Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

Icon

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কিছুদিন আগে দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কোনো কিশোর বা কিশোরীকে বাড়ির ভেতরে বা আঙিনায় খেলতে দেখলাম না। ছোটবেলায় দেখতাম শহর থেকে গ্রামে গেলে অনেক ছেলেমেয়ে এসে হাজির হতো। এবার বা গত দু-পাঁচ বছরে এমন দৃশ্য খুব বেশি চোখে পড়েনি। ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, ‘তোমার যে ছেলেটা ক্লাস নাইনে পড়ে, সে কোথায়, তাকে তো দেখছি না।’ ভাই অনেকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কিছুদিন আগে ছেলের পীড়াপীড়িতে নিরুপায় হয়ে তাকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছি। সারাক্ষণ সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। গেম না কী যেন চালায়। পড়াশোনায় কোনো মন নেই। কিছু বললে মান-অভিমান করে এবং নিজেকে শেষ করে ফেলার হুমকি দেয়। তাকে নিয়ে কী যে যন্ত্রণায় আছি।’ ভাইকে বললাম, ‘তুমি তোমার ছেলেকে মোবাইলের বিকল্প কিছু দিতে পার।’

আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে পুকুরে বা নদীতে সাঁতার কেটে। বন্ধুদের সঙ্গে হাডুডু, দাঁড়িয়াবাঁধা ও গোল্লাছুট খেলে। কিছুদিন আগেও গ্রামে গ্রামে পাল্লা দিয়ে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার প্রতিযোগিতা হতো। এখন আর তেমনটি দেখা যায় না। মোবাইল ফোনের গেমে আসক্তিতে আগামী প্রজন্ম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এখনই সেটি রুখে দিতে হবে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্ম খুব সহজেই অশ্লীল সিনেমা বা চলচ্চিত্র হাতের কাছে পায়। ফলে উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকে হয়তো বা মূল্যবোধহীন আগামী প্রজন্ম গড়ে উঠবে।

অষ্টাদশ শতকে ফরাসি সভ্যতার মধ্যে যে দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় ছিল তা হলো, মূল্যবোধ ও ন্যায্যতায় আপসহীনতা। আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সামগ্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ন্যায্যতা, সাম্য ও ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। সমসাময়িক ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা ফরাসিদের সঙ্গে তুলনীয় না হলেও সেসময় ভারতবর্ষে যে মূল্যবোধের চর্চা ছিল না, তা বলা যাবে না। কিন্তু এখন সে অবস্থা আর নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থাটা আরও বেহাল দশায় পৌঁছেছে, যা সভ্য সমাজের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যকে দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ করছে বা ভবিষ্যতে করবে।

মোদ্দা কথা হলো, মূল্যবোধের অনুপস্থিতিই অবক্ষয়ের সূচনা করে। অবক্ষয় বলতে আমরা সাধারণত সামাজিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিছু স্খলন বা চ্যুতিবিচ্যুতিকেই বুঝি। যেমন: মাদক এলএসডি, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, প্যাথেডিন; ইভটিজিং, জুয়া, ক্যাসিনো, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদিতে আসক্তিসহ কিছু সামাজিক অপরাধকে অবক্ষয় বলে সাব্যস্ত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এর ব্যাপ্তি আরও অনেক বিস্তৃত। মূলত সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণ লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে অবক্ষয়। ইদানীং তথাকথিত বা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা রাজনীতিকদের মাঝেও চরম মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা যায়। মানুষের মধ্যে যেনতেন উপায়ে রাতারাতি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার স্বপ্ন জাগ্রত হয়েছে। এর ফলে সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কিছু উদাহরণ তৈরি হয়েছে।

মূল্যবোধ ও অবক্ষয় পরস্পরবিরোধী, সাংঘর্ষিক। তাই মূল্যবোধ যেখানে দুর্বল, অবক্ষয় সেখানেই প্রবল। আলো-আঁধারের মধ্যে যেমন সহাবস্থান নেই, ঠিক তেমনই অবক্ষয় ও মূল্যবোধ একসঙ্গে চলতে পারে না। মূল্যবোধ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাগ্রত হয় না; বরং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরে এর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রই নাগরিকের সবকিছুই দেখভাল করে, তাই মূল্যবোধের লালন ও চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্বও রাষ্ট্রের। নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রের প্রথম কর্তব্য হবে নৈতিক শিক্ষা ও মূলবোধের চর্চাকে উৎসাহিত করা এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। এক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য শিক্ষাকে অবারিত করার বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। তবে সব শিক্ষিতই যে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন হবে বা অবক্ষয় মুক্ত থাকবে, এমনটা আশা করাও ঠিক নয়। যেসব মানুষ সুশিক্ষিত হতে পারেনি অর্থাৎ শিক্ষার মাধ্যমে সুকুমার বৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারেনি, তাদের মাধ্যমে মূল্যবোধ ও ন্যায্যতার চর্চা কখনো সম্ভব নয়।

এক্ষেত্রে সুশিক্ষাই কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত। কেউ যখন সুশিক্ষিত হয়ে ওঠে, তখন তার মধ্যে আপনা-আপনিই নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। তিনি অবক্ষয়মুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। আর তা ফুলে-ফলে সুশোভিত করার জন্য প্রয়োজন হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনুকূল পরিবেশ বা পৃষ্ঠপোষকতা। সুশিক্ষিত তিনিই যিনি তার শিক্ষাকে সৎ আর ন্যায়ের পথে নিয়োজিত করেন। যৌক্তিক বিষয়াদিকে যৌক্তিক বোঝার পর নিজ স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে, অযৌক্তিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্রত গ্রহণ করেন।

মূলত আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই এখন অবক্ষয়ের জয়-জয়কার চলছে। পাপিয়া, হেলেনা, সম্রাট, রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ ব্যক্তি পর্যায়ে এবং ইভ্যালি অনলাইন কেনাকাটা, শেয়ারবাজার, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনি, হলমার্ক, সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কেলেঙ্কারির ঘটনা নৈতিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের ব্যাপকতাই নির্দেশ করে। এখন সব ক্ষেত্রেই অবক্ষয় সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। দেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন, সামগ্রিক রাজনীতি আজকে কলুষিত। ভোটচুরি, নাগরিকের ভোটাধিকার চুরি হয়ে যাওয়া, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং মিথ্যা মামলা দিয়ে দমনপীড়ন আজ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব পর্যায়েই এর বিস্তার ঘটেছে। অবক্ষয় যে আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে, তা বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন নানা কর্মকাণ্ড ও ঘটনাপ্রবাহ থেকেই প্রমাণিত।

সাম্প্রতিককালে পরকীয়া, নারী ও শিশুনির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, ক্যাসিনো, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গরিবের ত্রাণের চাল চুরি ও আত্মসাৎ, গুপ্তহত্যা, গুম ও অপহরণ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। মূল্যবোধের অনুপস্থিতি এবং অবক্ষয়ের ব্যাপক বিস্তৃতির কারণেই এ ধরনের অপরাধ এখন ক্রমবর্ধমান ও লাগামহীন। এ জন্য দেশে গণমুখী ও সুস্থধারার রাজনীতির বিচ্যুতিকেই অনেকে দায়ী করেন।

রাজনীতির পরিসর বৃহৎ। রাজনীতি দেশ ও জনগণের আমূল কল্যাণে আবর্তিত হওয়ার কথা। এক্ষেত্রে মূল্যবোধ আর ন্যায্যতার ভিত্তি মজবুত না থাকলে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই হয় বেশি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায়বিচারের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ রাজনীতিকদের যদি মূল্যবোধের স্তর নিুমানের হয়, তাহলে তা আর রাজনীতি থাকে না বরং তা অপরাজনীতি হিসাবে বিবেচিত হয়। এর কুপ্রভাবে হাজারও মূল্যবোধ নষ্ট হয়। ব্যক্তির মূল্যবোধ নষ্ট হলে ক্ষতি শুধু একজনের; কিন্তু শাসক শ্রেণির মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই প্রবাদ আছে, ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট হয়, কষ্ট পায় প্রজা’। আমাদের প্রেক্ষাপটও বোধহয় তা থেকে আলাদা নয়। বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে যে ন্যায্যতা, সাম্যবাদের বা ন্যায়বিচারের কথা বলেছিলেন বা ধারণ করতেন, এ সময়ের রাজনীতিকদের মধ্যে সেই উচ্চমানের মূল্যবোধ প্রায় অনুপস্থিত।

শুধু রাজনৈতিক মূল্যবোধের বিষয় নয়, অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে ধর্মবিমুখতা, ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং সর্বগ্রাসী অশ্লীলতার মতো আরও কিছু বিষয়। ধর্মের যথাযথ চর্চা ও অনুশীলন কখনোই ধর্মান্ধতা শেখায় না; বরং ধর্মীয় আদর্শের মাধ্যমেই ধর্মান্ধতার অভিশাপমুক্ত হওয়া সম্ভব। কোনো ধর্মই উগ্রতার শিক্ষা দেয়নি। ধর্মই মানুষের জীবনপ্রণালি অন্যান্য ইতরপ্রাণী থেকে আলাদা করেছে; মানুষকে সভ্য, সংবেদনশীল ও পরিশীলিত করেছে।

আমরা দুর্নীতি এখনো কমাতে পারিনি। সবকিছুই দুর্নীতির করাল গ্রাসে আচ্ছন্ন। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ দুর্নীতি। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে নিজে থাকবেন আশ্বাস দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে, ওই চোর, ব্ল্যাক মার্কেটিয়ান, ওই ঘুসখোর। ভয় নেই, কোনো ভয় নেই। আমি আছি। দুর্নীতিবাজদের খতম করো, বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করো।’

দেশের মানুষের মধ্যে সেই মূল্যবোধ আবার ফিরিয়ে আনতে হবে।

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম : আইন গবেষক; এমফিল/পিএইচডি ফেলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম