Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ভোটদান নাগরিকের মৌলিক অধিকার

Icon

অমল বড়ুয়া

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচন বা ভোটের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। ভারতবর্ষে প্রথম ভোটের প্রচলনের খোঁজ মেলে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দে। বৈদিক, জৈন ও বৌদ্ধ শাস্ত্রমতে ভারতে ষোলোটি রাষ্ট্র ছিল, যাদের মহাজনপদ নামে আখ্যায়িত করা হয়। এসব জনপদ হয় রাজতন্ত্র শাসিত, নয় গোষ্ঠীতন্ত্র শাসিত সরকারব্যবস্থা ছিল। এসব জনপদের কোনো কোনোটিতে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ভোটব্যবস্থা চালু ছিল; কিন্তু সাধারণ মানুষ এ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ভোট হতো উচ্চবর্গীয় ক্ষত্রীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের দ্বারা।

তবে আধুনিক নির্বাচনব্যবস্থা হলো জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচন। সপ্তদশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে যখন প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের ধারণা এলো, এর আগে পর্যন্ত অবশ্য জনসাধারণকে দিয়ে সরকারি পদাধিকারী বাছাইয়ের এ আধুনিক নির্বাচনব্যবস্থাটির আবির্ভাবই হয়নি। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সংস্কৃতিতে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ছিল পুরুষরাই, নির্বাচকমণ্ডলীতেও তাই তাদেরই প্রাধান্য থাকত। অন্যান্য বহু দেশেও এ একই ধারা চলে আসছিল। গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতেও শুরুর দিকের নির্বাচনগুলোতে জমিদার অথবা শাসক শ্রেণির পুরুষদের প্রাধান্য ছিল। ১৯২০ সাল পর্যন্ত অবশ্য পশ্চিম ইউরোপের সব দেশ এবং উত্তর আমেরিকার গণতন্ত্রে সর্বজনীনভাবেই পুরুষ ভোটাধিকার চালু ছিল এবং তার পর থেকেই বহু দেশ নারীদের ভোটাধিকার দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল।

ব্রিটিশ শাসনামলে ভোট দেওয়ার কোনো অধিকার বাঙালি পায়নি। কারণ রাজতন্ত্রে ভোটের দরকার হয় না। ভোটের দরকার হয় গণতন্ত্রে। দেশভাগের পর ভারতের জনগণ প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায় ১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনে। ব্রিটিশদের বাহুবন্ধনী থেকে মুক্ত বাঙালি পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-নিপীড়ন ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে প্রথম ভোট দেওয়ার অধিকার পায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। বাঙালি ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়েই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ভূমিধস বিজয় উপহার দিয়েছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনেও বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত ভোটাধিকার প্রয়োগ ছিল কাক্সিক্ষত। ’৭৫ পরবর্তী ’৯১ পর্যন্ত নির্বাচন ও ভোটাধিকার ছিল সামরিক স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু ও বন্দুকের নলে পিষ্ট। সেই সময়কার সামরিক স্বৈরশাসকদের নির্বাচনের ভূতুড়ে পরিসংখ্যান এখনো হাসির খোরাক জোগায়। স্বৈরশাসনের পতনের পর গণতান্ত্রিক পদ্ধতির গোড়াপত্তনে নির্বাচনব্যবস্থা আমূল পালটে যায়। বাংলাদেশের ১১টি নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সবচেয়ে আনন্দ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়েছিল ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবং এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটারের উপস্থিতি ছিল। আর এ উপস্থিতির হার ছিল ৮৭ শতাংশ।

গণতন্ত্রে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। জনগণের এ ক্ষমতার উৎস হলো ভোটাধিকার। নির্বাচনের মূল চালিকাশক্তিই হলো ভোটার। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সমান ভোটাধিকার থাকে। নাগরিকের এ ভোটদানের অধিকারকে ‘মৌলিক’ অধিকার হিসাবে ধরা হয়। অর্থাৎ জনগণের অপরাপর মৌলিক অধিকার খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা ও বাসস্থানসহ অন্য অধিকারগুলোর মতো ভোট দেওয়ার অধিকারও এক ধরনের নাগরিক অধিকার। বলতে হয়, নাগরিক অধিকারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম অধিকার হলো এ ভোট দেওয়ার অধিকার। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবির মতে, ‘নির্বাচকমণ্ডলী হলো প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘গণতন্ত্রে ভোটাধিকার একটি অতি মূল্যবান অধিকার এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও বটে।’

বাংলাদেশ সংবিধানের ১২২(১) অনুচ্ছেদেও উল্লেখ আছে, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রত্যেক নাগরিক যাদের বয়স ১৮ বছর, তারা ভোটের মাধ্যমে ঠিক করবে তাদের প্রিয় দেশ কার দ্বারা পরিচালিত হবে, তারা কার দ্বারা পরিচালিত হবে, তাদের গ্রাম, নগর, শহর কার দ্বারা পরিচালিত হবে। আর এরকম একটি অবস্থান থেকে ভোটের অধিকারটা অনেক বড় একটা বিষয়। আর ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কার‌্যাবলী ন্যায়-নৈতিকতার সঙ্গে সুচারু রূপে সম্পাদন করার জন্য আইন সভায় (জাতীয় সংসদে) সদস্য হিসাবে প্রেরণ করেন। একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি নির্দিষ্ট নির্বাচনি এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেন। তাই নিজের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে নিজের অন্তর্ভুক্তি সুনিশ্চিতকরণে ভোট হচ্ছে উত্তম পন্থা। ‘দ্য স্পিরিট অব লজ’ বইয়ে এর লেখক ফরাসি দার্শনিক চার্লস লুই দ্য মন্টেস্কু বলেছেন,-‘প্রজাতন্ত্র অথবা গণতন্ত্র যে কোনো ক্ষেত্রের ভোটেই, দেশের প্রশাসক হও অথবা প্রশাসনের অধীনে থাকো-এ দুটি অবস্থার মধ্যেই পর্যায়ক্রমে ভোটারদের থাকতে হয়। নিজেদের দেশে কোনো সরকার আসবে তা বাছাই করার ‘মালিক’ অথবা ‘মাস্টার’ হিসাবে কাজ করে ভোটাররাই, ভোট দিয়ে একটি সার্বভৌম শাসনব্যবস্থাকে চালু রাখে জনসাধারণই।’ আপনার ভোট দেশের গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা ও উন্নয়ন বাস্তবায়নের ম্যান্ডেট। আপনার এ ভোট যে কোনো অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান হতে পারে। আপনার একটা ভোট দেশের ভালোর দিকে পরিবর্তনের নীরব হাতিয়ার হতে পারে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, ‘বুলেটের চেয়ে ব্যালট বেশি শক্তিশালী।’ আর এ ব্যালট আপনার ভাগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের ভাগ্য পরিবর্তনেও সহায়ক হবে। তাই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা আর সুন্দর সমাজ ও উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণে নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

অমল বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম