Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যর্থ হচ্ছে কেন

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যর্থ হচ্ছে কেন

আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক কি এখন ‘পলিসি প্যারালাইসিসে’ ভুগছে? হতে পারে ব্যাংকটি এখন পলিসি জঙ্গলে আত্মগোপন করেছে। অথবা হতে পারে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগে রূপান্তরিত হয়ে রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। এসব বলার কারণ আছে। দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো ‘ওষুধ’ই দেশের অর্থনীতি বা ব্যাংক ব্যবসার কাজে আসছে না। এই যেমন খেলাপি ঋণের ঘটনা (ক্লাসিফাইড লোন)। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যত ‘খবরদারি’ করছে, ততই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ব্যাংকে ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নেতৃত্বে ‘রিকভারি সেল’ করতে হবে। ব্যাংকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘সমঝোতা স্বাক্ষরিত’ হচ্ছে। ঋণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে। তাদের তালিকা কাগজে ছাপা হচ্ছে, সংসদে উপস্থাপিত হচ্ছে। প্রথমাবস্থায় ‘রিকভারি এজেন্ট’ দিয়ে খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা হয়েছে। অর্থঋণ আদালত করা হয়েছে। মামলা হচ্ছে। দমাদম তিন বছরের পুরোনো খেলাপি ঋণ ‘অবলোপন’ (রাইট অফ) করা হচ্ছে। গভর্নর/ডেপুটি গভর্নররা এমডিদের ডেকে শাসিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু হা হতোস্মি! ‘যথা পূর্বং তথা পরং’ নয়, বরং এতে অধোগমন। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে এক বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। শতকরা হিসাবে ২০২২-এর ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০২৩-এর শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশে। টাকার অঙ্কে ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। ২০২৩-এর শেষে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। তাও অনুমান বহুক্ষেত্রে পুনঃতফশিল করার পর। ঢালাও তফশিল করার পর। বলা বাহুল্য, এতে ‘রাইট অফ’ করা লোনের টাকা যোগ করা হয়নি।

তাহলে কী দাঁড়াল? এত লম্ফঝম্ফ করার পর এই অবস্থা! অথচ এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করার জন্য কত শত শত কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এক সময় দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কেউ না কেউ বিমানেই থাকত-প্রশিক্ষণের উদ্দেশে বিদেশ যাত্রা বৈকি! এ নিয়ে কত কথা! সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এএমএ মুহিত অনেকবার ‘বকাঝকা’ করেছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। প্রশ্ন করেছিলেন, এত ‘প্রকল্প’ কীসের জন্য? তাও এ খবর দেয় আইএমএফ স্বয়ং। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর পরিমাণ কমানোর জন্য ‘নয়ছয়’ অর্থমন্ত্রী বড় ব্যবসায়ী/হিসাবরক্ষক আ হ ম মোস্তফা কামাল খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় কত পরিবর্তন আনেন! আজ এক ‘বুদ্ধি’ তো কাল আরেক ‘বুদ্ধি’। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘দাওয়াই’ মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট কোনো কাজে আসেনি। বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো। কত কড়াকড়ি, ১০ লাখ টাকার উপরে ব্যাংকে জমা দেওয়া যাবে না, তোলা যাবে না বিনা প্রশ্নে। কত প্রশিক্ষণ ব্যাংকে ব্যাংকে। প্রশিক্ষণের নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কত সম্মানি নিল। কিন্তু ফল? বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে, এখনো যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নীরব দর্শক। ১০ টাকার পণ্য আমদানি হলো/হচ্ছে ২০/২৫ টাকায়। ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাচার। ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে, পরিচালকের সংখ্যা নিয়ে, এক পরিবারের পরিচালকের সংখ্যা নিয়ে, স্বাধীন পরিচালকের সংখ্যা নিয়ে কত সার্কুলার! সার্কুলার আর সার্কুলার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ‘ওষুধের’ ফল উলটো। একই পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ‘হাফ ডজন’ ব্যাংক। চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাজ কী, তাদের যোগ্যতা কী হবে, কারা পরিচালক হতে পারবেন না-এসব ব্যাপারে কত সার্কুলার! আজ একটা, কাল একটা। ফলাফল কী? অশ্বডিম্ব। দুদিন পরপর ব্যাংকারদের ধমক, ডেকে ‘বকাঝকা’। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওষুধ যে কাজে আসছে না, তা কেউ বলছে না। ব্যাংকটি যে ‘পলিসি প্যারালাইসিসে’ ভুগছে তা কারও নজরে আসছে না। ব্যাংকটি যে একের পর এক সার্কুলার জারি করে সার্কুলারের এক জঙ্গল তৈরি করেছে, তা কেউ বলছে না।

পরিস্থিতি জটিল হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বস্তুত অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগে পরিণত করায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ে হঠাৎ তৈরি হলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ব্যাংকগুলো কোন দিকে যাবে? কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যাবে, না অর্থ মন্ত্রণালয়ে? দ্বৈত শাসন। সরকারি ব্যাংককে করা হলো লিমিটেড কোম্পানি। উদ্দেশ্য, বাজারে শেয়ার ছাড়া হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। কত বছর হলো? ওই ব্যাংকগুলো কি কোম্পানি আইন-১৯৯৪ মোতাবেক চলছে? না, অবশ্যই না। সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে গেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ব্যাংকের হাতে ছিল কর্মকর্তা নিয়োগ-পদোন্নতির বিষয়টি। তাও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। মনে আছে পুঁজির কথাটি। ব্যাংকের পুঁজি কত দরকার? তা হওয়া উচিত খারাপ সম্পদের নিরিখে। যত বেশি খারাপ সম্পদ হবে, যত বেশি খেলাপি ঋণ হবে, তত বেশি হবে পুঁজির দরকার। না, তা না করে হিসাব করা হলো ‘লায়াবিলিটির’ বিপরীতে। লায়াবিলিটি হচ্ছে ‘পুঁজি’, আবার আমানত-তাও হচ্ছে ‘লায়াবিলিটি’। অথচ আমানতের নিরিখে পুঁজির পরিমাণ নির্ধারিত হলো অনেক দিন। ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোতে পুঁজির স্বল্পতা দেখা দেয়, যা এখন আরও বেশি। ধরা যাক শেয়ারের ব্যবসার কথা। ব্যাংকগুলোকে দিয়ে শেয়ার ব্যবসা করানো হলো, যা ‘অপরাধ’ ছাড়া কিছু নয়। শেয়ারের ব্যবসা ঝুঁকিপূর্ণ। তা ব্যাংকের করার কথা নয়। ঠিক আছে, এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিল-না, এখন থেকে ব্যাংকগুলো শেয়ারের ব্যবসা করবে আলাদা ‘সাবসিডিয়ারি কোম্পানি’র মাধ্যমে। তা-ই হলো। প্রত্যেক ব্যাংক শেয়ারের ব্যবসা আলাদাভাবে করার জন্য ‘সাবসিডিয়ারি’ কোম্পানি করল। তারপর আর যায় কোথায়? হই হই, রই রই ঘটনা। ব্যাংকগুলো নেমে পড়ল শেয়ারের ব্যবসায়। লাভ বেশি। শেয়ারের দাম উঠল আকাশে। কোম্পানির মালিকরা উঁচু দামে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিল, আর নিজেরা হলো ‘দিগম্বর’ মালিক, অর্থাৎ প্রয়োজনীয় শেয়ার ছাড়াই ব্যাংকের পরিচালক/মালিক/শেয়ারবাজারে নামে ধস। লাখ লাখ লোক ধরাশায়ী। হাজার হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নিল ফটকা ব্যবসায়ীরা। কোনো বিচার নেই, আজও নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো দায়িত্ব নিল না। এরই মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে ঘটে যাচ্ছে হুজ্জতি। ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে রিজার্ভ। প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক খবরের কাগজে বলে যাচ্ছে রিজার্ভ কতটুকু বাড়ল তার হিসাব। এদিকে একশ্রেণির রপ্তানিকারক/বড় ব্যবসায়ী পেয়ে বসল সরকারকে। এত রিজার্ভ দিয়ে কী হবে? ডলার ধরে রাখার কোনো অর্থ হয় না। কী করণীয়? করণীয় হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার ফান্ড তৈরি করা। ওই ফান্ড থেকে ব্যবসায়ীদের ডলারে ঋণ দেওয়া হোক। তা-ই হলো। মাথা গরম সবার।

অথচ ঘটনাটা কী আসলে? বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বাড়ছিল ঠিকই; কিন্তু ওই বাড়াটাকে দেখানো হলো স্ফীত করে। কিছু লোককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পণ্ডিত বানানো হলো। তাদের পদোন্নতি হলো, সুনাম হলো। অথচ তারা ভুলভাবে হিসাবায়ন করছিল রিজার্ভের। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, আইএমএফ স্বীকৃত হিসাবায়ন নয়। এ কারণে বেশি বেশি মনে হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ধরা পড়লাম ডলার সংকট হওয়ার পর। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এসে বলল, তোমরা ভুল করেছ। শোধরাতে গিয়ে দেখা গেল আমাদের রিজার্ভ কমে গেছে অস্বাভাবিক হারে। ইতোমধ্যে অবশ্য একশ্রেণির ব্যবসায়ী প্রচুর আমদানি দেখিয়ে ‘ওভার ইনভয়েসিং’ করে ডলার পাচার করে নিয়ে গেছে। এসবই কিন্তু ঘটেছে ‘সার্কুলারের জঙ্গলে’ পরিণত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চোখের সামনে। তবু হুঁশ হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কথা নেই বার্তা নেই সরকারকে ঋণ দেওয়া শুরু করল অহরহ। আইএমএফ ধরল, সমালোচনা হলো। এখন বন্ধ রয়েছে ওই ঋণ দেওয়া কার্যক্রম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনি দায়িত্ব মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। এখন বলা হচ্ছে-না, এটা তারা একা পারবে না। দরকার রাজস্ব বিভাগ এবং বাণিজ্য বিভাগের সমর্থন ও সহযোগিতা। কিন্তু তা হচ্ছে কই? মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায়িত্ব নিচ্ছে না। মুদ্রা সরবরাহ সংকোচন নীতি অনুসরণ করছে তারা। ফলাফল শূন্য। মাঝখানে হোটেলে বসেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক করে দিল ‘ইজি মানি পলিসি’-যা ‘নয়-ছয়’ সুদনীতি বলে পরিচিত। যুক্তি, বিনিয়োগ বাড়বে। এখন যদি আমরা হিসাব চাই-বিনিয়োগ কত হয়েছে? লা জওয়াব? তাহলে কী হবে? ‘পলিসি প্যারালাইসিস’, ‘পলিসি জঙ্গল’ থেকে বেরিয়ে এসে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের শাসন থেকে বেরিয়ে এসে কি ব্যাংক কাজ করতে পারবে? পারবে কি দাঁত দেখাতে?

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কেন্দ্রীয় ব্যাংক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম