নতুন কপিরাইট আইন, নতুন সম্ভাবনা
খান মাহবুব
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আইন-আদালত, বিধিবিধান শব্দগুলো শুনলেই আমাদের মনোজগতে বাসা বাঁধে ধীরগতি ও দীর্ঘ শত্রুতার চিন্তা। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশের বাস্তবতায় যথেষ্ট সময় নিয়ে সব পথ পাড়ি দিয়ে ২০০০ সালের কপিরাইট আইন রহিত করে ১৮ সেপ্টেম্বর গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে নতুন কপিরাইট আইন বলবৎ করা হয়েছে ১৯টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করে (২০২৩ সালের ৩৪নং আইন)।
কপিরাইট আইন দ্রুত নবায়নের প্রয়োজন পড়ে। কারণ এ আইন ভঙ্গকারীরা আইনের নানা ফাঁকফোকর বের করতে তৎপর। আর কপিরাইট নিয়ে ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত পরিবর্তন হয়। তাইওয়ান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ায় কপিরাইটের আইনের নবায়ন ঘটে দ্রুত। একটি আইন প্রণয়ন করতে ৫ বছর পেরিয়ে যাওয়া দুঃখজনক। সবচেয়ে বেদনার বিষয় হচ্ছে, এখন যে নতুন কপিরাইট আইন আমাদের হাতে এসেছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যে নতুন বাস্তবতায় আমরা দাঁড়িয়ে, সেখানে এ আইনকে পুরোপুরি সময়োপযোগী বলা কঠিন।
কপিরাইট আইন ২০২৩-এর বেশকিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। ২০০০ সালের আইন নিয়ে কপিরাইট অফিসকে নানা সময়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে। তাই ভুক্তভোগীদের অবস্থা বিবেচনায় বেশ বড় পরিসরে নতুন আইনের অবতারণা। ২০২৩ সালের আইনে কপিরাইট বিষয়টিকে জনসাধরণের জন্য সহজীকরণের লক্ষ্যে অনেক নতুন সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ২০০০ সালের অনেক ধারা ভেঙে বিস্তৃত ও উপধারায় বিন্যস্ত করা হয়েছে। নতুনধারা ও উপধারা যুক্ত হয়েছে। পুরোনো কিছু বিষয় বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় বাদ দেওয়া হয়েছে। নৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, রিলেটেড রাইটস, পাবলিক ডমেইন ইত্যাদি বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে। আগের আইনে রিলেটেড রাইট্সের (যেমন: সংগীত, নাটক ইত্যাদি) বিষয়টি উপযোগী ছিল না এবং এ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে থাকত। এ সমস্যা নিরসনে রিলেটেড রাইটসের বিষয়টি বর্তমানে অনেকটা স্বচ্ছ ও বিস্তৃত করা হয়েছে। নতুন অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে। লোকজ্ঞান ও লোক-সংস্কৃতির অধিকার সুরক্ষা পাবে এ আইনে। কপিরাইট অফিসকে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। আগের আইনে কপিরাইট সংরক্ষণে আমাদের দেশে সবচেয়ে লাগসই পদ্ধতি ছিল টাস্কফোর্সের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা। আগে টাস্কফোর্স পরিচালিত হতো নির্বাহী আদেশে। কার্যকর এ মাধ্যম এখন আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০০০ সালের আইনের একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে সচেতনতার অভাব। এ লক্ষ্যে কপিরাইট বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সচেতন করতে প্রদত্ত আইনে নানা ব্যবস্থা আছে।
ডিজিটাল মিডিয়ার সুযোগে ইউটিউবসহ নানা মাধ্যমে গান, নাটক ইত্যাদির প্রণেতাকে উপার্জন থেকে বঞ্চিত করা হয়। বর্তমান আইনে উল্লিখিত মাধ্যম থেকে অর্জিত আয়ে প্রণেতাদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ছাপানো হরফে প্রকাশিত যে কোনো বই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পড়ার উপযোগী নয়, সেগুলো ডিজিটাল টকিং বই, ব্রেইল বই, অ্যাকসেসিবল ইলেকট্রনিক টেক্সট অথবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য পাঠযোগ্য করার ক্ষেত্রে কপিরাইট আইনে ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কপিরাইট আইনের এ সামান্য পরিবর্তন এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার সবার জন্য একীভূত শিক্ষা অর্জনে সহায়ক হবে।
কপিরাইট ভঙ্গকারীরা যেহেতু জেনেবুঝে আইনটি সাধারণত ভঙ্গ করে অবৈধ অর্থ অর্জনের উদ্দেশ্যে, তাই বর্তমান আইনের প্রতিটি ধারা সম্ভাব্য ফাঁকফোকর নিরাপদ করতে বিস্তৃত করে বলা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় বিবরণ ও ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে।
কপিরাইট রেজিস্ট্রারের কাজ সুষ্ঠুভাবে ও ন্যায়ানুগভাবে পরিচালনার জন্য নতুন আইনে বলা আছে, ‘যদি রেজিস্ট্রারের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, এই ধারার অধীন গৃহীত কার্যধারায় আদেশ প্রদানের সময় সাক্ষ্য সম্পর্কে কোনো নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উদ্ঘাটিত হইয়াছে বা উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণে কোনো ভুল রহিয়াছে, তাহা হইলে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে, দাখিলকৃত আবেদনের ভিত্তিতে অথবা নিজ উদ্যোগে রেজিস্ট্রার তাহার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করিতে পারিবেন।’
নতুন কপিরাইট আইনে ‘সম্প্রচার সংস্থা এবং সম্পাদনাকারীর অধিকার ও মেয়াদ’ শিরোনামে নতুন অধ্যায় (ষষ্ঠ অধ্যায়) যুক্ত হয়েছে। ‘লোকজ্ঞান ও লোকসংস্কৃতির অধিকার সুরক্ষা’ শিরোনামে আরেকটি অধ্যায় (অষ্টম অধ্যায়) যুক্ত হয়েছে। নতুন আইনে যুগ চাহিদার বিষয় লক্ষ রেখে ডিজিটাল কর্মের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিষয়টি অতি প্রয়োজনীয়।
দেশে কপিরাইট ব্যবস্থাপনার একটি বড় সমস্যা হচ্ছে কপিরাইট সমিতি গড়ে না ওঠা। কপিরাইট সমিতি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে কার্যকর হলে কপিরাইট বাস্তবায়নে জনসচেতনতার বিষয়টি ফলপ্রসূ হয় এবং কপিরাইট সমিতি বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে এতদিন কপিরাইট সমিতির উল্লেখযোগ্য কার্যকারিতা ছিল না। এসব সমস্যা মাথায় রেখেই কপিরাইট আইন ২০২৩-এ কপিরাইট সমিতি বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় (নবম অধ্যায়) বিস্মৃতভাবে যুক্ত করা হয়েছে।
কপিরাইট ব্যবস্থাপনায় লাইসেন্স প্রদান ও গ্রহণ দীর্ঘমেয়াদি আয়, অর্জন ও অংশীজনদের প্রাপ্যতাকে নিশ্চিত করে। এজন্য নতুন আইনে লাইসেন্সের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে দশম অধ্যায় রচনা করা হয়েছে।
মেধাসত্ত্বের ব্যাপ্তি সব সময় দেশীয় পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ থাকে না। অর্থাৎ বিষয়টি শুধু দেশীয় নয়, অনেক ক্ষেত্রে বৈশ্বিকও বটে। এজন্য দেশে-বিদেশে কপিরাইট সংরক্ষণে এবং মেধাসত্ত্বের সুবিধা নিশ্চিতকল্পে ‘আন্তর্জাতিক কপিরাইট’ অধ্যায় (ত্রয়োদশ অধ্যায়) যুক্ত করে দেশের কপিরাইট ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিকে সুশৃঙ্খল ও কাঠামোবদ্ধ করা হয়েছে।
আইনের ব্যাখ্যা ও বিস্তৃতি সরল হলে তা এর সুবিধা ভোগকারীদের জন্য সুফল বয়ে আনে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই কপিরাইট আইনের শেষার্ধ্বে (ঊনবিংশ অধ্যায়) ‘বিবিধ’ নামে একটি অধ্যায় যুক্ত হয়েছে। এখানে কপিরাইট রেজিস্ট্রার ও কপিরাইট বোর্ডকে দেওয়ানি আদালতের মতো ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
অবৈধ সম্প্রচার বন্ধে কপিরাইট রেজিস্ট্রারের ক্ষমতা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘কোনো কর্মের অবৈধ সম্প্রচার সম্পর্কে কোনো কপিরাইট বা সম্পৃক্ত অধিকারের স্বত্বাধিকারীর লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রেজিস্ট্রার সম্প্রচার সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হইলে উক্ত কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে উক্তরূপ অবৈধ সম্প্রচার বন্ধ করিবার ব্যবস্থা করিবেন।’
আইনের মধ্যে প্রতিকার ও নিবারণমূলক ব্যবস্থা থাকে। কিছু আইনে মানুষের মানবিকতা, চেতনা ও বিবেককে জাগ্রত করার প্রতি বিশেষ নজর থাকে। মানুষকে সচেতনতার জন্য কিছু আইনে মান্যতা সম্প্রসারণের তাগিদ থাকে। কপিরাইটের মতো আইন তখনই সমাজে অধিক ক্রিয়াশীল হবে, যখন সমাজের Ethical Code of Conduct শক্তিশালী হবে। এ আইন Dust Stick Action-এর মাধ্যমে ফলপ্রসূ করতে চাইলে সুখকর অভিজ্ঞতা নাও হতে পারে।
নতুন কপিরাইট বিলম্বে প্রণীত হলেও এটি একটি স্বস্তির খবর। কিন্তু এ আইনের জন্য কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়ে আছে। কারণ গত ৪-৫ বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নানা বিষয় হয়তো নতুন আইনের আওতায় থাকবে না। কপিরাইট আইন ২০২৩-এর সমস্যাগুলো শনাক্ত করা যাবে কিছুদিন অতিবাহিত হলে। কারণ কার্যক্ষেত্রে নতুন সমস্যা ও সংকট হাজির হবে তখনই, যখন আইনের প্রয়োগ শুরু হবে। এ আইন সুসংহত করতে আইনের আলোকে একটি প্রবিধান প্রণয়ন দ্রুত করা গেলে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কপিরাইট আইনের কার্যকারিতা বাড়বে। এটি সবচেয়ে ফলদায়ক হবে যদি আমাদের সচেতনতা ও মনে ন্যায়নিষ্ঠতার পণ থাকে।
খান মাহবুব : সদস্য, কপিরাইট আইন প্রণয়ন ২০২৩ টেকনিক্যাল কমিটি
