চরিত্র কেড়ে নিল আমার সন্তানের
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এমন কজন বাবা-মা আছেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে পাঠান অমানুষ হওয়ার জন্য? কে চান উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে তার আদরের সন্তান চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী হোক; সহিংস দাপট দেখাক সতীর্থ বন্ধুদের সামনে; খুনি-মাস্তান হয়ে কলঙ্কিত করুক পরিবারকে? কিন্তু আমাদের ক্ষমতার রাজনীতিকরা-যে দল যখন ক্ষমতাবান হতে চেয়েছে-নেতারা নিজ দলের ঝাণ্ডা ধরিয়ে দিয়েছেন দলীয় ছাত্ররাজনীতিতে নাম লেখানো তরুণদের হাতে; সব অপকর্মের দীক্ষা দিয়েছেন। আর নিজেরা নিরাপদ দূরত্বে বসে রিমোট কন্ট্রোল হাতে ক্যাম্পাসে তরুণদের তাণ্ডব নাচ নাচাচ্ছেন। নষ্ট করে দিচ্ছেন সম্ভাবনাময় তরুণদের চরিত্র। এভাবে দলীয় দখলদারি বজায় রাখছেন। তাদের দেওয়া চাবির জোরে চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী, লুটেরা হচ্ছে আমার সন্তান। আর নিজেরা সুবেশে, নরম গদিতে বসে, ঠান্ডা হাওয়া খেয়ে লুটের টাকার হিস্যা গুনে নিচ্ছেন। এরাই যখন মঞ্চশোভিত কথা বলেন, এসব দলীয় ছাত্রের সামনে রেখে গুণকীর্তন করেন, তখন মনে হয় না তারা কেউ বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত। সাধারণ মানুষের রক্তক্ষরণ হয় আর তারা হাততালি দেন।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা এ লেখাটির উপলক্ষ্য। তবে এ বিষয়ে পরে আসছি। ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় ইতিহাসকে এখন সেয়ানা নেতারা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে নষ্ট রাজনীতির বেসাতি করছেন ক্যাম্পাসে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে আসা আমার সন্তানদের চরিত্র নষ্ট করে দিচ্ছেন। আর নির্বোধ ছেলেমেয়েরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করছে-সমাজের চোখে কলঙ্কিত হচ্ছে।
প্রায় চল্লিশ বছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থেকে এমন সব ঘৃণ্য রাজনীতির খেলা দেখেছি আর বিপন্ন হতে দেখেছি সন্তানদের। এখনো চোখ বন্ধ করলে আনন্দ কুমার ঘোষের মুখচ্ছবি ভাসে। একটি তরুণের ক্যাম্পাসে আসা অতঃপর উত্থান-বিকাশ ও ধ্বংস চোখের সামনে দেখতে হলো। তবুও ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের লোভের থাবা একইভাবে বিস্তৃত হচ্ছে।
১৯৯৭ সালের কথা। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকাল তখন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বরাবর ক্ষমতাশীলদের একাধিপত্য থাকে। অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতায় যে দল থাকে, সে দলের ছাত্ররাজনীতির নেতাকর্মীরা থাকে দাপুটে অবস্থায়। আনন্দ ঘোষ বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেধাবী ছেলে। ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিল। ক্ষুদ্র দোকানি বাবার সাধ্য নেই ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে। স্থানীয় মানুষের আর্থিক সহযোগিতায় সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। আমি তখন মওলানা ভাসানী হলের ওয়ার্ডেন। এ হলের আবাসিক ছাত্র হয়েছিল সে। ওর আর্থিক অবস্থার কথা জেনে ওকে ডাইনিংয়ে দুবেলা ফ্রি খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। প্রথম বছরটি ভালোই কাটল আনন্দের। পরীক্ষাগুলোয় মেধার স্বাক্ষর রাখছিল। এরপর জানলাম হলের ছাত্রলীগের নেতারা তাকে দলে ভিড়িয়েছে। গ্রাম থেকে আসা সহজসরল মেধাবী ছেলেটির মধ্যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে লাগল। হলে বিচার আসতে লাগল আনন্দের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে রাজনীতির হাওয়ায় নিজেকে বেশ ক্ষমতাশালী মনে করছে সে। মারধরের ঘটনায় নায়ক হয়ে যাচ্ছে। শাস্তি দিয়ে নানাভাবে বুঝিয়ে পথে ফেরাতে পারছিলাম না। আবিষ্কার করলাম, এ দরিদ্র ছেলেটির পোশাকে পরিবর্তন আসছে। দামি প্যান্ট, শার্ট, জুতা পরছে। একদিন দেখলাম স্বর্ণের চেন গলায় চকচক করছে। আমি অবাক হয়েছি এই ভেবে যে, আনন্দ এখন ছাত্রলীগের পাতি কর্মী। ওর কাছে চাঁদার টাকার ভাগ আসার কথা না। এতসব পাচ্ছে কোথায়? অচিরেই ধোঁয়াশা কেটে গেল।
এক কাকডাকা ভোরে প্রভোস্ট মহোদয়ের ফোন এলো। তার ভবনে কষ্ট করে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। আমরা হলে যারা কাজ করি, তারা ঘরপোড়া গরু। অসময়ে ফোন এলে ভাবি কোনো গণ্ডগোল হয়েছে। আমি তড়িঘড়ি পোশাক পালটে প্রভোস্ট ভবনে গেলাম। ড্রইং রুমে দেখলাম কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক বসে আছেন। পরনে জীর্ণ পোশাক। গালভরা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। প্রভোস্ট মহোদয় পরিচয় করিয়ে দিলেন ইনি আনন্দ ঘোষের পিতা। পুত্রের কাণ্ডে সন্দিহান হয়ে পিতা রাতের গাড়িতে ছুটে এসেছেন। ছেলের আব্দার মেটাতে দেওয়ালে ঠেকে গেছে তাদের পিঠ। একেকবার বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো পোশাক না পরলে মান থাকে না। সরল মা খোঁয়াড়ের মুরগি, ডিম, আনাজপাতি বিক্রি করে নিজেরা খেয়ে না খেয়ে ছেলে আব্দার মেটান। গেলবার তার চাহিদা একটি স্বর্ণের চেন। না হলে নাকি সম্মান যায় যায়। মা পালিত ছাগল বিক্রি করে ছেলের হাতে টাকা তুলে দেন। আর ভাবেন কটা মাত্র দিন। বড় অফিসার হয়ে সব দুঃখ ঘোচাবে আনন্দ।
খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি আনন্দের পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হচ্ছে। আর রাজনীতিতে হচ্ছে উন্নতি। পাতি কর্মী থেকে একসময় বড় কর্মীতে পরিণত হয় সে। আশ্বাস পেয়েছে, সামনে কোনো পদ পেয়ে নেতা হয়ে যাবে। এর মধ্যে একদিন ক্যাম্পাসে দুপক্ষের ছাত্রদের মধ্যে তুমুল মারামারি হলো। এক নিরাপত্তা কর্মীর কাছে জানলাম, আনন্দের হাতে নাকি আগ্নেয়াস্ত্র উঠে এসেছে। সেই সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয় আনন্দ। হাসপাতালে কয়েকদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যায় ছেলেটি, তার মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ হলো না।
এসব তুচ্ছ ঘটনা আমাদের রাজনীতির নায়কদের স্পর্শ করে না। তারা ক্যাম্পাসে দখলদারি বজায় রাখতে আমার সন্তানদের লাঠিয়াল বানাতে থাকেন। ওদের বানাতে থাকেন লোভী তস্কর। ২০০২ সালে আমি শহিদ সালাম বরকত হলের প্রভোস্ট হই। বিএনপি আমল তখন। আমি এ হলের ওয়ার্ডেন ছিলাম। বিএনপি দলীয় উপাচার্য একরকম বাধ্য করেন প্রভোস্টের দায়িত্ব নিতে। শুনেছি বিএনপিদলীয় অনেক শিক্ষক অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন নির্দলীয় কাউকে প্রভোস্টের দায়িত্ব দেওয়ায়। এ হলটি রাজনৈতিক দিক থেকে ছিল জটিল। দলমতনির্বিশেষে ছাত্রদের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে ভিসি মহোদয়ের বিশ্বাস ছিল আমি সফল হব। তাই তিনি দল বিবেচনা করেননি। প্রথম প্রথম দলীয় ছাত্র ও শিক্ষকদের অনেক বিরোধিতা আমাকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। পরে এমন হয়েছিল, বহুবার আবেদন করেও আমি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাইনি। মাঝখান থেকে দুবার ভিসি বদল হয়েছে, কিন্তু আমার মুক্তি হয়নি। প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ না করে টানা সাত বছর আমাকে প্রভোস্ট থাকতে হয়।
এ সময় রাজনীতি করা ছাত্রদের নষ্ট হয়ে যাওয়াটা প্রত্যক্ষ করেছি। নির্মাণকাজের টেন্ডার থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি চলে ক্যান্টিনে। এমনকি হলের গেটে জুতা সেলাই করা মুচিও এসে বিচার দেয় কাজ করিয়ে পয়সা দিচ্ছে না ছাত্রদলের কোনো কোনো নেতাকর্মী। পয়সা চাইলে চড়-থাপ্পড় জোটে।
এসব হচ্ছে চরিত্র নষ্ট হওয়া ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত থাকা আমার সন্তানদের স্বরূপ। আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, ওরা তো কোনো ভদ্র পরিবার থেকেই এসেছে। পরিবার কি জানে সন্তান বা আদরের ভাইবোন ক্যাম্পাসে এসে বখে গেছে; ডাকাত-ছিনতাইকারী-চোর-বাটপাড় হয়ে গেছে? কিন্তু এমনিতে তো ওদের স্খলন ঘটেনি। শোনা যায়, ছাত্রদল, ছাত্রলীগের হল বা ক্যাম্পাস কমিটিতে পদ পেতে হলে বড় অঙ্কের চাঁদা দিতে হয় উপর মহলে। ছাত্ররা এত অর্থ পাবে কোথায়! ফলে তাদের চাঁদাবাজ হতে হয়। উপরের চাহিদা মিটিয়ে নিজেদেরও তো দল চালাতে অর্থ লাগে। থাকা দরকার বলার মতো ব্যাংক ব্যালেন্সও। এভাবে চরিত্র নষ্ট করতেই হচ্ছে।
এবার সাম্প্রতিক প্রসঙ্গটিতে চলে আসি। গত ২৬ ও ২৭ জুলাই অনেক জাতীয় দৈনিকে লজ্জাজনক খবরটি ছাপা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগের নেতারা আরিচা সড়কে চলা অনেক লেগুনা জব্দ করে ক্যাম্পাসের ভেতরে হলের সীমানায় রেখে দিয়েছে। প্রথমে অত গা করিনি। কারণ, অনেক সময় অ্যাক্সিডেন্ট করলে বা পরিবহণ শ্রমিকরা কোনো ছাত্রের ওপর চড়াও হলে গাড়িঘোড়া আটকের জব্দের ঘটে। পরে মধ্যস্থতা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এবার একটু অন্যরকম মনে হলো। দুদিন ধরে জব্দ লেগুনার সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল কর্তৃপক্ষ নীরব। লেগুনার শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়ে আছে। এ পরিবারগুলোর দুর্ভোগ কাউকে স্পর্শ করে না। ওরা জটলা করে বসে আছে লেগুনার আশপাশে। জব্দের দ্বিতীয় দিন বিকালে ব্যাপারটি বোঝার জন্য লেগুনার এক শ্রমিককে আস্থায় এনে জানতে চাইলাম। ওর কাছ থেকে যা জানলাম, পরে পত্রিকার রিপোর্টে তা-ই দেখতে পেলাম। আমার হল পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এ এক নতুন ধাক্কা। আমার সন্তানদের চরিত্র এতটা নষ্ট করা হয়েছে বুঝতে পারিনি। এতদিন জানতাম পরিবহণ থেকে চাঁদাবাজি করার অধিকার শুধু শ্রমিক সমিতি, মালিক সমিতি আর পুলিশের। পরিবহণ শ্রমিকরা বলে থাকেন থানার সঙ্গে আমাদের ‘মান্থলি’ করা আছে। আমাদের আটকাবে না। এখন এ ধারার চাঁদাবাজিতে নেমে গেছে আমার রাজনীতির তকমা আটা ছাত্ররা। এতদিন নাকি ছাত্রলীগের ছেলেদের লেগুনাপ্রতি দৈনিক ২৫ টাকা দিতে হতো। এতে মাসে এক-দেড় লাখ টাকা আয় হতো। এখন পোষাচ্ছে না। এদেশের নিত্যপণ্যের বাজারের মতো শ্রীমানরাও লম্ফ দিয়েছে। ২৫-এর বদলে এখন ১০০ টাকা দিতে হবে। এতটা সাধ্য নেই লেগুনা মালিক-শ্রমিকদের। তাই তারা চাঁদা দেওয়া বন্ধ করেছে। এ অপরাধে লেগুনা জব্দ।
ছাত্রনেতারা মুখ রক্ষা করতে সাংবাদিকদের যা বলেছে তা হাস্যকর। হল প্রশাসনের বক্তব্যও থানা পুলিশের মতো। তাদের কাছে নাকি কোনো পক্ষ অভিযোগ করেনি। দুদিন ধরে যে তাদের হল এলাকায় লেগুনার মিছিল জমা হয়েছে, তা কারও চোখে পড়েনি? ক্যাম্পাসের এ রটনাটিই তাহলে ঠিক? প্রকৃত অর্থে হল চালায় নাকি ছাত্রনেতারা। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীরবতা দেখে মনে হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বোধহয় এখন ছাত্রনেতারা পরিচালনা করে।
ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একজন ছোটখাটো কর্মী ছাত্রকে প্রশ্ন করি, তোমাদের এত টাকা লাগে কেন? ও অবলীলায় বলল, আমরা আর কটাকা পাই স্যার। কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা এবং দলীয় বড় নেতারাও এসব ভাগ নিতে বসে থাকেন। আমি আঁতকে উঠি। প্রার্থনা করলাম, ওর এ কথাগুলো যাতে ভুল প্রমাণিত হয়।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
