Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জমিবিষয়ক জটিলতাগুলোর নিরসন জরুরি

Icon

মো. আশরাফ হোসেন

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জমিবিষয়ক জটিলতাগুলোর নিরসন জরুরি

সরকারের জমি ব্যক্তির এবং ব্যক্তির জমি সরকারের নামে রেকর্ড দেওয়া হয় মর্মে প্রায়ই বিভিন্ন সভায় এ ধরনের মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়; কিন্তু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার সময় ও সুযোগ থাকে না। গত এক বছর সরকারের খাসজমি এবং বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার জমি ব্যক্তিমালিকানায় এবং ব্যক্তিমালিকানার জমি সরকারের নামে রেকর্ড হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করি।

শুরুতেই এ কথা বলা বাহুল্য নয়, সরকারি জমির সঠিক তথ্য-উপাত্তের অভাবে জরিপকালীন বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয় জরিপের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। হাল জরিপ আরম্ভ করার আগেই পূর্ববর্তী অর্থাৎ সর্বশেষ জরিপের খতিয়ানের কপি সহকারী কমিশনার (ভূমি) অথবা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেকর্ড রুম থেকে নিয়ে জরিপ করার প্রচলিত বিধান থাকলেও পূর্ববর্তী জরিপের খতিয়ান অনেকাংশে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায় না। বিগত ৫০-৬০ বছর ওই রেকর্ডগুলো ব্যবহার করার ফলে বর্তমানে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বহুলাংশে কাটাছেঁড়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকের সংরক্ষিত কপিও নিস্তার পায়নি বিকৃতি ও টেম্পারিংয়ের কালো থাবা থেকে।

সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় থেকে নামজারি ও জমা-খারিজের হালনাগাদ তথ্য পাওয়া কষ্টসাধ্য। আবার সময়মতো পাওয়া যায় না। একই জমি একাধিকবার নামজারি হওয়ার দৃষ্টান্তও একেবারে কম নয়। নামজারি হলেও সময়মতো তামিল না হওয়ায় তথ্যগত বিভ্রাট দেখা দেয়। খাস, অর্পিত ‘ক’ তফসিলভুক্ত, পরিত্যক্ত, মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ (পিও) ৯৮ অনুযায়ী, হস্তান্তরিত জমি (surrendered land)-এর তালিকা এবং রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণকৃত জমির (৩৭৫ বিঘার অতিরিক্ত) সঠিক তথ্য বা গেজেট পাওয়া যায় না। শুধু রেজিস্ট্রার-৮-এর খাসজমির তথ্য পাওয়া যায়; কিন্তু সেখানে কোনো Reference থাকে না। সবচেয়ে কষ্টসাধ্য হলো, একই দাগে খাসজমি, অর্পিত জমি এবং ব্যক্তি মালিকানার জমির অবস্থান কিন্তু চিহ্নিত না থাকার কারণে ক্যাটাগরিভিত্তিক পৃথক দাগ সৃজন করা সম্ভব হয় না। আবার যে দাগে অর্পিত সম্পত্তি আছে, সে দাগের অন্তঃস্থিত ব্যক্তি মালিকানার জমি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নামজারি করা হয় না। ফলে সরকারের খাসজমি, ব্যক্তিমালিকানার জমি এবং অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে আপত্তি মামলার উদ্ভব হয়।

দ্বিতীয়ত, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বন্দোবস্তকৃত জমির সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। নবগঠিত জেলাগুলোর ৭০ এবং ৮০-এর দশকে বন্দোবস্তকৃত জমির তথ্য নেই। ফলে যে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে, তার মালিকানা সরকার পক্ষে জেলা প্রশাসক দাবি করেন। জরিপকালীন বন্দোবস্তকৃত জমির দলিল সঠিক না ভুল, সে বিষয়ে সরকার পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে কোনো তথ্য উপস্থাপন করা হয় না। এসএ রেকর্ড ব্যক্তির নামে, কিন্তু আরএস রেকর্ড কী বুনিয়াদে সরকারের নামে হলো তার বুনিয়াদ খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার এসএ রেকর্ড সরকারের নামে। দেওয়ানি আদালতের রায় অনুযায়ী, ব্যক্তির নামে নামজারি জমা-খারিজ হয়েছে। ইত্যবসারে আরএস রেকর্ড চূড়ান্তভাবে সরকারের নামে প্রকাশিত হয়েছে। আরএস রেকর্ড সরকারের নামে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভূমি উন্নয়ন কর গ্রহণ করা হয় না এবং এবং ওই সম্পত্তি সরকারের মর্মে দাবি করা হয়। ফলে ডিসপিউট এবং আপত্তি মামলার উদ্ভব হয়। একইভাবে জমি সিকস্তি হওয়ার পরও দীর্ঘদিন ভূমি উন্নয়ন কর গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সিকস্তি ও পয়োস্তি সম্পর্কিত সীমারেখা টানা হয় না। ফলে ৩০ বছরের মধ্যে নতুন চর জেগেছে, না ৩০ বছরের পরে জেগেছে তা বোঝা যায় না। আবার পয়োস্তি হওয়ার পর ২০ বছর ভূমি উন্নয়ন কর নেওয়া হয়েছে এমনও নজির দেখা যায়; কিন্তু জরিপের অব্যবহিত পূর্ব থেকে ভূমি উন্নয়ন কর নেওয়া বন্ধ করা হয়। যেহেতু সিকস্তি জমির বছরের পর বছর ভূমি উন্নয়ন কর গ্রহণ করা হয়, ফলে ব্যক্তি দাবি করেন। আবার বাস্তবে শিকস্তি জমি হওয়ার কারণে সরকারের নামে রেকর্ড দেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না। ফলে ব্যক্তি এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে মামলার উদ্ভব হয়।

বিশেষভাবে লক্ষণীয়, বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক অধিগ্রহণকৃত, অর্পিত ও বন বিভাগের জমিসহ বিভিন্ন সংস্থার জমির গেজেটে দাগভিত্তিক জমির পরিমাণ পৃথকভাবে উল্লেখ না করে কেবল দাগগুলো একত্রে উল্লেখপূর্বক মোট জমি লেখা হয়। ফলে দাগভিত্তিক সুনির্দিষ্টভাবে জমির পরিমাণ ও অবস্থান বোঝা যায় না। যার ফলে সরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি মালিকানার জমি চিহ্নিত করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়ে এবং বিবাদ ও আপত্তি মামলা দায়ের হয়।

বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক অধিগ্রহণকৃত জমির তথ্য-গেজেট, ল্যান্ড শিডিউল, স্কেচম্যাপ, লে-আউট প্ল্যান জরিপকালীন যথাসময়ে সরবরাহ না করায় এবং সীমানা চিহ্নিত না থাকায় জরিপ কার্যক্রম প্রলম্বিত হয় এবং আপত্তি মামলার উদ্ভব হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেওয়ানি আদালতের মামলার রায় বা ডিক্রি থাকা সত্ত্বেও সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট জমি নামজারি জমা-খারিজ করা হয় না। আবার সরকার পক্ষে আপিলও করা হয় না। ফলে সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং ব্যক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

বন বিভাগের অধিকাংশ ভূমির ক্ষেত্রে গেজেটে দাগের বিপরীতে জমির পরিমাণ সুনির্দিষ্ট নেই। বরং একাধিক দাগ একসঙ্গে লিখে মোট জমির পরিমাণ লেখা মর্মে দেখা যায়। বাস্তবে অনেকাংশে গাছপালাও নেই। একই দাগে বন বিভাগ এবং ব্যক্তির জমি। বন বিভাগের জমি চিহ্নিত করা নেই। সুতরাং, বিবাদ অনিবার্য। সিএস রেকর্ড অনুযায়ী, বনের জমির গেজেট হয়েছে; কিন্তু বন বিভাগ যথাসময়ে বনের সম্পত্তি সম্পর্কিত গেজেট উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়ায় এসএ এবং আরএস জরিপে ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়। বন বিভাগ জমির মালিকানা ফেরত পাওয়ার জন্য প্রায় ৬০ বছরেও বহুলাংশে কোনো মামলা-মোকদ্দমা করেনি। কিন্তু চলমান জরিপে রেকর্ড দাবি করছে। পক্ষান্তরে এসএ এবং আরএস রেকর্ড অনুযায়ী, রেজিস্টার্ড দলিলের মাধ্যমে ওই জমি কয়েক দফা হস্তান্তরিত হয়েছে। ফলে আপত্তি অনিবার্য।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন ধরনের বন রয়েছে। যেমন: Reserved Forest, Private Forest, Acquired Forest, Protected Forest and Vested Forest. এক্ষেত্রে Reserved Forest কেবল বন বিভাগের নামে রেকর্ড হবে; Private Forest ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ড হবে এবং Acquired Forest, Protected Forest and Vested Forest সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের নামে রেকর্ড হবে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন বিভাগ, জেলা প্রশাসন এবং ব্যক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং প্রকৃত গেজেট, রেজিস্টার ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া বা বের করা খুবই দুরূহ হয়ে পড়ে। ফলে সঠিকভাবে কাগজপত্র সংরক্ষিত না থাকায় এবং যথোপযুক্ত সময়ে উপস্থাপন না করায় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রলম্বিত হয়।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা-১-এর ২৭/১০/২০১৫ খ্রি. তারিখের ৩১.০০.০০০০.০৪২.৬৭.০৩২.১৫-৯৮৭নং স্মারকে The Court of Wards Act, ১৮৭৯-এর ৮অ ধারা অনুযায়ী, ১৯৫২ সালের গেজেটভুক্ত সম্পত্তির ওপর কোর্ট অব ওয়ার্ডস দাবি বা দেখাশোনার দায়িত্ব হারায়। এছাড়া মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক বর্ণিত গেজেটভুক্ত সম্পত্তি নিয়ে দাবি উত্থাপন না করতে ভূমি সংস্কার বোর্ডকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে এবং মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক নামজারির অনুমতি প্রদান করা হয়েছে; কিন্তু Court of Wards সিএস মোতাবেক দাবি করেন।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধিশাখা-২ (মাঠ প্রশাসন)-এর গত ০২/০২/২০১৬ খ্রি. তারিখের ৩১.০০.০০০০.৪৩.৫৮.০১৯.১২-৭০নং স্মারকে কোর্ট অব ওয়ার্ডস, ভাওয়াল রাজ এস্টেট ও ঢাকা নওয়াব এস্টেটের সিএস রেকর্ডীয় সম্পত্তি; যা ১৯৫২ এবং ১৯৫৬ সালের গেজেট মোতাবেক প্রজাবিলি হয়ে এসএ রেকর্ড হয়েছে, তার ব্যবস্থাপনার আইনি এখতিয়ার না থাকায় ওইসব সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা না করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু Court of Wards সিএস অনুযায়ী দাবি করেন।

সামগ্রিক বিচারে জমি অধিগ্রহণ করার সময় দাগভিত্তিক সুস্পষ্টভাবে জমির পরিমাণ উল্লেখ থাকা বাঞ্ছনীয়। অধিগ্রহণকৃত জমির ছায়া নথিও সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে থাকা সমীচীন। সরকারি সম্পত্তি চিহ্নিতপূর্বক সীমানা নির্ধারণ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা জরুরি। অন্যান্য দায়িত্বের মতো সংস্থার জমি প্রতি তিন-চার বছর পর অডিট হওয়া উচিত। প্রতিটি মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর কর্তৃক নিয়মিত ভূমি ব্যবস্থাপনা শাখা এবং আইন শাখা কর্তৃক পরিদর্শনপূর্বক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে অদূর ভবিষ্যতে সরকারি এবং সরকারি দপ্তর বা সংস্থার জমির জটিলতা হ্রাস পাবে। এটাই আমার বিশ্বাস।

মো. আশরাফ হোসেন : জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার ঢাকা

 

জমি জরুরি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম