Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

হেরে যাওয়া মানুষদের জয়

Icon

পবিত্র সরকার

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হেরে যাওয়া মানুষদের জয়

পবিত্র সরকার। ছবি: সংগৃহীত

আমি নিজে কি জয়ীদের দলে? আমি কি কখনও হারিনি? জয় আসলে কাকে বলে? পৃথিবীতে এত এত লোক জয়ের কত চিহ্ন বহন করে বেড়ায়। কেউ হাজার কোটির মালিক (বৈধ বা অবৈধভাবে), নিজের প্লেন বা ইয়টে ঘুরে বেড়ায়, সুইটসারল্যান্ডে ভিলাতে গ্রীষ্মকাল কাটায়, হাজার সুন্দরীর আসঙ্গ পায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুরা ও খাদ্য যার টেবিলে সাজানো হয়- সে কি জয়ী? কিংবা সে কি সুখী?

আমার মতো পাতি মধ্যবিত্ত এই বহুলাংশে অলীক ভাবনা ভেবে খুশি হতে পারে যে, সে লোকটা আসলে দুঃখী, কিংবা ওর জয় চূড়ান্ত জয় নয়। আমি যে জয় পাইনি, জীবনে পাব না, আর মানুষের এই একমাত্র গ্রহে পূর্বাপরহীন একটাই তো মাত্র জীবন- সেখানে এই খুশি যে মূর্খের বিলাস, সে কে না জানে? কিংবা যে ইনকাম ট্যাক্স অফিসার ঘুষের কয়েক কোটি টাকা বাড়িতে লুকিয়ে ভেবেছিল সে অনেক মানুষের ওপর টেক্কা দিয়েছে- এনফোর্সমেন্ট যখন তাকে ধরল তখন তার জয় এক লহমাতে কোথায় পৌঁছল?

সে আমাদের করুণা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, কিন্তু কী বিতিকিচ্ছি জঘন্য ব্যাপার, আমাদের মতো অনুকম্পাযোগ্য লোকেরা তাকে করুণা করার স্পর্ধা দেখাচ্ছে। কার জয় হল তাহলে? আমাদের জয় কি একই সঙ্গে পরাজয়ও বটে! সে কি সব সময় এক দ্ব্যর্থকতা বহন করে চলে?

তাই আমার মনে হয়, জয় আর হার কোনোটাই চূড়ান্ত নয়, দুটোই বেশ আপেক্ষিক ঘটনা। প্রথমত, সময়ের দিক থেকে। আজ যে জিতছে কাল সে হারতেই পারে, আবার পরশু দিন সে জিততেই পারে। খেলাধুলার পৃথিবীতে প্রায়ই এটা ঘটে।

উইলিয়াম্স বোনেরা বা রজার ফেডারার বা নাদাল বা বাংলাদেশের ক্রিকেট দল পিংপং বলের মতো আজ জিতছে কাল হারছে, আজ আমরা তাদের মাথায় তুলছি তো কাল বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি গালাগাল দিচ্ছি। একজন প্রত্যেকবার জিতবে, চিরকাল জিতবে- এ কি কখনও হতে পারে, না হয়েছে! এমন হতেই পারে যে দীর্ঘদিন ধরে জিতে চলেছে, দাবাড়ু ববি ফিশারের মতো বা মুষ্টিযোদ্ধা মহম্মদ আলির মতো, কিন্তু তাকেও একসময় দাবার বোর্ড বা হাতের দস্তানা নামিয়ে রাখতে হয়; কোনো এক পরাজয়ের পরেই বুঝিবা, বলতে হয়, আর নয়।

আমার জেতার পালা শেষ হয়েছে, এবার শুধু জয় নয়, জয়ের ইচ্ছা থেকেও ছুটি নিতে চাই। তা কি তবে পরাজয়? এবার সমস্ত জয় তার কাছে শুধু স্মৃতি হয়ে থাকবে, আর কিছু নয়। জয়ের স্মৃতি, আর জয়ের তপ্ত, উত্তেজনার্ঘমাক্ত, চনমনে অভিজ্ঞতা কি এক? যে দুর্যোধন লোকটা এমন স্পর্ধা করে বলেছিল, ‘আজ আমি জয়ী’- তার জয় শেষ পর্যন্ত কোথায় গেল? হিটলার কি ভেবেছিল তার জয় কখনও পরাজয় হয়ে তাকে গ্রাস করবে?

শেলির একটি কবিতা, Oyymandias, অনেকেই নিশ্চয়ই পড়েছেন। কবি বলছেন এক পথিকের কথা- মরুভূমির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে যে পথিক দেখেছিল বিশাল পাথরের এক বেদির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে দুটি দেহহীন পাথুরে পা, আর একটু দূরেই পড়ে আছে একটি কুঞ্চিতঠোঁট, স্পর্ধিত মূর্তির মাথা। আর বেদিন সামনে লেখা আছে এ কথাগুলো, পরে পথিকের মন্তব্যসহ-

‘My name is Oyymandias, king of kings:

Look on my works, ye Mighty, and despair!’

Nothing beside remains. Round the decay

Of that colossal wreck, boundless and bare

The lone and level sands spread far away.

জয়ের দ্বিতীয় আপেক্ষিকতা তার অবস্থানে। তুমি জয়ী, কিন্তু কার তুলনায় কতটা জয়ী? তুমি কি জয়ের রেকর্ড সংগ্রহ করেছ- পৃথিবীতে তোমার জয়কে ম্লান আর উপহাস করতে পারে এমন কি কোনো জয়ী ছিল না, নেই? যদি থেকে থাকে, তাহলে তোমার জয় কি একরকমের হারও নয়? তোমার জয় তো সীমাবদ্ধ, অঞ্চলিক, সাময়িক! তুমি তো ‘আন্তর্জাতিক সংগীতে’র কথাকে ঘুরিয়ে বলতে পারো না, ‘ছিনু সর্বহারা, আজ সর্বজয়ী’।

আমি বহু আমন্ত্রণ পাই স্কুলের পরীক্ষায় যারা ভালো করেছে তাদের পুরস্কার দেয়ার অনুষ্ঠানে। ‘কৃতী ছাত্রছাত্রী’দের কথা বলা হয়। আমি তাদের অভিনন্দন জানিয়েও বলি, এই কৃতিত্বের অনেকটাই তো আকস্মিক। তুমি ‘সাজেশন’ করে পড়লে- আগেরবারের প্রশ্ন বাদ দিয়ে; হলে গিয়ে দেখলে তোমার বাছাইগুলো এসেছে, তোমার চেয়ে লেখাপড়ায় ভালো যে বন্ধু, তার বাছাইগুলো আসেনি। তুমি জয়ী হলে, তোমার বন্ধু পরাজিত হল।

তোমরাই বলো, এই জয়-পরাজয়ের কি কোনো মানে হয়? চারদিকে লেখালেখির জন্য কত পুরস্কার দেয়া হয়- কথাই আছে ‘পুরস্কার জয়’, ইংরেজিতে winning an award। সব পুরস্কার ঠিক ঠিক লোক পায়? কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘পুরস্কারের একটা স্বভাবই হল ভুল ঠিকানায় চলে যাওয়া।’ বিচারকদের কাছে কত রকমের প্ররোচনা থাকে। ওই জয়কেও আমরা জয় বলব? মিথ্যা জয়ে ভরে গেছে পৃথিবী, রাষ্ট্রের নির্বাচন থেকে সংগঠনের নির্বাচন পর্যন্ত।

আমি নিজেকে দিয়ে জয়-পরাজয়ের একটা হিসেব বোঝার চেষ্টা করি। আমি কি নিজেকে জয়ী মনে করি- এই আশি বছর বয়স পার হয়ে? কই, আমার তুলনায় কত বেশি বেশি সফল (জয়ী) লোক পৃথিবীতে গিজগিজ করছে- বিদ্যায়, বিত্তে, ক্ষমতায়, খ্যাতিতে, সুযোগে, সৌন্দর্যে, জীবনধারণে, জনপ্রিয়তায়। আমি তো তাদের কাছে কেউ না, কিছু না। তাদের জয় সত্য হতে পারে, মিথ্যা হতে পারে।

কিন্তু আমি কি তবে এই দুঃখ নিয়ে বসে থাকব যে আমি হেরে বসে আছি, ঘরের কোণে বসে নিজের ক্ষতের রক্ত চাটব? আমার কি চোখে পড়ে না সেসব সঙ্গীর কথা, যারা প্রাণপণ চেষ্টা করেছে আমার মতো কোথাও একটা পৌঁছানোর, তারপরে ভাঙা বুক নিয়ে চলে গেছে, এমন কিছুর কাছে হেরে যার কাছে কেউ জয়ী হতে পারে না। তার নাম মৃত্যু। আমি কি ভুলে যাব সেই হাজার হাজার কৃষকের কথা, যারা ফসলের দাম না পেয়ে সরকারের ঋণ শোধ করতে না পেরে নিয়মিত আত্মহত্যা করে চলেছে এই দেশে (ভারত), কোনো কোনো মন্ত্রী (ভারতীয়) যাকে ‘ফ্যাশন’ বলেছেন?

আমি তো ভুলতে পারি না পাড়ার সেই ছেলেটির কথা, যে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন থেকে, নিছক বেকার হয়ে রইল বলে, আস্তে আস্তে কীরকম অস্বাভাবিক হয়ে গেল, নিজেকে প্রত্যাহার করে নিল কেমন, শরীরে মেদ জমল, জামাকাপড় ময়লা থেকে ময়লাতর হতে হতে একদিন ছেঁড়াখোঁড়া হয়ে গেল, তার চোখ দুটো নিষ্প্রাণ আর অর্থহীন হল একদিন। তারপর তাকে দেখতাম রাস্তার ধারে একটা দোকানের টুলে বসে ঝিমোচ্ছে, যেন পৃথিবী যেমন, তেমনি সে নিজেও তাকে বাতিল করে দিয়েছে।

হ্যাঁ, আমি জানি, পরাজয় কারও কারও স্বেচ্ছানির্বাচন হতেই পারে- তার ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত আছে- মহাভারতের মহাবীর কর্ণ, নাকি বলব রবীন্দ্রনাথের কর্ণ- যে বলেছিল, ‘যে পক্ষের পরাজয় সে পক্ষ ত্যাজিতে মোরে কোরো না আহ্বান... আমি রব নিষ্ফলের হতাশের দলে।’ হয়তো তার জন্য অন্য কোনো জয় নিয়তিনির্দিষ্ট ছিল, সারা পৃথিবীর ট্রাজিক নায়কের ধ্বংস হয়েও যে ঈর্ষণীয় জয় পায়? কোনো কোনো উপলক্ষে আমি দেখি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের মা-বাবাদের, তারাও কি পরাজয়কে মেনে বসে থাকেন? নাকি এর উল্টোটাই সত্যি?

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। আমার নান্দীকারের সহকর্মী অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে সোনা যখন সাত বছরের ছিল তখন তাদের বাড়িতে একটা দৃশ্যের স্মৃতি আমার কাছে প্রায়ই ফিরে ফিরে আসে। সে পাশের বাড়ির সমবয়সী কোনো বন্ধুর সঙ্গে তাদের বাড়ির উঠোনে খেলছিল। আগের দিন বৃষ্টি হয়ে গেছে, উঠোন একটু ভেজা আর পিছল।

সোনা কী একটা জিনিস বন্ধুকে লাফিয়ে দেখাতে গেল, আর অমনি পা হড়কে সড়াৎ করে মাটিতে বসে পড়ল। এটা তার পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না বোঝাই গেল। কিন্তু সে মুহূর্তে অপ্রতিভতা সামলে নিয়ে সে সটান উঠে দাঁড়িয়ে বন্ধুকে বলল, ‘দেখলি কেমন মজার কায়দা করলুম!’ অপ্রত্যাশিত পরাজয়কে জয়ে রূপান্তরিত করার এমন চমৎকার চেষ্টা আমি খুব কম দেখেছি।

আমি দেখি আমার চেয়ে অনেক দুর্বল অবস্থানের মানুষ কী আশ্চর্য জীবনরস নিয়ে বেঁচে আছে। তারা যে হেরে আছে এটা যে তারা বুঝতে চায় না, সেটাই তাদের জয়ের একটা চেহারা। আমাদের বাজারে শাকসবজি বিক্রি করে একটি ছেলে, গোবিন্দ- বাজারে ঢোকার প্রায় আধমাইল দূর থেকে আমি তার গলার আওয়াজ শুনতাম- ‘টাটকা টাটকা নতুন নটে শাক এনেছি, কাটোয়ার ডাঁটা এনেছি, কচি থোড় এনেছি, চলে আসুন চলে আসুন সব্বাই! দেরি করলে পাবেন না!’ আমি কখনও তাকে হাসিমুখ ছাড়া দেখিনি। আমার তুলনায় সে হেরে আছে এটা সে ভাবেই না, তাই আমার মধ্যবিত্তের দুঃখবিলাসও তার নেই।

আরেক দোকানি খদ্দেরকে বলে, ‘আমার মোবাইল নম্বর দিচ্ছি নিয়ে যান, লঙ্কা ঝাল না হলে কাল ফোন করে বলবেন যে ঝাল হয়নি, একশ’র বদলে দু’শ লঙ্কা দেব!’ পাটুলির ঝিল থেকে সাইকেলের ক্যারিয়ারে অ্যালুমিনিয়ামের মস্ত হাঁড়ি বেঁধে চারা পোনা বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছে যে জেলে, সে কী করে সাইকেল চালাতে চালাতে ভারি মিষ্টি গলায় গান গাইতে গাইতে প্যাডেল করে- ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে’?

আবার বাজারে যে মুখে শ্বেতীওয়ালা এক মহিলা মাছ বেচেন, যখন শুনি যে তার ছেলে যাদবপুর থেকে ইতিহাসে এমএ পাস করে স্কুলে কাজ পেয়েছে, মাকে একটা আলাদা বাড়ি করে দেয়ার আগে সে বিয়ে করবে না- তখন আমি বুঝি অনেক মানুষ আছে যারা হারতে চায় না। তাদের জয় আমাদের মধ্যবিত্তদের পরস্পরকে ল্যাং মারা হাঁচোড়-পাঁচোড় করা সাফল্যের চেয়েও অনেক বেশি গৌরবের বলে আমার মনে হয়।

আমি চতুর্দিকে হেরে যাওয়া মানুষদের জয় দেখি, জয় দেখতে চাই। এই লড়াইটার মধ্যেই জয়ের ছবি দেখি আমি। কবে সারা দেশ, সারা পৃথিবী এসব হেরে যাওয়া মানুষের জয় দেখবে?

পবিত্র সরকার : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা; লেখক

পৃথিবী উপহাস জয়-পরাজয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম