে পারে। উপরন্তু, প্রজন্মের মধ্যে একটি দক্ষতার ব্যবধান দেখা দিতে পারে। কারণ বেশি বয়সি কৃষকের তুলনায় অল্প বয়স্ক কৃষক আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও মেরামতে আরও পারদর্শী হতে পারে। যন্ত্রপাতির আকার ও নকশা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে এর ব্যবহারযোগ্যতা সীমিত করতে পারে, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় এর কার্যকারিতা ও গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যেমন, কিছু আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি বড় আকারের সমতল কৃষিব্যবস্থার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের ছোট ও পাহাড়ি খামারের জন্য কম উপযোগী।
এ নেতিবাচক প্রভাবগুলো মোকাবিলা করা এবং উপযুক্ত নীতি ও সহায়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রভাবগুলো হ্রাস করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতিতে প্রবেশাধিকার উন্নত করার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি। উপরন্তু, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি সম্পর্কে প্রচার, সঠিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো হ্রাস করতে এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে।
ড. মতিউর রহমান : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
