Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রাজনীতি কি জনধর্ম, নাকি সেবাপণ্য?

Icon

ড. মো. ফখরুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনীতি কি জনধর্ম, নাকি সেবাপণ্য?

আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, যে কোনো ভোটের তফশিল ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা সাজ সাজ রব পড়ে যেত। যে রবটা খুশির, আনন্দের। ভোট নিয়ে কারও মনে কোনো আতঙ্ক জাগত না। তখন সমাজের জ্ঞানীগুণী, পরোপকারী, জনসেবক, বয়োজ্যেষ্ঠ, গণ্যমান্য ব্যক্তিকে এক ধরনের অনুরোধ ও জোর করে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো।

তখন কেউ জিতলে খুব খুশি হতো, প্রতিপক্ষ কেউ হেরে গেলে কিছুটা লজ্জা পেত, পরক্ষণে সেটা মেনে নিত। সেটা এই ভেবে যে, মানুষ হয়তো তাকে তার নিজের দুর্বলতার কারণে অপছন্দ করেছে। এবার সে নিজেকে শুধরে নেবে, হয়তো আগামী নির্বাচনে সে জয়লাভ করবে। কিন্তু আজকাল সেই জনসেবক, পরোপকারী, সুবোধ প্রার্থীর সংখ্যা অতি নগণ্য অথবা তার আকাল লেগেছে।

কারণ, এখনকার দিনে সুবোধ মানুষকে কেউ কোনো ধরনের নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে চায় না। নির্বাচন করতে চাইলে এখন সেটা ব্যক্তিগত অর্থবিত্ত, পদমযার্দা, পেশিশক্তি, দলীয় একান্ত অনুকম্পালাভের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু দলীয় রজনীতি করলেই দলীয় মনোনয়ন লাভ করা দুরূহ ব্যাপার। কারণ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব লাভ করার জন্য আজকাল বহুবিধ অনুষঙ্গ প্রভাবক হিসাবে হাজির হয়ে যায়। একজন জ্ঞানী ও বাগ্মী নেতার পকেট ফুটো থাকলে তার কোনো কদর থাকে না। মনোনয়ন লাভের সময় কে কত বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, ব্যাংকের মালিক, সেগুলোই প্রধান নিয়ামক হিসাবে সামনে আসে। এরপর অনেকের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হলে প্রতিযোগিতা শুরু হয় কে কত পরিমাণ অর্থ দল বা দলের কর্তাদের জন্য অকাতরে ঢালতে সমর্থন, তার হিসাব-নিকাশ।

একটি বহুল প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, ভোটের আগে সিলেট বিভাগের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী তার নিজ দলের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বিষোদগার করেছিলেন। তিনি জানান ২০১৮ সালের নির্বাচনে দুই কোটি টাকায় মনোনয়ন পেয়েছেন তার প্রতিপক্ষ। দ্বাদশ নির্বাচনের পরিমাণ নাকি আরও বেশি। সারা দেশের অবস্থা আরও ভয়ংকর। প্রার্থী মনোনয়নে অর্থের বিনিময়ে লবিংড্যাশিং বলবৎ থাকায় রাজনীতিহীন নব্য নেতারা দলের গুণী, পরোপকারী, বয়োজ্যেষ্ঠ, গণ্যমান্যদের আগেই চাপে ফেলে ধরাশায়ী করে ফেলেছেন। আর এভাবে ডিজিটাল যুগের রাজনীতি অর্থের কাছে ধরাশায়ী হয়ে পড়েছে।

আর দিনে দিনে আসল রাজনীতিকের হাত ফসকে রাজনীতি চলে গেছে অর্থনীতির নতুন সংজ্ঞার শিকলে বন্দি এক আজব পেশায়। চিরায়ত নির্বাচনি পাঠের সংজ্ঞা ও সমীকরণ পরিবর্তিত হয়ে নতুন এক ধারণার বশবর্তী হয়েছে বিধায় রাজনীতি এখন একটি লাভজনক পেশা। এ পেশায় অতি দ্রুত অর্থ ফুলে-ফেঁপে বড় হওয়ার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারে। দ্বাদশ নির্বাচনের হলফনামায় সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যে জানা গেছে, আগ্রহী প্রার্থীদের পাঁচ বছর আগে-পরে কার কত সম্পদ দ্রুততম সময়ে মাত্রাতিরিক্ত সময়ে বেড়েছে!

রাজনীতি তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে একটি ব্যবসা, আর উঠতি আয়ের স্বল্পন্নোত দেশগুলোতে ব্যবসা ছাড়িয়ে এটি বড় বাণিজ্য হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এখানে নির্বাচন উৎসব না হয়ে লাভ-লোকসানের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব হিসাবে প্রায়ই আত্মঘাতী ও চরম বিব্রতকর বিষয় হিসাবে দেখা দিয়েছে।

সেজন্য আজকাল সব পেশা ছেড়ে সবাই রাজনৈতিক নেতা হওয়ার ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক, কোনোটিতে প্রার্থীর অভাব নেই। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া বড় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

তাই তো এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে ভোটে দাঁড়ানোর ব্যাপক তোড়জোড় এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপক সাড়া লক্ষ করা গেছে। অপরদিকে কিংস পার্টি, দলীয় পরিচয়বিহীন অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটের মাঠে নেমেও সরে দাঁড়িয়েছেন। তারা অনেকে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, প্রলোভন দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান না করায় তারা সরেছেন। এক্ষেত্রে অর্থাভাবে নির্বাচনে ক্ষান্ত দেওয়া ছড়া তাদের উপায় ছিল না। এমনকি জাতীয় পার্টির কিছু প্রার্থীর মুখেও এমন অভিযোগ শোনা গেছে।

নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেন্দ্রে এসে ভোট দিয়েছেন। মোট মাত্র ৪০.৮ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানানো হয়েছে। এই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৫৮.২ শতাংশ মানুষ ভোট কেন্দ্রে যাননি। ২০২৪ সালের ৪ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন দ্বারা প্রকাশিত চূড়ান্ত তথ্য অনুযায়ী, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন ভোটার ছিলেন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৬৯ হাজার ৭৪১ জন, নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯ জন এবং হিজড়া ভোটার ৮৪৯ জন। উল্লিখিত তথ্যানুযায়ী, গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৪০.৮ শতাংশ ভোট গণণা করা হলে প্রায় সাড়ে চার কোটি ভোটার ভোট দিয়েছেন। এবং প্রায় সোয়া সাত কোটি ভোটার ভোট দিতে যাননি। অর্থাৎ এ থেকে দেখা যায়, এবারের নির্বাচনে মোট ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন ভোটারের মধ্যে মাত্র তিন কোটির অধিক ভোটারের সমর্থন নিয়ে শাসক দল ক্ষমতায় বসেছেন।

এই অল্পসংখ্যক ভোটারের সমর্থন নিয়ে সংসদ গঠন অতিসহজ মনে হলেও সেটি আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে অতি দুর্বল ও অসাড়। নিজ দলের মধ্যে ভিন্ন প্রতীকে উপদল বানিয়ে নড়বড়ে সংসদ গঠন করলে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে আসবে, তা ইতোমধ্যে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন।

আমি যে বিষয়টি নিয়ে বলছি, তা হলো-ভোটারদের ভোটবিমুখতা গত কয়েকটি নির্বাচন থেকে বড় উদ্বেগের বিষয় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। অনেকে উন্নত দেশের স্বল্প ভোট কাস্টিংকে উদাহরণ হিসাবে টেনে আনলেও আমি সেটাতে নারাজ। কারণ, সেসব উন্নত দেশে ভোট নিয়ে এত মাতামাতি নেই। জখম, অগ্নিসংযোগ, খুনখারাবি নেই। সেখানে ডাকযোগেও মানুষ ভোট দেওয়ার সময় পায় না। তাদের দেশে সব মানুষ কাজের চাপে রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা ভোটের দিন যানবাহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরীক্ষা বন্ধ রাখে না। ভোট নিয়ে তারা আমাদের মতো দম্ভ, অসভ্যতা প্রদর্শন করে না।

কারণ, উন্নত দেশে রাজনীতি টাকা বানানোর মাধ্যম নয়, জনসেবার পেশা। সেখানে জনসেবায় সামান্য অভিযোগ হলে নেতারা সঙ্গে সঙ্গে সেই গ্লানি মাথা পেতে নিয়ে পদত্যাগ করেন। অপরদিকে আমাদের দেশে রাজনীতি টাকা বানানোর উপায়, দরিদ্র মানুষকে আরও দরিদ্র রেখে নিজের ব্যবসা চাঙা করার উপায়। গুদামে পণ্য মজুত রেখে অমানবিক জনভোগান্তি সৃষ্টি করার উপায়।

আমাদের সংসদে এখনো আশিভাগ প্রার্থী নমিনেশন কিনে নিয়ে নির্বাচন করেন। কমিশনের আচরণবিধির চোখে-মুখে ধুলা দিয়ে অবৈধভাবে টাকা ছিটিয়ে জয়লাভ করেন। দ্বাদশ নির্বাচনেও এসব বিব্রতকর ব্যাপার নিয়ে কমিশনের সদস্যদের রাতদিন তটস্থ থাকতে হয়েছে। এখানে একজন রিকশাচালক বা দিনমজুর একদিনের পেটের খাবার জোগানোর জন্য বাধ্য হয়ে গতর খাটতে পথে নামেন। তাদের সঙ্গে উন্নত দেশের ভোট প্রদানের হার তুলনা করা বোকামি।

আমাদের নিয়মিত ভোট প্রদানকারী মানুষগুলোর ভোটবিমুখতার আরেকটি কারণ নিরাপত্তাহীনতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়বিহীন মানুষগুলো হঠাৎ প্রার্থী হয়ে রাজনীতিকে বানরের গলায় মুক্তার হার মনে করে এটাকে চুরমার করতে দ্বিধা করেন না। দুধের মাছি অনেক প্রার্থীকে শুধু ভোটের সময় এলাকায় আনাগোনা করতে দেখা যায়। মানুষের বিপদ বা প্রয়োজনের সময় তাদেরকে তাদের বন্ধুরাই খুঁজে পায় না। দরিদ্র সাধারণ মানুষ বিপদের সময় নির্বাচিত নেতাদের কালো গাড়ির কাঁচের বন্ধ জানালায় টোকা দিলেও কোনো সাড়া পান না।

অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আমাদের দেশকে চরমভাবে বিশ্ব রাজনৈতিক মেরুকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমরা কখনই একচেটিয়া সমাজতন্ত্র বা একচেটিয়া গণতান্ত্রিক ব্লকের মধ্যে ছিলাম না। ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোও সেই একক ভাবাদর্শে নেই। কারণ, আমাদের লাখ লাখ শ্রমিক ও কর্মজীবী মানুষ ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে বাস করেন। রাশিয়া-চীনে এদেশের কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চায় না। আমাদের নিত্যপণ্যে ঘাটতি বেশি হলে ভারত থেকে আমদানি করে থাকি। কিন্তু সুযোগ বুঝে তারা সেসব পণ্যে তড়িঘড়ি করে অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়ে দিয়ে আমাদের স্থানীয় বাজার অস্থির করে তোলে। একথা সরকারের নীতিনির্ধারকরাও প্রায়ই বলে থাকেন।

বিশ্বের কোনো দেশ আমাদের শত্রু নয়, সবাই বন্ধু। অথচ, এবারের নির্বাচন আমাদের বিশ্ব রাজনৈতিক মেরুকরণের দিকে ঠেলে দিয়ে অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, পরিবেশ সবকিছুতেই হযবরল অবস্থা তৈরি করে ফেলেছে। নব্য নেতারা নিজের দল ভেঙে ভোটপ্রদানকারীকে হেয় ও হতাশ করেছেন ও ভোটবিমুখ মানুষগুলোকে খেপিয়ে তুলে দেশকে ভয়াবহ সামাজিক ভাঙনের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। দেশের ভবিষ্যতের দিকে নজর রেখে সেসব হতাশা আশু দূর করা জরুরি। নব্য আইনপ্রণেতারা জনসেবকের ভূমিকায় নেমে অবশ্যই ভালো কিছু করার চেষ্টা করবেন, সেই আশা করি। কিন্তু তারা কি দ্রুত সামলাতে পারবেন সেসব বিষয়?

ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

fakrul@ru.ac.bd

 

রাজনীতি জনধর্ম সেবাপণ্য

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম