Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দুর্যোগের আগেই চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা

Icon

এম এ হালিম

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সত্তরের দশক পর্যন্ত দুর্যোগকে শুধু ‘প্রাকৃতিক দুর্বিপাক’ হিসাবেই গণ্য করা হতো। তাই দুর্যোগ ও মানবিক কাজে নিবেদিত কতিপয় প্রতিষ্ঠান, যেমন রেড ক্রস/রেড ক্রিসেন্ট দুর্যোগ ঘটার পর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে মানবিক সহায়তা প্রদানে ব্যস্ত থাকত। বলা যায়, দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে দুর্যোগের আগে প্রাতিষ্ঠানিক বা পারিবারিক তৎপরতা ছিল না। ১৯৭০ সালে এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সংঘটিত প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে অর্ধ লক্ষাধিক উপকূলীয় মানুষের মৃত্যু তারই সাক্ষ্য বহন করে। ১৯৭২ সালে দেশে তদানীন্তন রেড ক্রস ও বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) উপকূলীয় মানুষের জন্য আগাম সতর্কসংকেত প্রচার, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং ঘূর্ণিঝড়ের প্রাক্কালে বিপদাপন্ন মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে অপসারণের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি অভাবনীয়ভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

বিভিন্ন দেশে সংঘটিত নানা দুর্যোগে মানবিক বিপর্যয় অনুধাবন করেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ উপলব্ধি থেকেই জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালের ১৩ অক্টোবর প্রথম আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দুর্যোগের ঝুঁকি ও তা প্রশমনে বৈশ্বিক সচেতনতার অভ্যাসকে প্রতিষ্ঠিত করা। এ ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে দুর্যোগ সচেতনতা বৃদ্ধির এবং কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে জাতিসংঘ দুর্যোগবিষয়ক পৃথক কর্তৃপক্ষ তথা UN Office for Disaster Risk Reduction (UNDRR) প্রতিষ্ঠা করে।

চলতি বছরের প্রথমার্ধে বিশ্বজুড়ে সংঘটিত বিভিন্ন দুর্যোগে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১১০ বিলিয়ন ডলার। বছরের শুরুতে (ফেব্রুয়ারি) তুরস্কে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়তই ঘটছে কোনো না কোনো দুর্যোগ। এ বছর মরক্কোর ভূমিকম্প, লিবিয়ার বন্যা আর অতিসম্প্রতি সিকিমে (ভারত) ঘটে যাওয়া প্রলয়ংকরী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা অনেক। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রতিঘাতের কারণে প্রতিনিয়ত দুর্যোগ বেড়েই চলেছে। পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বিশ্বে দুর্যোগের কারণে মৃতের ৯১ শতাংশই ঘটে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সৃষ্ট দুর্যোগে। জাতিসংঘ বলছে, একই কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বে গড়ে প্রতিদিন ১.৫টি দুর্যোগ ঘটবে। উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উচ্চঝুঁকিতে থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম।

দুর্যোগবিষয়ক বহুল আলোচিত সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্কের (জাপান ২০১৫) অধীনে স্থায়িত্বশীল দুর্যোগ প্রশমনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রসহ সব পক্ষ ২০৩০ সালের মধ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে একমত হয়। এসব উদ্যোগের মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছে পূর্ব সতর্কতা ও প্রাক-দুর্যোগ পদক্ষেপ গ্রহণে সচেতনতা বৃদ্ধি। দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসে সতর্কসংকেত সবার কাছে পৌঁছে দিতে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ২০২২ সালে মিসরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে (কপ ২৭) প্রস্তাব রেখেছেন Early warning for Alll (EW4ALL)। এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশ্বের ৩০টি পাইলট দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ উদ্যোগের সফলতা অর্থাৎ দুর্যোগের আগে সবার কাছে সংকেত পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ আবাসিক অফিস, আইএফআরসি, রেড ক্রিসেন্টসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে কাজ করছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে কৌশল নির্ধারণের জন্য ১-২ নভেম্বর ঢাকায় জাতীয় ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

একসময় দুর্যোগ সংঘটিত হওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে মানবিক সাহায্য প্রদানই ছিল দুর্যোগ নিয়ে আমাদের ভাবনা। পরবর্তীকালে দুর্যোগে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বিভিন্ন ঝুঁকিহ্রাস উদ্যোগ (রিস্ক রিডাকশন ইনিশিয়েটিভ) গ্রহণ করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দুর্যোগের পূর্বাভাস এবং বিপদাপন্ন মানুষ ও সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি বিশ্লেষণ করে তাদের কাছে দুর্যোগের আগেই মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ শুরু হয়েছে, যার ফলে তারা অধিক প্রস্তুতি ও দুর্যোগ-পরবর্তী দুর্দশা লাঘবে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে। এ নতুন উদ্যোগকে প্রত্যাশিত মানবিক সাড়া (Anticipatory Humanitarian Action) হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জার্মান রেড ক্রস, আইএফআরসি ও নেদারল্যান্ডসের রেড ক্রস/রেড ক্রিসেন্ট ক্লাইমেট সেন্টারের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করে এদেশে এ কার্যক্রম শুরু করে। শুরুতে (২০১৫) পূর্বাভাসভিত্তিক অর্থ সহায়তা (Forecast-based Financing) কার্যক্রমের আওতায় আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বন্যা সতর্কীকরণ সেন্টারের সহায়তায় বিশ্লেষণভিত্তিক আগাম সতর্কবার্তা প্রদানসহ সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। ফলে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কয়েকদিন আগেই কমিউনিটির ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস এবং দুর্যোগের পরক্ষণেই সাহায্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকার দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি ২০১৯-এ এই ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসে সরকার ও মানবিক সংস্থাগুলোর সম্মিলিত অঙ্গীকারেরই দৃষ্টান্ত।

দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি ও বিপন্নতা কমাতে ঝুঁকিহ্রাস প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। গবেষণায় জানা যায়, দুর্যোগের সচেতনতা ও ঝুঁকিহ্রাস উদ্যোগে এক ডলার বিনিয়োগ করলে অন্তত ১০ গুণ ফল লাভ অর্থাৎ ক্ষতি কমানো সম্ভব। তাই দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বশেষ উদ্যোগ ‘সবার জন্য পূর্ব সতর্কবার্তা’ অথবা ‘প্রত্যাশিত মানবিক সাড়া’সহ সব ধারণা ও উদ্যোগ বাস্তবায়নে চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

এম এ হালিম : বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পরিচালক, দুর্যোগ ও জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগ

halim_64@hotmail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম