প্রাথমিকের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো
মো. সিদ্দিকুর রহমান
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শিশুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ৩+ বয়স থেকে-স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, ইংরেজি, আরবি বর্ণমালা দিয়ে। শিশুর প্রথম শিক্ষা তার নিজস্ব পরিবেশে। পরিবেশের জ্ঞান ধীরে ধীরে নিয়ে যায় তাকে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে। পরিবেশ শিক্ষায় সমৃদ্ধ জ্ঞান অর্জন করলে শিশু বেড়ে উঠবে আপন গতিতে। তাকে এগিয়ে যেতে হবে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির সংগ্রামী ইতিহাস নিয়ে। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় উজাড় করে দিতে হবে মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে। এটি ইমানের অঙ্গ।
একশ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দেশপ্রেম, দেশের সংস্কৃতি-ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান ব্যতিরেকেই বেড়ে উঠছে। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই তাদের ধর্মকর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবে। এটাই স্বাভাবিক। মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। সময়নিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ, সৎ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসাবে গড়ে উঠতে সব ধরনের কলাকৌশল অন্তর্ভুক্ত করিয়ে পাঠ্যক্রমকে সমৃদ্ধ করতে হবে। উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার আদলে যুগোপযোগী জ্ঞানমুখী শিক্ষাক্রমের কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। ধারাবাহিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ব্যবস্থার মাধ্যম বিশেষ করে শিশুশিক্ষার্থীদের হাতুড়ে পরীক্ষাব্যবস্থা থেকে মুক্ত করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। মুখস্থবিদ্যা পরিহার করে শিক্ষার্থীকে জ্ঞাননির্ভর শিক্ষায় আলোকিত করার উদ্দেশ্যে বর্তমান শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষার পরিবর্তে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।
বিগত বছরগুলোতে ১ম থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত সব ভর্তি পরীক্ষা লটারির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ব্যবস্থা পরবর্তী বছরগুলোয় চালু থাকবে বলে আশাবাদী। আগে ভর্তি পরীক্ষার জন্য বার্ষিক পরীক্ষাসহ সারা বছরের লেখাপড়ার ধকল দূর না হতেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দিনভর প্রস্তুতি নিতে হতো। ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং সেন্টারগুলোতে চলত জমজমাট বাণিজ্য। কিছু স্কুলে ভর্তির জন্য লাখ লাখ টাকা ঘুস নেওয়ার গুঞ্জন ছিল মানুষের মুখে মুখে। বর্তমান সময়ে ভর্তির কোচিং ও ভর্তির ঘুস বাণিজ্য শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। অপরদিকে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছাই করা ভালো শিক্ষার্থী ও বিত্তশালীদের সন্তানদের ভর্তি করিয়ে অনেকটা ‘তেলা মাথায় তেল দিয়ে’ নামিদামির খেতাব অর্জন করত। সে পরিস্থিতি এখন ম্লান হওয়ার পথে। এখন থেকে বিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জন করিয়ে সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে হবে। জ্ঞান ব্যতিরেকে সার্টিফিকেটের শিক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীর মেধার বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। এ প্রেক্ষাপটে শিশুর মাঝে সৃজনশীলতা বিষয়টির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে হবে। এ প্রসঙ্গে প্রাথমিকে রচনা লেখার বিষয়ে আলোকপাত করছি। এখনো আমাদের শিক্ষার্থীরা বই দেখে রচনা বা essay মুখস্থ করে। এতে অনেক নম্বর পেয়ে কৃতিত্ব জাহির করা যায়। রচনা বা essay যদি মুখস্থের বাইরে আসত, তাহলে শিক্ষার্থী তেমন কিছু লিখতে পারত না। অথচ রচনা লিখতে হয় নিজের মতো করে বর্ণনা দিয়ে। শিশুশিক্ষার্থীরা নিজে রচনা বলা বা লেখার অভ্যাস করলে তাদের মাঝে সৃজনশীলতা গড়ে উঠবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মনে জানার আগ্রহ ও কৌতূহল ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র তৈরিসহ উত্তর বলা বা লেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতার বিষয়টি উপস্থাপন করছি। শিক্ষক প্রথমে পাঠের বিষয়বস্তু সর্ম্পকে শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে ধারণা দেবেন। পরে তাদের মৌখিক প্রশ্ন তৈরি করতে বলবেন। অতঃপর পাঠ্যপুস্তক দেখে প্রশ্ন ও উত্তর খাতায় লিখতে বলবেন। শিক্ষার্থীর ঘাটতি পূরণে শিক্ষক তাদের পাশে থেকে সহযোগিতা করবেন। শিক্ষক বর্তমানে যে প্রশ্নপত্র তৈরি করে বিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা নেন, সে আদলে শিক্ষার্থী প্রশ্ন তৈরি করে নিজে উত্তর লেখার মাধ্যমে বিষয়বস্তু সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করবে। এভাবে বহু নির্বাচনি প্রশ্নসহ প্রশ্ন তৈরির মাধ্যমে তাদের চিন্তাশক্তিসহ সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে। শিশুশিক্ষার্থীরা পরিপূর্ণ সৃজনশীলতা আয়ত্ত করতে সক্ষম হলে নোট-গাইডের বাণিজ্যসহ মুখস্থ করার প্রবণতা বহুলাংশে দূর হবে।
শিক্ষাক্রম প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে প্রয়োজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ, অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী। এর ব্যত্যয় ঘটলে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। শিশুশিক্ষার জন্য প্রয়োজন প্রথমত, শিশু মনোবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। অথচ যোগ্যতাসম্পন্ন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় হাবুডুবু খাচ্ছে কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। দেশের বিপুলসংখ্যক শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে শিশুশিক্ষায় বর্তমান শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়ন নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে।
স্বাধীনতার এত বছর পরও শিশুদের শিক্ষক সংকট নিরসনে ধীরগতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক থাকলেও শিক্ষক সংকটের বেহাল দশা প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে শিরোনাম হতে দেখা যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভৌত অবকাঠামোসহ পরিবেশ এখন দৃষ্টিনন্দন ও মনোরম। অথচ শিক্ষক সংকটের কারণে এটি হয়ে পড়েছে অনেকটা ‘উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’ প্রবাদের মতো।
শিশুশিক্ষার আরেকটা চ্যালেঞ্জ হলো ক্যাডার সার্ভিসবিহীন প্রাথমিক শিক্ষা। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় মেধাবী, দক্ষ, অভিজ্ঞ জনবলের অভাব দেখা যায়। দীর্ঘ ২২ বছর আগে স্বতন্ত্র প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠিত হলেও প্রাথমিক শিক্ষায় কোনো নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিস গড়ে ওঠেনি। এর নেতিবাচক দিকগুলো হলো-
ক. প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত অধিকাংশ কর্মকর্তা বদলি ও প্রেষণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মরত থাকায় তারা তাদের নিজস্ব ক্যাডারের প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান ও অর্জিত অভিজ্ঞতা যথাযথ প্রয়োগ করার পর্যাপ্ত সুযোগ পান না। অধিকন্তু প্রেষণে নিয়োজিত এসব কর্মকর্তাকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলার পর প্রাথমিক শিক্ষাবহির্ভূত অন্যত্র প্রত্যাবর্তন ও পদায়নের ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার কোনো প্রতিফলন পাওয়া যায় না। খ. বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা নিয়মিত ক্যাডারের সদস্য না হওয়ায় তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট ক্যারিয়ার নেই। তাদের অধিকাংশই যে পদে চাকরি শুরু করেন, সে পদে থেকেই অবসরগ্রহণ করে থাকেন। গ. দেশে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ৭৭ হাজার প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োজিত। তাদের মধ্যে ২৫৪১ জন ১ম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা। দেখা যায় বাকি প্রায় ১০ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ২৮টি ক্যাডার বিদ্যমান আছে। অথচ প্রায় ৫ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য স্বতন্ত্র কোনো ক্যাডার নেই। ফলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণপূর্বক মানবসম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। ঘ. একটি পৃথক ক্যাডার ও ক্যারিয়ার না থাকার কারণে উচ্চশিক্ষিত প্রতিভাবান, চৌকশ ব্যক্তিরা প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে আকৃষ্ট হন না। একই কারণে নিুপদে যোগদানকারী উচ্চ মেধাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে ধরে রাখাও সম্ভব হয় না। এ কার্যক্রমের সঙ্গে ৪ লাখ ৭৭ হাজার ১২৫ জনের অধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষায়, যা দেশের সব সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ৩ ভাগের ২ ভাগের জন্য ২৮টি বিসিএস ক্যাডার থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কোনো বিসিএস ক্যাডার নেই। প্রাথমিক শিক্ষার এ ব্যাপক কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থেই বিসিএস প্রাথমিক ক্যাডার গঠন করা প্রয়োজন। পৃথকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার গঠিত হলে কর্মকর্তাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষিত, প্রতিভাবান কর্মকর্তারা এ সেক্টরে যোগদানের জন্য উৎসাহিত হবেন। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার সব ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
মো. সিদ্দিকুর রহমান : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ
