Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

‘ম্রিয়মাণ জনসমাজ’ ও আমাদের গণতন্ত্র

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘ম্রিয়মাণ জনসমাজ’ ও আমাদের গণতন্ত্র

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নিখোঁজ গণতন্ত্র উদ্ধারে সিভিল সোসাইটি বা জনসমাজের ভূমিকা নিয়ে নতুন মাত্রায় আলোচনা শুরু হয়েছে। পাশ্চাত্য দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অংশীজনদের মধ্যে সিভিল সোসাইটি বা জনসমাজের বিশেষ ভূমিকার বিষয়টি উল্লেখ করছেন। একসময় তারা বলতেন, বাংলাদেশে একটি প্রাণবন্ত জনসমাজ রয়েছে। এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো, জনসমাজের যে স্বরূপ দার্শনিকরা বিভিন্ন সময়ে তুলে ধরেছেন, এর সঙ্গে বাংলাদেশে সমতুল্য গোষ্ঠী খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। যাদের আমরা জনসমাজের সদস্য বলে ভাবতে চাই, তারা ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইতে পক্ষাবলম্বন করায় তাদেরকে জনসমাজের প্রতিনিধি বলে ভাবতে মন সায় দেয় না। যতই দিন যাচ্ছে, জনসমাজের খাঁটি প্রতিনিধির সংখ্যা ততই কমছে। আগামী দিনে জনসমাজ বলে কিছুর অস্তিত্ব থাকবে বলে আমার মনে হয় না। সামাজিক শক্তির বিন্যাসে বাংলাদেশের জনসমাজ বিরল প্রজাতিতে পরিণত হতে পারে। আগ্রাসী রাজনীতি জনসমাজের ভূমিকা প্রান্তিকতার পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। জাতির বিবেক হিসাবে যাদের বিবেচনা করতে পারি, তাদের সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। গণতন্ত্রের জন্য, মুক্ত সমাজের জন্য এই পরিস্থিতি কোনোক্রমেই কাম্য হতে পারে না।

বিশ্বপরিসরে জনসমাজের ধারণাটি সাম্প্রতিক সময়ে নাটকীয়ভাবে ফিরে এসেছে। নানা ধরনের সামাজিক প্রেক্ষাপটে রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে জনসমাজের ধারণাটি অবধারিতভাবে আলোচিত হয়। এ আলোচনার মধ্যে থাকে একদিকে জনসমাজের অস্তিত্বহীনতা ও এর সংকোচন এবং অন্যদিকে এর বিকাশ ও সম্ভাবনা। জনসমাজ নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তা থেকে উদ্ভূত হয় নির্দিষ্টকরণের সমস্যা। প্রশ্ন ওঠে প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন সত্ত্বেও জনসমাজের ধারণা কি অপরিবর্তিত থাকে? পাশ্চাত্য জগৎ, সাবেক কমিউনিস্ট সমাজ এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় জনসমাজের সমর্থকরা কি একই লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছেন? জনসমাজ বলতে প্রকৃষ্টভাবে আমরা কী বুঝব? এটা কি এমন একটি বর্ণনামূলক সংজ্ঞা, যা সুনির্দিষ্ট ধরনের সামাজিক কাঠামো, সামাজিক আচরণের রূপ অথবা রাজনৈতিক আদর্শ? যেসব দেশে জনসমাজ গঠনের চেষ্টা চলে একটি আদর্শ অবস্থা সৃষ্টির জন্য, সেখানে জনসমাজ গঠন কী বুঝিয়ে থাকে?

জনসমাজ নিয়ে পক্ষপাতমূলক অবস্থান কোনো কাজের কথা নয়, কাজের কথা হবে এ ধারণাটি আমরা কতটুকু স্পষ্ট করতে পেরেছি। জনসমাজ নিয়ে বিতর্কটি একাধারে আকর্ষণীয় এবং অস্পষ্ট। অস্পষ্ট হওয়ার কারণ হলো ব্যক্তিরা এবং জনসমাজসংক্রান্ত লিখিত আলোচনায় ধারণাটি ভিন্ন ধরনের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অস্পষ্টতার কারণ এই নয় ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ধারণাটি ব্যবহার করা হয়েছে, একেক সময় দেখা গেছে বিভিন্ন অর্থ থাকার ফলে অস্পষ্টতা সৃষ্টি হয়েছে, ব্যাপারটি এমন নয়। আসলে অর্থটাই ব্যাপকভাবে অস্পষ্ট। জনসমাজের ধারণাটি এমন ঝামেলাপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং পণ্ডিতরা এই আলোচনায় বারবার ফিরে এসেছেন। জনসমাজসংক্রান্ত সমসাময়িক আলোচনায় কমপক্ষে ৩টি ধারা লক্ষ করা যায়। এই ধারণাগুলো আমাদের দৃষ্টিতে আসে তখন, যখন জনসমাজের চিন্তাটি গুরুত্বপূর্ণভাবে আলোচনায় চলে আসে। আমরা দেখেছি কমিউনিস্ট-উত্তর সমাজে সামাজিক সংগঠন ও রাষ্ট্রের সঙ্গে এর সম্পর্কে কী হওয়া উচিত, সেই আলোচনায় জনসমাজের ধারণাটি বিশাল তাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কমিউনিস্ট সমাজে আইনের চৌহদ্দি ছিল অতিমাত্রায় বর্ধিত এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেমন আমলাতন্ত্র সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করত। কমিউনিস্টব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর যখন জনসমাজ বিকশিত হতে শুরু করল, তখন এটাকে উৎসাহিত করার চিন্তা দেখা দিল। কারণ, জনসমাজ রাষ্ট্রের আইনি চৌহদ্দির বাইরে অবস্থান করে। পাশ্চাত্য দেশগুলোয় দুই ধরনের বামপন্থি রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা বিদ্যমান। এ দুটি ক্ষেত্রে জনসমাজের ধারণা পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। কিছু সংখ্যক রেডিক্যাল তাত্ত্বিক সমাজতন্ত্র এবং কমিউনিজমের অভিজ্ঞতায় মোহভঙ্গ ঘটার পর তারা গণতন্ত্রের ধারণাটিকে আমূলভাবে পরিবর্তন করতে চাইলেন জনসমাজের ধারণাটিকে কাজে লাগিয়ে। কখনো কখনো দেখা গেছে, আশির দশকে কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো নয়া রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়ার গুহায় প্রবেশ করলে একদল চিন্তাবিদ বলতে শুরু করলেন সমাজতন্ত্রীরা ট্রেড ইউনিয়নের জঙ্গিত্ব ও রাষ্ট্রবাদ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন না, একইভাবে সমাজকে রক্ষণশীল ধারণা অনুযায়ী ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুসদৃশ সত্তায় পরিণত করা অগ্রহণযোগ্য। কল্যাণ রাষ্ট্রকে ব্যক্তিস্বার্থ অন্বেষী ধারায় নিয়ে যাওয়াও গ্রহণযোগ্য নয়। উল্লিখিত দুটি ধারার মধ্যে কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন ব্রিটিশ বহুমাত্রিক ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। এর জন্য রাষ্ট্রবহির্ভূত সহযোগিতামূলক উদ্যোগগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। রাষ্ট্রবহির্ভূত উদ্যোগগুলোর মধ্যে জনসমাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ সমাজ সংস্থা। এ কারণে এনজিওগুলো জনসমাজের অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়। সংজ্ঞাগত দিক থেকে এনজিও মানে বেসরকারি। সুতরাং এরা সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে অবস্থান করে। অন্যদিকে এনজিওগুলো রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং তারা ধনী দেশগুলো থেকে অর্থ বরাদ্দ পায় বলে তারা আন্তর্জাতিক ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এসব কারণে এনজিওগুলো প্রকৃষ্ট অর্থে স্বাধীন উদ্যোগের উৎস হতে পারে না। দৃশ্যত কমিউনিস্ট-উত্তর যুক্তি এবং সহযোগিতামূলক ব্যবস্থার মধ্যে মিল রয়েছে। কিন্তু এ দুইয়ের গতিপ্রকৃতি লক্ষণীয়ভাবে ভিন্ন ধরনের। কমিউনিস্ট-উত্তর ব্যবস্থাটির লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় বাড়াবাড়ি মুছে ফেলার চেষ্টা করা এবং বহুমাত্রিক ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো পুঁজিবাদী অনুসদৃশ বিন্যাসকে রোধ করা। পাশ্চাত্যে জনসমাজসংক্রান্ত আরেকটি ধারা রয়েছে। এ ধারার মধ্যে রয়েছে নতুন ধরনের সামাজিক আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সংস্থা গঠনের অনেক মিল রয়েছে। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে ক্লাসিক্যাল শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের খুব একটা মিল নেই। পাশ্চাত্যের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং আয়বৈষম্যের বিরুদ্ধে যেসব বিশাল বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোকে আমরা নতুন সামাজিক আন্দোলন বা নিউ সোশ্যাল মুভমেন্ট হিসাবে বিবেচনা করতে পারি। বাংলাদেশে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রব্যবস্থার বাইরে একটি শক্তিশালী জনসমাজ ছিল। যতই দিন যাচ্ছে, ততই এ ধরনের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের কেন্দ্র করে জনসমাজ আন্দোলন হতে দেখি না। আজকাল সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষ খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। ১৯৭৩ সালে একটি মানবাধিকার সংস্থা গঠিত হয়েছিল। এ সংস্থার কর্মকাণ্ডের ফলে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়নের কাহিনি উন্মোচিত হয়েছিল। এখন সেরকম কোনো সংস্থা দেখতে পাওয়া যায় না। অবশ্য ‘অধিকার’ নামে একটি সংস্থা মানববাধিকার বিষয়ে কথা বলার ফলে এর নেতা ও কর্মকর্তা আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হয়েছেন। এ সংগঠনটির সমস্যা হলো আর্থিক দিক থেকে এটি বাইরের অর্থের ওপর নির্ভরশীল।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় জনসমাজ নিয়ে অর্থপূর্ণ বিশ্লেষণ করতে হলে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে এসব দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট একধরনের নয়, বরং এগুলোর মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। যেমন আধুনিক স্বার্থভিত্তিক সামাজিকায়ন। আধুনিক সামাজিকায়ন কোনোরূপ বাধার সম্মুখীন অথবা অতিরিক্ত দায়বোধ মোকাবিলা নাও করতে পারে। এসব দেশের অনেক মানুষের আকাঙ্ক্ষা হলো নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও অনুমানযোগ্য আইনি ব্যবস্থা। ভারতের মতো দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক দশকজুড়ে কার্যকর রয়েছে। অনেক গবেষক ভারতীয় গণতন্ত্রের পরিণতি এবং এর পার্টি সিস্টেমের ব্যর্থতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের এ অসন্তোষ ব্যক্ত হয়েছে জনসমাজসংক্রান্ত ধারণাগুলো ব্যবহার করে। বর্তমানে হিন্দুত্ববাদী ধ্যানধারণা ভারতীয় রাষ্ট্রাদর্শের সঙ্গে লেপটে যাওয়ার ফলে গণতন্ত্রের জন্য নতুন বিপদ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সাংবাদিক নিজস্ব বিবেচনায় সংবাদ পরিবেশন করতে পারছে না। তারা ‘সেলফ সেন্সরশিপের’ আশ্রয় নিচ্ছেন। ঠ্যাঙ্গারে বাহিনীগুলো সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের বিরোধী দলগুলোর খবর সংগ্রহে দুঃখজনকভাবে বাধা প্রদান করে। এটা অবশ্যই অগণতান্ত্রিক আচরণ। জনসমাজ হিসাবে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এখন বহুধা বিভক্ত। এভাবে বিভক্ত হওয়ার ফলে সাংবাদিকরা তাৎপর্যময় জনসমাজ গড়তে পারছে না। অথচ একসময় এদেশে সাংবাদিকরা হয়ে উঠেছিল গণতন্ত্রের দিবারাত্র প্রহরী।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

বাংলাদেশ গণতন্ত্র জনসমাজ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম