শতফুল ফুটতে দাও
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য একটি বিরল ঘটনা। একদিকে যখন জাতীয় নির্বাচনের প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে এবং যে কোনো সময় একটি রাজনৈতিক বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, তখন আমরা দেখলাম জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সরকারি ও বিরোধী দল ঐকমত্য পোষণ করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্বোধন করেছেন। এর আগে ১০ মে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ‘ভিশন-২০৩০’ উপস্থাপন করেছিলেন। ‘ভিশন-২০৩০’ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ৪৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বেসরকারি খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য বার্ধক্যের দুর্দশা লাঘবের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে একটি পেনশন ফান্ড গঠন করা হবে। প্রবীণদের শেষ বয়সের দিনগুলোতে দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য প্রতি মাসে পেনশন দেওয়া হবে। বেসরকারি খাতে নিয়োজিত প্রত্যেকের আয়ের নির্দিষ্ট অংশ এ ফান্ডে জমার ভিত্তিতে পেনশন ফান্ডটি গড়ে তোলা হবে এবং এর জন্য ন্যায্য হারে মুনাফা প্রদান করা হবে। সক্রিয় কর্মজীবনের শুরু থেকে কর্মী জীবনের অবসান পর্যন্ত এ ফান্ডে অর্থ জমা রাখা যাবে। প্রয়োজনীয় বিধি মোতাবেক এ ফান্ডের সদস্যকে ফান্ড থেকে ঋণ দেওয়া হবে। এ ফান্ডের অর্থ উন্নয়ন অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগ করা যাবে।’
অনলাইন সূত্রে জানা যায়-‘বর্তমান সরকারের চালু করা সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ১৮ বছরের বেশি বয়সি যে কেউ চাঁদা দিয়ে পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আসতে পারবেন। সর্বজনীন পেনশন সুবিধা বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো চালু হলো। সরকারিভাবে পেনশন স্কিমের ব্যবস্থাপনা করা হবে। দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে চালু করা হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৬০ বছরের বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ এবং ২০৪১ সালে তাদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩ কোটি ১০ লাখ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিু আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।’
সর্বজনীন পেনশন প্রকল্প সম্পর্কে অধ্যাপক আবু আহমেদ মন্তব্য করেছেন, ‘লক্ষ কোটি টাকা যদি পেনশন ফান্ডে জমা পড়ে, সেই অর্থ হবে সরকারের জন্য হিসাববিজ্ঞানের পরিভাষায় দায়। দায় যদি সম্পদে রূপান্তর না হয় তাহলে একটা সময় পেনশন কর্তৃপক্ষ দায় নিয়ে জনগণের যারা পেনশন ফান্ডে অনেক বছর ধরে চাঁদা দিয়েছে, তাদের পাওনা মেটাতে পারবে না। পেনশনে প্রদেয় চাঁদা হবে পাবলিক ফান্ড বা জনগণের অর্থ। এ অর্থকে সরকারের আয় (রেভিনিউ) হিসাবে দেখা যাবে না। এ অর্থের মালিক যারা চাঁদা দিয়েছে তারা এবং তারা ভবিষ্যতে বর্ধিত আকারে আয় পাবে ভেবেই আজকে ওই ফান্ডে চাঁদা দেবে। এখানে ফান্ডের নিরাপত্তার বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ ভাবে, সরকার থেকে বেশি নিরাপত্তা অন্য কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা তাদের প্রদেয় ফান্ডের ক্ষেত্রে দিতে পারবে না। সে জন্য এ ফান্ডে চাঁদা অনেকেই দিতে চাইবে। অবসরে বা ৬০ বছর পর একটু আর্থিক নিরাপত্তা কে না চায়?
অধ্যাপক আবু আহমেদ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের বিষয়টি আমাদের নজরে এনেছেন। একটি নতুন ধরনের আর্থিক কর্মকাণ্ডের চ্যালেঞ্জগুলো যদি যাত্রাকালেই চিহ্নিত করা যায়, তাহলে এর চেয়ে ভালো কিছু হবে না। যারা পেনশন স্কিমের চাঁদা দেবেন তারা সঠিক আশাটাই করবেন। চাঁদার পিরিয়ড পার হওয়ার পর প্রতিশ্রুত লাভসহ প্রদত্ত চাঁদা ফেরত পাবেন। বাংলাদেশে যারা সরকারি চাকরি করেন, চাকরিজীবনের শেষে তারা হয়রানিমুক্তভাবে তাদের পেনশনের অর্থ ফেরত চান। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরকারের নানা প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও চাকরিজীবনের শেষে নানা রকম বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। পেনশনকে কেন্দ্র করে নানা রকম দুর্নীতিও হয়। সারাজীবন নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে অবসরে যাওয়ার পর পেনশনের ফয়সালা হতে যদি কয়েক বছর লেগে যায়, তাহলে এ পেনশন অবসরভোগীর জন্য সেভাবে কাজে আসবে না।
আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমটি চালু হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা গেছে। এ ধরনের স্কিম জনপ্রিয় হবে এমনটা আশা করা বেঠিক কিছু নয়। রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে এ ধরনের একটি স্কিম মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগাবে, এমনটি আশা করা হয়েছে; কারণ, এ রকম একটি স্কিমের পক্ষে সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষেরই সমর্থন রয়েছে। তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এ স্কিমটি কতটা নিরাপদ এবং হয়রানিমুক্ত। কোটি কোটি মানুষের নামে পৃথক হিসাব খোলা, সেটি স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করা এবং ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত কিস্তি দিয়ে কোনো ঝামেলা ছাড়াই পেনশন পাওয়া যাবে-এসব নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন পড়েছে ৫০ হাজার। চাঁদা জমা হয়েছে ৩ কোটি টাকারও বেশি।
নিয়মানুযায়ী, কারও বয়স ১৮-৫০ বছরের মধ্যে হলে অনলাইনে এই স্কিমে নিবন্ধন করা যায়। সুবিধাভোগীর বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি হওয়ার পর আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করা যাবে। ন্যূনতম ১০ বছর চাঁদা দেওয়া সাপেক্ষে এ সুবিধা পাওয়া যাবে। প্রশ্ন হলো, মুনাফাসহ পেনশনের অর্থ পরিশোধ করতে হলে সরকারের দায় হিসাবে জমা হওয়া এ অর্থ ভালো বিনিয়োগ হিসাবে ব্যবহৃত হতে হবে। যে কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারি খাত ও বেসরকারি খাতের কিছু দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা থাকে। সরকারি খাতে দুর্নীতিপ্রবণতা একটি সাধারণ সমস্যা। চাঁদার হিসাব-নিকাশ নিয়ে মতপার্থক্য হলে স্কিমের পরিচালক অথবা তাদের অধস্তন কর্মচারীরা অক্টোপাসের মতো চাঁদা প্রদানকারীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে পারে, এমন বিপদ অস্বীকার করা যায় না। সর্বোপরি দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা পাওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট নেতিবাচক মনোভাব আছে। ব্যক্তি খাতে ব্যবসা বা বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করা। এজন্য ব্যক্তি বিনিয়োগকারী তার অর্থ সর্বাধিক মিতব্যয়িতার মধ্য দিয়ে ব্যবহার করে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় খাত কিংবা সরকারি খাতের লক্ষ্য হলো ব্যুরোর সর্বাধিক ব্যয় নিশ্চিত করা। জনগণের অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে আমলারা অর্থের নয়-ছয় করতে অভ্যস্ত। তারা ক্লায়েন্টদের কল্যাণের কথা ভাবতে চায় না। ফলে পুরো বিষয়টি একটি হতাশার জন্ম দেয়। এমন সব আশঙ্কার মুখে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এখনো নিজের নামে স্কিমটি চালু করার সাহস করছেন না সাধারণ মানুষ। তারা ভয় করেছেন, পেনশনের টাকা তোলার জন্য সরকারি অফিসে ছুটতে ছুটতে আর ঘুস দিতে দিতে আসল টাকাটাই থাকবে না। এ কারণে মানুষের ভোগান্তি হওয়ার সব আশঙ্কাকে শুরুতেই নিশ্ছিদ্র করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা অভয় দিয়ে বলেছেন, পেনশন পেতে দীর্ঘসূত্রতা বা হয়রানির কোনো সুযোগ নেই, কারণ সব গ্রাহকের কাছ থেকে কিস্তি সংগ্রহ এবং পেনশন দেওয়ার সব ধরনের লেনদেন অনলাইনে সম্পন্ন হবে। সেটাও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। কিস্তিদাতার বয়স ৬০ বছর হওয়ার পর তার ব্যাংক হিসাবে অথবা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে মাসিক পেনশন পৌঁছে যাবে বলে আশ্বস্ত করেছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।
তবে গত ক’বছর ধরে মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর খরচের বহর আমাদের মোটেও আশ্বস্ত করে না, নৈরাশ্য আমাদের ঘিরে ধরে। বিভিন্ন মেগা উন্নয়ন প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে বা হচ্ছে, তা অন্যান্য দেশে একই ধরনের প্রকল্পের ব্যয়ের তুলনায় দুই-তিন গুণ। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কিছুতেই সময়সীমা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রকল্পগুলো বড় দায় সৃষ্টি করছে। পেনশন স্কিম থেকে প্রাপ্ত অর্থের সার্বিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে না পারলে বড় রকমের বিপদে পড়তে হবে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, স্কিমটি চালু হওয়ার পর আবেদনপত্র জমা পড়েছে ৫০ হাজারের মতো। প্রশ্ন উঠেছে, কিস্তি বাবদ যে অর্থ পাওয়া যাবে, তার তহবিল ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, কীভাবে এবং কোথায় পেনশন তহবিল বিনিয়োগ হবে, লভ্যাংশ কীভাবে বণ্টন করা হবে? এসব সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এখনো অন্ধকারে রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা পেনশন তহবিলের অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করছেন। এসব ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা সুখদায়ক নয়। কারণ সরকারি বা আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থ অব্যবস্থাপনায় নষ্ট হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। সুতরাং শতকরা ১০০ ভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে পেনশন তহবিলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, যারা ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করে, তাদের পক্ষে কিস্তি প্রদান কখনো কখনো সম্ভব নাও হতে পারে। যদি ইনফরমাল সেক্টরের লোকজনকে এ স্কিমের আওতাভুক্ত না করা যায়, তাহলে স্কিমের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটাই হারিয়ে যাবে। তাই ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করেন এমন কেউ যদি ঘটনাচক্রে কিস্তি পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে তাদের কল্যাণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায় তার জন্য বিধিবিধান থাকতে হবে। আমরা আশা করব, জাতীয় পেনশন স্কিমটি দেশের অন্যান্য এ জাতীয় স্কিমের তুলনায় অনেক বেশি সফল হবে। এ ধরনের স্কিম সরকার পরিবর্তন হলেও অব্যাহত থাকবে, এমন নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
