জাতি কি এ সংকট থেকে পরিত্রাণ পাবে?
ড. এম এ এস মোল্লা
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইংরেজ কোম্পানি আমলের লর্ড মেকলে লিখে রেখে গেছেন, ‘বড় বড় প্রতিশ্রুতি, মসৃণ অজুহাত, পরিস্থিতিগত মিথ্যার বেসাতি, ধাপ্পাবাজি, জালিয়াতি-এসব গঙ্গা নদীর নিম্নাঞ্চলের মানুষদের আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক উভয় প্রকার অস্ত্র।’ আর নোবেল বিজয়ী বাঙালি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনের দুঃখে বলেছেন, ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’
বাঙালির এ বদ স্বভাব সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বৈরতান্ত্রিক মানসের রাজনীতির মধ্যে। স্বাধীন বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও জনগণ ভালোভাবেই বোঝেন, ১৯৭৩ সাল থেকে অদ্যাবধি দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। কিন্তু কিছু ক্ষমতান্ধ, নব্য দখলদার শক্তি এ বাস্তব সত্যের বিরুদ্ধে উচ্চস্বরে গলাবাজি করে (রীতিমতো চিৎকার করে)। ‘হুজুগে বাঙালি’ প্রবাদের নীতি তারা পুরোপুরি অনুসরণ করেই চলেছে। এরা ‘ক্ষমতার’ মধ্যে বাস করে, তাতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে এমনি অভ্যেস গড়ে তুলেছেন যে, একবার ‘ক্ষমতা’ পেয়ে গেলে তা আর কোনোভাবে হাতছাড়া করা তাদের কোনো রিমোট গুরুর চিরকালের নিষেধ! তাই নির্বাচনে হারতে না শেখা এ সংকীর্ণ স্বার্থান্ধতার কূপমুন্ডে থেকে নিজেরা অন্য দলের নির্বাচনে জেতা ঠেকানোর জন্য যত ধরনের ধাপ্পাবাজি আছে সবই করে। জেনারেল এরশাদের নয় বছরের শাসনকালে পোড় খেয়ে অনুধাবন করেন, তারা ক্ষমতায় থেকে সাধারণ নির্বাচন করার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তাই ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর প্রধান তিন রাজনৈতিক জোট নির্বাচনকালীন নির্দলীয়, নিরপেক্ষ একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা তৈরি করে। সমঝোতার ভিত্তিতে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে ব্যবস্থাটি জাতীয় সংসদে পাশ করিয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জাতীয় প্রত্যাশা ছিল; কিন্তু বিজয়ী দল বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ‘শিশু আর পাগল ছাড়া কোনো নিরপেক্ষ লোক নেই’ বলে ইপ্সিত সরকারব্যবস্থা সংসদে পাশ করালেন না।
এভাবে পঞ্চম সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে অগত্যা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুয়া নির্বাচনে ঠুনকো ষষ্ঠ সংসদ প্রতিষ্ঠা করে অল্প সময়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো পাশ করানো হলো; এতে কাঠামোটিতে কিছু সমস্যা থেকে গেল। ওই সমস্যাপূর্ণ কাঠামোতেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে এক মাসের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বেগম জিয়ার নেতৃত্বের প্রথম (নামকাওয়াস্তে দ্বিতীয়) বিএনপি সরকার বিদায় নিল। বিএনপির এ বাজে নির্বাচনটি ছিল পঞ্চম সংসদের মেয়াদকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো পাশ না করানোর কাফফারা। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখনো সেটিকে দেখিয়ে নিজেদের অপকর্ম জায়েজ করার চেষ্টা করে।
সমঝোতামূলক একটি (ফেব্রুয়ারি ১৯৯১) এবং সাংবিধানিক তিনটি (জুন ১৯৯৬, অক্টোবর ২০০১ এবং ডিসেম্বর ২০০৮) মোট চারটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের প্রতিটি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। এসব নির্বাচনে বিজিত দল নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুললেও ওই অসত্য দাবি অচিরেই স্তিমিত হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে এবং বিএনপি ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অকার্যকর করার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগের প্রশাসনিক সাজানো ব্যবস্থাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ভণ্ডুল করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম করেন। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজের পক্ষে নেওয়ার নগ্ন চেষ্টা চালায়; বশংবদ নির্বাচন কমিশন ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি সপ্তম সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। এতে বিরোধী দলগুলোর নেতৃত্বে জনগণ তুমুল আন্দোলন গড়ে তুললে জানমালের চরম ক্ষতি শুরু হয়। এতে সামরিক বাহিনীর প্রধানরা ‘জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন’ নীতিতে হস্তক্ষেপ করে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীনকে প্রধান উপদেষ্টার পদ ছাড়তে বাধ্য করেন (এটাই ‘কুখ্যাত’ ওয়ান-ইলেভেন)।
সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে গঠিত সরকারের ৯০ দিনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সরকার হয়ে পড়ে ‘অসাংবিধানিক’ (Ultravires)। কিন্তু ‘যা সাধারণত আইনসিদ্ধ নয়, প্রয়োজন তাকে আইনসিদ্ধ করে’ ফর্মুলায় জায়েজ ওই সরকার প্রায় দুবছর ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন কমিশন পুনর্র্গঠন করে, নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি করে এবং ওই তালিকা অনুসারে দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুত করে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সাংবিধানিক ত্রয়োদশ সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট দাখিল করা হয়। রিটের শুনানিতে হাইকোর্ট বেঞ্চ বৈধতা দিলে আপিল বিভাগের শুনানিতে ৪-৩ বিভক্ত রায়ের ফলে ২০১১ সালে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অনেকটা একক সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ১০ মে ২০১১ অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন।
ওই রায়ে অবশ্য বলা হয়েছিল, ‘‘সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ভবিষ্যতের জন্য বাতিল (Prospectively void) ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করা হলো; যা সাধারণত আইনসিদ্ধ নয়, প্রয়োজন তাকে আইনসিদ্ধ করে, জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন-এ সকল সনাতন তত্ত্বের ভিত্তিতে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন পূর্বে উল্লেখিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে সংসদ ইচ্ছা করলে ‘এরই মধ্যে’ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে সাবেক প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারকদের বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে। বিস্তারিত রায় পরে প্রকাশিত হবে।”
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা নিজের নিয়োজিত সংসদীয় কমিটির সুপরামর্শ আমলে না নিয়ে ওই রায় লঙ্ঘন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার না রাখার সিদ্ধান্ত নেন ৩০ মে (২০১১)। তার এ সিদ্ধান্ত এবং এর ফলে সংবিধানের তাড়াহুড়ো (আদালতের পূর্ণ রায় প্রকাশের ১৫ মাস আগে) ও আইনত অবৈধ পঞ্চদশ সংশোধনী বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার মূল কারণ। একদিকে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও ভারত এতে জড়িয়ে পড়ায় এবারের সংকট আন্তর্জাতিক রূপলাভ করেছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি দল/মিশন বাংলাদেশে প্রাক-নির্বাচনি অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিশনের সদস্যরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বরং এতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা আঁচ করে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করতে পারে এমন রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশের লোক, এমনকি সংবাদমাধ্যমের ওপরও নতুন ‘ভিসানীতি’র আওতায় বিধিনিষেধ আরোপ শুরু করেছে।
এভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে পুরো পশ্চিমের ব্যবসা-বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়ছে। তথাপি পরপর দুই মেয়াদে অনৈতিক আওয়ামী লীগ ‘সরকার’ এখনো জরুরি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে তার নিকট ‘ক্ষমতা’ হস্তান্তর করতে একবারেই রাজি হচ্ছে না; বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ‘মৃত’ বলে উল্লেখ করে বিরোধী জোটের আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়ার, এমনকি তাদের ‘ষড়যন্ত্রকারী’ ও ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে দেশের, বিশেষত রাজধানী ঢাকার সড়কে দাঁড়াতেই না দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। ওদিকে বিরোধী জোট কোনোভাবেই আর বোগাস নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে বদ্ধপরিকর, এমনকি ওরকম ভুয়া নির্বাচন করতে না দেওয়ার কথাও বলছে তারা।
দেশবাসী স্পষ্টভাবে জানেন এবং বোঝেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দেশে প্রকৃত নির্বাচন হয়নি। এ দুইবারের ‘ভোটের’ সময় যেসব তরুণের বয়স নতুন করে ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে, তারা এখনো ভোট দিতে পারেনি। কিন্তু ক্ষমতান্ধদের ‘বাণী’ হচ্ছে, বিরোধী দলগুলোর জোট আগামী নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়’! এরা ষড়যন্ত্রকারী, কেউ কেউ সীমা লঙ্ঘন করে আন্দোলনকারীদের ‘দেশদ্রোহিতার’ তকমা পরাতেও কসুর করে না। বাস্তব সত্য হচ্ছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে যথাক্রমে দশম ও একাদশ সংসদের ‘নির্বাচন’ সুষ্ঠু হয়নি। এগুলো অনুষ্ঠানের আগে ‘মসৃণ অজুহাত’ দেখিয়ে ‘বড় বড় প্রতিশ্রুতি’ দেওয়া হয়েছিল; নির্বাচন ও ফল ঘোষণাকালে ‘পরিস্থিতিগত মিথ্যার বেসাতি’ করা হয়েছে, আর ঘটনা ঘটিয়ে পরে এখনো আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক উভয় ধরনের অস্ত্র হিসাবে ‘ধাপ্পাবাজি ও জালিয়াতি’র আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে।
এখন রবীন্দ্রনাথের খেদোক্তির কারণ অবসানের জন্য বিশ্বপ্রভুর কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া নিপীড়িত জনগণের সামনে আর কোনো পথ খোলা দেখছি না। মহান আল্লাহ ক্ষমতাসীনদের হেদায়েত দান করে জাতিকে সামাজিক সংকট থেকে রক্ষা করুন।
ড. এম এ এস মোল্লা : সমাজ নিরীক্ষক এবং সামাজিক বিষয়ের লেখক
momas71@yahoo.com
